|
নিদ্রিতার চিত্র
মায়ায় রয়েছে বাঁধা প্রদোষ-আঁধার;
চিত্রপটে সন্ধ্যাতারা অস্ত নাহি যায়।
এলাইয়া ছড়াইয়া গুচ্ছ কেশভার
বাহুতে মাথাটি রেখে রমণী ঘুমায়।
চারি দিকে পৃথিবীতে চিরজাগরণ,
কে ওরে পাড়ালে ঘুম তারি মাঝখানে!
কোথা হতে আহরিয়া নীরব গুঞ্জন
চিরদিন রেখে গেছে ওরই কানে কানে!
ছবির আড়ালে কোথা অনন্ত নির্ঝর
নীরব ঝর্ঝর - গানে পড়িছে ঝরিয়া।
চিরদিন কাননের নীরব মর্মর,
লজ্জা চিরদিন আছে দাঁড়ায়ে সমুখে —
যেমনি ভাঙিবে ঘুম , মরমে মরিয়া
বুকের বসনখানি তুলে দিবে বুকে।
কল্পনামধুপ
প্রতিদিন প্রাতে শুধু গুন্ গুন্ গান,
লালসে অলস-পাখা অলির মতন।
বিকল হৃদয় লয়ে পাগল পরান
কোথায় করিতে যায় মধু অন্বেষণ।
বেলা বহে যায় চলে — শ্রান্ত দিনমান,
তরুতলে ক্লান্ত ছায়া করিছে শয়ন,
মুরছিয়া পড়িতেছে বাঁশরির তান,
সেঁউতি শিথিলবৃন্ত মুদিছে নয়ন।
কুসুমদলের বেড়া, তারি মাঝে ছায়া,
সেথা বসে করি আমি কল্পমধু পান —
বিজনে সৌরভময়ী মধুময়ী মায়া,
তাহারি কুহকে আমি করি আত্মদান —
রেণুমাখা পাখা লয়ে ঘরে ফিরে আসি
আপন সৌরভে থাকি আপনি উদাসী।
পূর্ণ মিলন
নিশিদিন কাঁদি, সখী, মিলনের তরে
যে মিলন ক্ষুধাতুর মৃত্যুর মতন।
লও লও বেঁধে লও কেড়ে লও মোরে —
লও লজ্জা, লও বস্ত্র, লও আবরণ।
এ তরুণ তনুখানি লহ চুরি করে —
আঁখি হতে লও ঘুম, ঘুমের স্বপন।
জাগ্রত বিপুল বিশ্ব লও তুমি হরে
অনন্তকালের মোর জীবন-মরণ।
বিজন বিশ্বের মাঝে মিলনশ্মশানে
নির্বাপিতসূর্যালোক লুপ্ত চরাচর,
লাজমুক্ত বাসমুক্ত দুটি নগ্ন প্রাণে
তোমাতে আমাতে হই অসীম সুন্দর।
এ কী দুরাশার স্বপ্ন হায় গো ঈশ্বর,
তোমা ছাড়া এ মিলন আছে কোন্খানে!
শ্রান্তি
সুখশ্রমে আমি, সখী, শ্রান্ত অতিশয়;
পড়েছে শিথিল হয়ে শিরার বন্ধন।
অসহ্য কোমল ঠেকে কুসুমশয়ন,
কুসুমরেণুর সাথে হয়ে যাই লয়।
স্বপনের জালে যেন পড়েছি জড়ায়ে।
যেন কোন্ অস্তাচলে সন্ধ্যাস্বপ্নময়
রবির ছবির মতো যেতেছি গড়ায়ে,
সুদূরে মিলিয়া যায় নিখিলনিলয়।
ডুবিতে ডুবিতে যেন সুখের সাগরে
কোথাও না পাই ঠাঁই, শ্বাস রুদ্ধ হয় —
পরান কাঁদিতে থাকে মৃত্তিকার তরে।
এ যে সৌরভের বেড়া , পাষাণের নয় —
কেমনে ভাঙিতে হবে ভাবিয়া না পাই,
অসীম নিদ্রার ভারে পড়ে আছি তাই ।
বন্দী
দাও খুলে দাও, সখী, ওই বাহুপাশ —
চুম্বনমদিরা আর করায়ো না পান।
কুসুমের কারাগারে রুদ্ধ এ বাতাস —
ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও বদ্ধ এ পরান।
কোথায় উষার আলো, কোথায় আকাশ —
এ চির পূর্ণিমারাত্রি হোক অবসান।
আমারে ঢেকেছে তব মুক্ত কেশপাশ,
তোমার মাঝারে আমি নাহি দেখি ত্রাণ !
আকুল অঙ্গুলিগুলি করি কোলাকুলি
গাঁথিছে সর্বাঙ্গে মোর পরশের ফাঁদ।
ঘুমঘোরে শূন্যপানে দেখি মুখ তুলি
শুধু অবিশ্রামহাসি একখানি চাঁদ।
স্বাধীন করিয়া দাও, বেঁধো না আমায় —
স্বাধীন হৃদয়খানি দিব তার পায়।
কেন
কেন গো এমন স্বরে বাজে তব বাঁশি,
মধুর সুন্দর রূপে কেঁদে ওঠে হিয়া,
রাঙা অধরের কোণে হেরি মধুহাসি
পুলকে যৌবন কেন উঠে বিকশিয়া!
কেন তনু বাহুডোরে ধরা দিতে চায়,
ধায় প্রাণ দুটি কালো আঁখির উদ্দেশে,
হায় যদি এত লজ্জা কথায় কথায়,
হায় যদি এত শ্রান্তি নিমেষে নিমেষে !
কেন কাছে ডাকে যদি মাঝে অন্তরাল,
কেন রে কাঁদায় প্রাণ সবই যদি ছায়া,
আজ হাতে তুলে নিয়ে ফেলে দিবে কাল —
এরি তরে এত তৃষ্ণা, এ কাহার মায়া !
মানবহৃদয় নিয়ে এত অবহেলা,
খেলা যদি, কেন হেন মর্মভেদী খেলা !
মোহ
এ মোহ ক'দিন থাকে, এ মায়া মিলায়,
কিছুতে পারে না আর বাঁধিয়া রাখিতে।
কোমল বাহুর ডোর ছিন্ন হয়ে যায়,
মদিরা উথলে নাকো মদির আঁখিতে।
কেহ কারে নাহি চিনে আঁধার নিশায়।
ফুল ফোটা সাঙ্গ হলে গাহে না পাখিতে।
কোথা সেই হাসিপ্রান্ত চুম্বনতৃষিত
রাঙা পুষ্পটুকু যেন প্রস্ফুট অধর !
কোথা কুসুমিত তনু পূর্ণবিকশিত,
কম্পিত পুলকভরে , যৌবনকাতর !
তখন কি মনে পড়ে সেই ব্যাকুলতা,
সেই চিরপিপাসিত যৌবনের কথা,
সেই প্রাণপরিপূর্ণ মরণ-অনল —
মনে পড়ে হাসি আসে ? চোখে আসে জল ?
পবিত্র প্রেম
ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না ওরে, দাঁড়াও সরিয়া।
ম্লান করিয়ো না আর মলিন পরশে।
ওই দেখো তিলে তিলে যেতেছে মরিয়া,
বাসনানিশ্বাস তব গরল বরষে।
জান না কি হৃদিমাঝে ফুটেছে যে ফুল,
ধুলায় ফেলিলে তারে ফুটিবে না আর।
জান না কি সংসারের পাথার অকূল,
জান না কি জীবনের পথ অন্ধকার।
আপনি উঠেছে ওই তব ধ্রুবতারা,
আপনি ফুটেছে ফুল বিধির কৃপায়,
সাধ করে কে আজি রে হবে পথহারা —
সাধ করে এ কুসুম কে দলিবে পায় !
যে প্রদীপ আলো দেবে তাহে ফেল শ্বাস,
যারে ভালোবাস তারে করিছ বিনাশ !
পবিত্র জীবন
মিছে হাসি, মিছে বাঁশি, মিছে এ যৌবন,
মিছে এই দরশের পরশের খেলা।
চেয়ে দেখো, পবিত্র এ মানবজীবন,
কে ইহারে অকাতরে করে অবহেলা !
ভেসে ভেসে এই মহা চরাচরস্রোতে
কে জানে গো আসিয়াছে কোন্খান হতে,
কোথা হতে নিয়ে এল প্রেমের আভাস,
কোন্ অন্ধকার ভেদি উঠিল আলোতে !
এ নহে খেলার ধন , যৌবনের আশ —
বোলো না ইহার কানে আবেশের বাণী !
নহে নহে এ তোমার বাসনার দাস,
তোমার ক্ষুধার মাঝে আনিয়ো না টানি !
এ তোমার ঈশ্বরের মঙ্গল-আশ্বাস,
স্বর্গের আলোক তব এই মুখখানি।
|