ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


কড়ি ও কোমল
 

মরীচিক | গান-রচনা | সন্ধ্যার বিদায় | রাত্রি | বৈতরণী | মানবহৃদয়ের বাসনা | সিন্ধুগর্ভ | ক্ষুদ্র অনন্ত | সমুদ্র | অস্তমান রবি | অস্তাচলের পরপারে | প্রত্যাশা | স্বপ্নরুদ্ধ


 

     মরীচিকা

এসো, ছেড়ে এসো, সখী, কুসুমশয়ন।
বাজুক কঠিন মাটি চরণের তলে।
কত আর করিবে গো বসিয়া বিরলে
আকাশকুসুমবনে স্বপন চয়ন।
দেখো ওই দূর হতে আসিছে ঝটিকা,
স্বপ্নরাজ্য ভেসে যাবে খর অশ্রুজলে।
দেবতার বিদ্যুতের অভিশাপশিখা
দহিবে আঁধার নিদ্রা বিমল অনলে।
চলো গিয়ে থাকি দোঁহে মানবের সাথে,
সুখদুঃখ লয়ে সবে গাঁথিছে আলয় —
হাসি-কান্না ভাগ করি ধরি হাতে হাতে
সংসারসংশয়রাত্রি রহিব নির্ভয়।
সুখরৌদ্রমরীচিকা নহে বাসস্থান,
মিলায় মিলায় বলি ভয়ে কাঁপে প্রাণ।

         
গান-রচনা
এ শুধু অলস মায়া, এ শুধু মেঘের খেলা,
এ শুধু মনের সাধ বাতাসেতে বিসর্জন —
এ শুধু আপন মনে মালা গেঁথে ছিঁড়ে ফেলা
নিমেষের হাসিকান্না গান গেয়ে সমাপন।
শ্যামল পল্লবপাতে রবিকরে সারাবেলা
আপনার ছায়া লয়ে খেলা করে ফুলগুলি,
এও সেই ছায়া-খেলা বসন্তের সমীরণে।
কুহকের দেশে যেন সাধ করে পথ ভুলি
হেথা হোথা ঘুরি ফিরি সারাদিন আনমনে।
কারে যেন দেব ব'লে কোথা যেন ফুল তুলি,
সন্ধ্যায় মলিন ফুল উড়ে যায় বনে বনে।
এ খেলা খেলিবে হায় খেলার সাথি কে আছে ?
ভুলে ভুলে গান গাই— কে শোনে, কে নাই শোনে —
যদি কিছু মনে পড়ে, যদি কেহ আসে কাছে !
 

                    সন্ধ্যার বিদায়
সন্ধ্যা যায়, সন্ধ্যা ফিরে চায়, শিথিল কবরী পড়ে খুলে —
যেতে যেতে কনক
আঁচল বেধে যায় বকুলকাননে,
চরণের পরশরাঙিমা রেখে যায় যমুনার কূলে —
নীরবে
বিদায় চাওয়া চোখে , গ্রন্থি - বাঁধা রক্তিম দুকূলে
আঁধারের ম্লানবধূ যায় বিষাদের বাসরশয়নে।
সন্ধ্যাতারা পিছনে দাঁড়ায়ে চেয়ে থাকে আকুল নয়নে।
যমুনা কাঁদিতে চাহে বুঝি, কেন রে কাঁদে না কণ্ঠ তুলে —
বিস্ফারিত হৃদয় বহিয়া চলে যায় আপনার মনে।
মাঝে মাঝে ঝাউবন হতে গভীর নিশ্বাস ফেলে ধরা।
সপ্ত ঋষি দাঁড়াইল আসি নন্দনের সুরতরুমূলে —
চেয়ে থাকে পশ্চিমের পথে, ভুলে যায় আশীর্বাদ করা।
নিশীথিনী রহিল জাগিয়া বদন ঢাকিয়া এলোচুলে।
কেহ আর কহিল না কথা, একটিও বহিল না শ্বাস —
আপনার সমাধি-মাঝারে নিরাশা নীরবে করে বাস।

                রাত্রি
জগতেরে জড়াইয়া শত পাকে যামিনীনাগিনী
আকাশ-পাতাল জুড়ি ছিল পড়ে নিদ্রায় মগনা,
আপনার হিম দেহে আপনি বিলীনা একাকিনী।
মিটিমিটি তারকায় জ্বলে তার অন্ধকার ফণা।
উষা আসি মন্ত্র পড়ি বাজাইল ললিত রাগিণী।
রাঙা আঁখি পাকালিয়া সাপিনী উঠিল তাই জাগি —
একে একে খুলে পাক, আঁকিবাঁকি কোথা যায় ভাগি।
পশ্চিমসাগরতলে আছে বুঝি বিরাট গহ্বর,
সেথায় ঘুমাবে বলে ডুবিতেছে বাসুকিভগিনী
মাথায় বহিয়া তার শত লক্ষ রতনের কণা।
শিয়রেতে সারা দিন জেগে রবে বিপুল সাগর —
নিভৃতে স্তিমিত দীপে চুপি চুপি কহিয়া কাহিনী
মিলি কত নাগবালা স্বপ্নমালা করিবে রচনা।

             
বৈতরণ
অশ্রুস্রোতে স্ফীত হয়ে বহে বৈতরণী,
চৌদিকে চাপিয়া আছে আঁধার রজনী।
পূর্ব তীর হতে হু হু আসিছে নিশ্বাস,
যাত্রী লয়ে পশ্চিমেতে চলেছে তরণী।
মাঝে মাঝে দেখা দেয় বিদ্যুৎ-বিকাশ,
কেহ কারে নাহি চেনে ব'সে নতশিরে।
গলে ছিল বিদায়ের অশ্রুকণা-হার,
ছিন্ন হয়ে একে একে ঝ'রে পড়ে নীরে।
ওই বুঝি দেখা যায় ছায়া-পরপার,
অন্ধকারে মিটিমিটি তারা-দীপ জ্বলে।
হোথায় কি বিস্মরণ, নিঃস্বপ্ন নিদ্রার
শয়ন রচিয়া দিবে ঝরা ফুলদলে!
অথবা অকূলে শুধু অনন্ত রজনী
ভেসে চলে কর্ণধারবিহীন তরণী!

         মানবহৃদয়ের বাসনা
নিশীথে রয়েছি জেগে; দেখি অনিমেখে,
লক্ষ হৃদয়ে সাধ শূন্যে উড়ে যায়।
কত দিক হতে তারা ধায় কত দিকে!
কত-না অদৃশ্যকায়া ছায়া-আলিঙ্গন
বিশ্বময় কারে চাহে , করে হায়-হায়।
কত স্মৃতি খুঁজিতেছে শ্মশানশয়ন —
অন্ধকারে হেরো শত তৃষিত নয়ন
ছায়াময় পাখি হয়ে কার পানে ধায়।
ক্ষীণশ্বাস-মুমূর্ষুর অতৃপ্ত বাসনা
ধরণীর কূলে কূলে ঘুরিয়া বেড়ায়।
উদ্দেশে ঝরিছে কত অশ্রুবারিকণা,
চরণ খুঁজিয়া তারা মরিবারে চায়।
কে শুনিছে শত কোটি হৃদয়ের ডাক!
নিশীথিনী স্তব্ধ হয়ে রয়েছে অবাক।

              সিন্ধুগর্ভ
উপরে স্রোতের ভরে ভাসে চরাচর
নীল সমুদ্রের'পরে নৃত্য ক'রে সারা।
কোথা হতে ঝরে যেন অনন্ত নির্ঝর,
ঝরে আলোকের কণা রবি শশী তারা।
ঝরে প্রাণ, ঝরে গান, ঝরে প্রেমধারা —
পূর্ণ করিবারে চায় আকাশ সাগর।
সহসা কে ডুবে যায় জলবিম্বপারা —
দু-একটি আলো-রেখা যায় মিলাইয়া,
তখন ভাবিতে বসি কোথায় কিনারা —
কোন্‌ অতলের পানে ধাই তলাইয়া!
নিম্নে জাগে সিন্ধুগর্ভ স্তব্ধ অন্ধকার।
কোথা নিবে যায় আলো, থেমে যায় গীত —
কোথা চিরদিন তরে অসীম আড়াল !
কোথায় ডুবিয়া গেছে অনন্ত অতীত !
 

            ক্ষুদ্র অনন্ত
অনন্ত দিবসরাত্রি কালের উচ্ছ্বাস —
তারি মাঝখানে শুধু একটি নিমেষ,
একটি মধুর সন্ধ্যা, একটু বাতাস,
মৃদু আলো-আঁধারের মিলন-আবেশ —
তারি মাঝখানে শুধু একটুকু জুঁই
একটুকু হাসিমাখা সৌরভের লেশ,
একটু অধর তার ছুঁই কি না-ছুঁই,
আপন আনন্দ লয়ে উঠিতেছে ফুটে
আপন আনন্দ লয়ে পড়িতেছে টুটে।
সমগ্র অনন্ত ওই নিমেষের মাঝে
একটি বনের প্রান্তে জুঁই হয়ে উঠে।
পলকের মাঝখানে অনন্ত বিরাজে।
যেমনি পলক টুটে ফুল ঝরে যায়,
অনন্ত আপনা-মাঝে আপনি মিলায়॥

 

               সমুদ্র
কিসের অশান্তি এই মহাপারাবারে,
সতত ছিঁড়িতে চাহে কিসের বন্ধন!
অব্যক্ত অস্ফুট বাণী ব্যক্ত করিবারে
শিশুর মতন সিন্ধু করিছে ক্রন্দন।
যুগযুগান্তর ধরি যোজন যোজন
ফুলিয়া ফুলিয়া উঠে উত্তাল উচ্ছ্বাস —
অশান্ত বিপুল প্রাণ করিছে গর্জন,
নীরবে শুনিছে তাই প্রশান্ত আকাশ।
আছাড়ি চূর্ণিতে চাহে সমগ্র হৃদয়
কঠিন পাষাণময় ধরণীর তীরে,
জোয়ারে সাধিতে চায় আপন প্রলয়,
ভাঁটায় মিলাতে চায় আপনার নীরে।
অন্ধ প্রকৃতির হৃদে মৃত্তিকায় বাঁধা।
সতত দুলিছে ওই অশ্রুর পাথার,
উন্মুখী বাসনা পায় পদে পদে বাধা,
কাঁদিয়া ভাসাতে চাহে জগৎ-সংসার।
সাগরের কণ্ঠ হতে কেড়ে নিয়ে কথা
সাধ যায় ব্যক্ত করি মানবভাষায় —
শান্ত করে দিই ওই চির-ব্যাকুলতা,
সমুদ্রবায়ুর ওই চির হায়-হায়।
সাধ যায় মোর গীতে দিবস-রজনী
ধ্বনিবে পৃথিবী-ঘেরা সংগীতের ধ্বনি।


            
অস্তমান রবি
আজ কি, তপন, তুমি যাবে অস্তাচলে
না শুনে আমার মুখে একটিও গান!
দাঁড়াও গো, বিদায়ের দুটি কথা বলে
আজিকার দিন আমি করি অবসান।
থামো ওই সমুদ্রের প্রান্তরেখা-' পরে,
মুখে মোর রাখো তব একমাত্র আঁখি।
দিবসের শেষ পলে নিমেষের তরে
তুমি চেয়ে থাকো আর আমি চেয়ে থাকি।
দুজনের আঁখি-' পরে সায়াহ্ন-আঁধার
আঁখির পাতার মতো আসুক মুদিয়া,
গভীর তিমিরস্নিগ্ধ শান্তির পাথার
নিবায়ে ফেলুক আজি দুটি দীপ্ত হিয়া।
শেষ গান সাঙ্গ করে থেমে গেছে পাখি,
আমার এ গানখানি ছিল শুধু বাকি।
 

      অস্তাচলের পরপারে
              সন্ধ্যাসূর্যের প্রতি
আমার এ গান তুমি যাও সাথে করে
নূতন সাগরতীরে দিবসের পানে।
সায়াহ্নের কূল হতে যদি ঘুমঘোরে
এ গান উষার কূলে পশে কারো কানে!
সারা রাত্রি নিশীথের সাগর বাহিয়া
স্বপনের পরপারে যদি ভেসে যায়,
প্রভাত - পাখিরা যবি উঠিবে গাহিয়া
আমার এ গান তারা যদি খুঁজে পায়।
গোধূলির তীরে বসে কেঁদেছে যে জন,
ফেলেছে আকাশে চেয়ে অশ্রুজল কত,
তার অশ্রু পড়িবে কি হইয়া নূতন
নবপ্রভাতের মাঝে শিশিরের মতো।
সায়াহ্নের কুঁড়িগুলি আপনা টুটিয়া
প্রভাতে কি ফুল হয়ে উঠে না ফুটিয়া !

            
প্রত্যাশা
সকলে আমার কাছে যত কিছু চায়
সকলেরে আমি তাহা পেরেছি কি দিতে !
আমি কি দিই নি ফাঁকি কত জনে হায়,
রেখেছি কত-না ঋণ এই পৃথিবীতে।
আমি তবে কেন বকি সহস্র প্রলাপ,
সকলের কাছে চাই ভিক্ষা কুড়াইতে!
এক তিল না পাইলে দিই অভিশাপ,
অমনি কেন রে বসি কাতরে কাঁদিতে !
হা ঈশ্বর, আমি কিছু চাহি নাকো আর,
ঘুচাও আমার এই ভিক্ষার বাসনা।
মাথায় বহিয়া লয়ে চির ঋণভার
‘পাইনি' ‘পাইনি' বলে আর কাঁদিব না।
তোমারেও মাগিব না, অলস কাঁদনি —
আপনারে দিলে তুমি আসিবে আপনি।

                স্বপ্নরুদ্ধ
নিষ্ফল হয়েছি আমি সংসারের কাজে,
লোকমাঝে আঁখি তুলে পারি না চাহিতে।
ভাসায়ে জীবনতরী সাগরের মাঝে
তরঙ্গ লঙ্ঘন করি পারি না বাহিতে।
পুরুষের মতো যত মানবের সাথে
যোগ দিতে পারি নাকো লয়ে নিজ বল,
সহস্র সংকল্প শুধু ভরা দুই হাতে
বিফলে শুকায় যেন লক্ষ্মণের ফল।
আমি গাঁথি আপনার চারি দিক ঘিরে
সূক্ষ্ম রেশমের জাল কীটের মতন।
মগ্ন থাকি আপনার মধুর তিমিরে,
দেখি না এ জগতের প্রকাণ্ড জীবন।
কেন আমি আপনার অন্তরালে থাকি !
মুদ্রিত পাতার মাঝে কাঁদে অন্ধ আঁখি।