ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
নবজাতক
গ্রন্থ পরিচিতি
সূচনা
|
নবজাতক
|
উদ্বোধন
|
শেষদৃষ্টি
|
প্রায়শ্চিত্ত
| বুদ্ধভক্তি
|
কেন |
হিন্দুস্থান
|
রাজপুতানা
|
ভাগ্যরাজ্য
|
ভূমিকম্প
|
পক্ষীমানব
|
আহ্বান
|
রাতের গাড়ি
|
মৌলানা জিয়াউদ্দীন |
অস্পষ্ট
|
এপারে-ওপারে |
মংপু পাহাড়ে
|
ইস্টেশন
|
জবাবদিহি
|
সাড়ে নটা
|
প্রবাসী
|
জন্মদিন
|
প্রশ্ন
|
রোম্যাণ্টিক
|
ক্যাণ্ডীয় নাচ
|
অবর্জিত
|
শেষ হিসাব
|
সন্ধ্যা
|
জয়ধ্বনি
|
প্রজাপতি
|
প্রবীণ
|
রাত্রি
|
শেষ
বেলা
|
রূপ-বিরূপ
|
শেষ কথা
|
বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী চতুর্বিংশ (২৪) খণ্ডের গ্রন্থ পরিচয় অংশে লিখিত- এই গ্রন্থ সম্পর্কিত পাঠ।
'নবজাতক' ১৩৪৭ সালের বৈশাখ মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়। তৎপূর্বে ইহার
অধিকাংশ কবিতা সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হইয়াছিল। নিম্নে প্রকাশসূচী
যথাসম্ভব সাময়িক পত্রের পৃষ্ঠাঙ্কসহ মুদ্রিত হইল–
নবজাতক উদ্বোধন প্রায়শ্চিত্ত বুদ্ধভক্তি কেন হিন্দুস্থান রাজপুতানা ভাগ্যরাজ্য ভূমিকম্প পক্ষীমানব রাতের গাড়ি মৌলানা জিয়াউদ্দীন এপারে-ওপারে মংপু পাহাড়ে ইস্টেশন জবাবদিহি প্রবাসী জন্মদিন রোম্যাণ্টিক ক্যাণ্ডীয় নাচ অবর্জিত শেষ হিসাব জয়ধ্বনি প্রজাপতি প্রবীণ রাত্রি |
পাঠশালা। কার্তিক
১৩৪৫। ৮৯ শতদল। [কষ্টিপাথর: প্রবাসী। জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭। ২২১] প্রবাসী। অগ্রহায়ণ ১৩৪৫। ১৯৭ পরিচয়। ফাল্গুন ১৩৪৪। ৭০৫ প্রবাসী। চৈত্র ১৩৪৫। ৭৭৯ প্রবাসী। পৌষ ১৩৪৪। ৩০১ প্রবাসী। মাঘ ১৩৪৫। ৫৯৯ পরিচয়। শ্রাবণ ১৩৪৪। ১ নাচঘর। ৩০ চৈত্র ১৩৪০ বিচিত্রা। জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৯। ৫৭১ জয়শ্রী। জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭ প্রবাসী। শ্রাবণ ১৩৪৫। ৫৮০ প্রবাসী। ১৩৪৬। ৪৫৫ পরিচয়। শ্রাবণ ১৩৪৫। ১ কবিতা। আশ্বিন ১৩৪৫। ১ প্রবাসী। বৈশাখ ১৩৪৭। ৪৮ 'জন্মদিন' : প্রবাসী। জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৬। ২৭১ প্রবাসী। আষাঢ় ১৩৪৬। ৩১১ কবিতা। পৌষ ১৩৪৬। ১ প্রবাসী। শ্রাবণ ১৩৪৪। ৪৭৫ প্রবাসী। শ্রাবণ ১৩৪২। ৪৫৭ কবিতা। আশ্বিন ১৩৪৬। ১ প্রবাসী। পৌষ ১৩৪৬।২৯৯ প্রবাসী। বৈশাখ ১৩৪৬।৪ প্রবাসী। পৌষ ১৩৪৫।৩৪৫ প্রবাসী। মাঘ ১৩৪৬। ৪৩৫ |
'নবজাতক' কবিতা শ্রীমান্ কিশোরকান্ত বাগচীর উদ্দেশে লিখিত তাহা
পাণ্ডুলিপি হইতে জানা যায়। অপিচ দ্রষ্টব্য চিঠিপত্র ৯, পৃ ৪২৪ ও
৪৩০।
'উদ্বোধন' কবিতাটির যে পাঠ সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হইয়াছিল তাহা
অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত ছিল। উক্ত পাঠ অনুসারে, নিম্নোদ্ধৃত নূতন
চারিটি ছত্রের অনুবৃত্তিস্বরূপ নবজাতকে মুদ্রিত পাঠের শেষ একাদশ
ছত্র (পৃ. ৭) পড়িতে হইবে–
|
শুকতারকার প্রথম প্রদীপ হাতে অরুণ-আভাস-জড়ানো ভোরের রাতে আমি এসেছিনু তোমারে জাগাব ব'লে তরুণ আলোর কোলে– |
কবিতাটির আরম্ভের কুড়িটি ছত্র, রবীন্দ্রসদনে-রক্ষিত পাণ্ডুলিপি
অনুসারে, ১৯৩৮ সালের ১৩ অক্টোবর তারিখে শান্তিনিকেতনে স্বতন্ত্র
কবিতা-আকারে প্রথম লিখিত হইয়াছিল বলিয়া মনে হয়। সেই আকারে উহা
দ্বিতীয়সংস্করণ গীতবিতানের 'ভুমিকা' রূপে মুদ্রিত হইয়াছিল।
'প্রায়শ্চিত্ত' কবিতাটির পূর্বতন একটি পাঠ রবীন্দ্রসদনের
পাণ্ডুলিপিতে নিম্নরূপ পাওয়া যায়–
|
বহু শত শত বৎসর ব্যাপি |
'বুদ্ধভক্তি' কবিতার
গদ্যচ্ছন্দে লিখিত সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি রূপ পত্রপুট গ্রন্থের
দ্বিতীয় সংস্করণে বা উহার পুনর্মূদ্রণে সতেরো-সংখ্যক কবিতার আকারে
মুদ্রিত আছে। আলোচ্য প্রসঙ্গে বিংশখণ্ড রবীন্দ্র-রচনাবলীর ৫১
পৃষ্ঠা ও গ্রন্থপরিচয় দ্রষ্টব্য।
'কেন' কবিতার মিল-বিহীন একটি
সম্পর্ণ স্বতন্ত্র পাঠ পাণ্ডুলিপিতে রহিয়াছে, কবিতাটির উহাই সম্ভবত
আদি পাঠ। সমগ্র কবিতাটি নিম্নে মুদ্রিত হইল–
|
শুনিলাম জ্যোতিষীর কাছে তপনের আত্মদান-মহাযজ্ঞ হতে যে জ্যোতি-উৎসর্গ হয় নৈবেদ্যের মতো এ বিশ্বের মন্দিরমণ্ডপে, অতি তুচ্ছ অংশ তার ধরা পড়ে পৃথিবীর অতি ক্ষুদ্র মৃৎপাত্রের তলে। অবশিষ্ট অমেয় আলোকরশ্মিধারা আদিম দিগন্ত হতে অক্লান্ত চলেছে ধেয়ে লক্ষ্যহারা দ্যুলোকে দ্যুলোকে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটিয়াছে অপার তিমির-তেপান্তরে অসংখ্য নক্ষত্র হতে তেজোদীপ্ত অক্ষৌহিণী। এ কি সর্বত্যাগী অপব্যয় সর্বগ্রাসী ব্যর্থতার নিঃসীম অতলে। কিংবা এ কি মহাকাল এক হাতে দান করে, ফিরে ফিরে নেয় অন্য হাতে। যুগে যুগে বারংবার হিসাব মেলানো প্রকাণ্ড সঞ্চয়ে অপচয়ে? কিন্তু কেন। তার পরে চেয়ে দেখি মানুষের চৈতন্যজগতে। ভেসে চলে কত চিন্তা কত-না কল্পনা, কত পথে কত কীর্তি রূপে রসে-তীব্র বেগে অমরত্ব সন্ধানের উদ্দাম উচ্ছ্বাসে উঠে জেগে ক্লান্তিহীন চেষ্টা কত। জ্বলে ওঠে কোথাও বা বাতি সংসারের যাত্রাপথে তপস্যার তেজে। কোথাও বা সভ্যতার চিতাবহ্নিদাহ নিঃস্বতার ভস্মশেষ রেখে। লক্ষ লক্ষ ঝরিছে নির্ঝর নিরুদ্দেশ প্রাণস্রোতে বহু ইচ্ছা বহু স্মৃতি লয়ে। নিত্য নিত্য এমনি কি অফুরান আত্মহত্যা মানবলোকের। যুগে যুগান্তরে মানুষের চিত্ত নিয়ে মহাকাল কেবলি কি করে দ্যূতখেলা আপনারি বাঁ হাতে দক্ষিণ হাতে। কিন্তু কেন। একদিন প্রথম বয়সে এ প্রশ্নই জেগেছিল মনে। শুধায়েছি এ বিশ্বের কোন্ কেন্দ্রস্থলে মিলিতেছে নিরন্তর অরণ্যের পর্বতের মসুদ্রের উল্লোলগর্জন, ঝটিকার বজ্রমন্দ্র, দিবসের রজনীর মর্মস্থলে বেদনাবীণার তারে চেতনার মিশ্রিত ঝংকার, নিদ্রার মর্মরধ্বনি, বসন্তের বরষার ঋতু-সভাঙ্গনে জীবনের মরণের অবিশ্রাম কীর্তনকল্লোল, আলোকের নিঃশব্দ চরণধ্বনি মহা-অন্ধকারে। বালকের কল্পনায় দেখেছিনু প্রতিধ্বনিলোক গুপ্ত আছে ব্রহ্মাণ্ডের অন্তরকন্দরে। সেথায় বিশ্বের ভাষা চতুর্দিক হতে নিত্য সম্মিলিত। সেথা হতে প্রতিধ্বনি নূতন সৃষ্টির ক্ষুধা লয়ে ফিরে দিকে দিকে। বহু যুগযুগান্তের বিশ্বনিখিলের ধ্বনিধারা নক্ষত্রে নক্ষত্রে ঠেকি আমাতে নিয়েছে আজি রূপ নিবিড় সংহত প্রতিধ্বনি। আজি শুধাইনু পুনরায়- আবার কি সূত্র তার ছিন্ন হয়ে যাবে, রূপহারা গতিবেগ চলে যাবে বহু কোটি বৎসরের শূন্যযাত্রাপথে ভেঙে ফেলে দিয়ে তার স্বল্প-আয়ূ বেদনার কমণ্ডুলু। কিন্তু কেন। |
'রাজপুতানা' কবিতাটির রচনা-প্রসঙ্গে শ্রীমতী মৈত্রেয়ী দেবীর
'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থ হইতে রবীন্দ্রনাথের কয়েক ছত্র উক্তি
উদ্ধৃত করা হইল-
... ঐ যে বইটা দিয়েছে না, স্টেট্স্ম্যানের 'সুন্দর ভারত', ওর
মধ্যে দেখেছিলাম রাজপুতানার ছবি। দেখেই মনে হল, হায় হায় এই কি
রাজপুতানা? মৃত্যুর বোঝা বহন ক'রে তবু বেঁচে আছে। এর চেয়ে তার
ধ্বংস ছিল ভালো। কোনো একরকমের জীবনের চাইতে মরণই মঙ্গল, মরণই
সম্মানের।
-মংপুতে রবীন্দ্রনাথ। প্রথম মুদ্রণ, পৃ ৩৭
১৩৪০ সালে বিহার-ভূমিকম্পের
দুর্গতদের সাহায্য-কল্পে প্রধানত প্রবোধেন্দুনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে
কলিকাতায় রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর অভিনয় হইয়াছিল। 'ভূমিকম্প'
কবিতাটি সেই উপলক্ষে রচিত ও প্রেরিত হয়।
মৌলানা জিয়াউদ্দিন বিশ্বভারতীর
বিদ্যাভবনে ইস্লামীয় সংস্কৃতির অধ্যাপক ছিলেন। তাঁহার অকালমৃত্যু
ঘটিলে শান্তিনিকেতনে শোকসভায় রবীন্দ্রনাথের যে ভাষণ প্রদত্ত হয়
তাহার অনুলিপি 'মৌলানা জিয়াউদ্দীন' কবিতার পরিপূরক-স্বরূপ ১৩৪৫
শ্রাবণের প্রবাসী হইতে নিম্নে মুদ্রিত হইল-
মৌলানা জিয়াউদ্দীন
আজকের দিনে একটা কোনো অনুষ্ঠানের সাহায্যে জিয়াউদ্দীন অকস্মাৎ
মৃত্যুতে আশ্রমবাসীদের কাছে বেদনা প্রকাশ করব, এ কথা ভাবতেও আমার
কুণ্ঠাবোধ হচ্ছে। যে অনুভুতি নিয়ে আমরা একত্র হয়েছি তার মূলকথা
কেবল কর্তব্যপালন নয়, এ অনুভুতি আরো অনেক গভীর।
জিয়াউদ্দীনের মৃত্যুতে যে স্থান শূন্য হল তা পূরণ করা সহজ হবে না,
কারণ তিনি সত্য ছিলেন। অনেকেই তো সংসারের পথে যাত্রা করে, কিন্তু
মৃত্যুর পরে চিহ্ন রেখে যায় এমন লোক খুব কমই মেলে। অধিকাংশ লোক
লঘুভাবে ভেসে যায় হালকা মেঘের মতো। জিয়াউদ্দীন সম্বন্ধে সে কথা বলা
চলে না; আমাদের হৃদয়ের মধ্যে তিনি যে স্থান পেয়েছেন তা নিশ্চিহ্ন
হয়ে একদিন একেবারে বিলীন হয়ে যাবে এ কথা ভাবতে পারি নে। কারণ, তাঁর
সত্তা ছিল সত্যের উপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। আশ্রম থেকে বাইরে
গিয়েছিলেন তিনি ছুটিতে, তাঁর এই ছুটিই যে শেষ ছুটি হবে অদৃষ্টের এই
নিষ্ঠুর লীলা মন মেনে নিতে চায় না। তিনি আজ পৃথিবীতে নেই সত্য,
কিন্তু তাঁর সত্তা ওতপ্রোত ভাবে আশ্রমের সব-কিছুর সঙ্গে মিশে রইল।
তিনি প্রথমে আশ্রমে এসেছিলেন বালক বয়সে ছাত্র হিসাবে, তখন হয়তো
তিনি ঠিক তেমন ক'রে মিশতে পারেন নি এই আশ্রমিক জীবনের সঙ্গে যেমন
পরিপূর্ণ ভাবে মিশেছিলেন পরবর্তী কালে। কেবল যে আশ্রমের সঙ্গে তাঁর
হৃদয় ও কর্মপ্রচেষ্টার সম্পূর্ণ যোগ হয়েছিল তা নয়, তাঁর সমস্ত
শক্তি এখানকার আবহাওয়ায় পরিণতি লাভ করেছিল। সকলের তা হয় না। যাঁরা
পরিণতির বীজ নিয়ে আসেন তাঁরাই কেবল আলো থেকে হাওয়া থেকে পরিপক্বতা
আহরণ করতে পারেন। এই আশ্রমের যা সত্য যা শ্রেষ্ঠ সেটুকু জিয়াউদ্দীন
এমনি করেই পেয়েছিলেন। এই শ্রেষ্ঠতা হল মানবিকতার, আর এই সত্য হল
আপনাকে সকলের মধ্যে প্রসারিত ক'রে দেবার শক্তি। ধর্মের দিক থেকে
এবং কর্মের দিকে অনেকের সঙ্গেই হয়তো তাঁর মূলগত প্রভেদ ছিল, কিন্তু
হৃদয়ের বিচ্ছেদ ছিল না। তাঁর চলে যাওয়ায় বিশ্বভারতীর কর্মক্ষেত্রে
যে বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল, সেটা পূরণ করা যাবে না। আশ্রমের মানবিকতার
ক্ষেত্রে তাঁর জায়গায় একটা শূন্যতা চিরকালের জন্যে রয়ে গেল। তাঁর
অকৃত্রিম অন্তরঙ্গতা, তাঁর মতো তেমনি ক'রে কাছে আসা অনেকের পক্ষে
সম্ভব হয় না, সংকোচ এসে পরিপূর্ণ সংযোগকে বাঁধা দেয়। কর্মের
ক্ষেত্রে যিনি কর্মী, হৃদয়ের দিক থেকে যিনি ছিলেন বন্ধু, আজ তাঁরই
অভাবে আশ্রমের দিক থেকে ও ব্যক্তিগত ভাবে আমরা একজন পরম সুহৃদ্কে
হারালাম।
প্রথমে বয়সে তাঁর মন বুদ্ধি ও
সাধনা যখন অপরিণত ছিল, তখন ধীরে ধীরে ক্রমপদক্ষেপে তিনি আশ্রমের
জীবনের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। এখন তাঁর সংযোগের পরিণতি
মধ্যাহ্নসূর্যের মতো দীপ্যমান হয়েছিল, আমরা তাঁর পূর্ণ বিকাশকে
শ্রদ্ধা করেছি এবং আশা ছিল আরো অনেক কিছু তিনি দিয়ে যাবেন। তিনি যে
বিদ্যার সাধনা গ্রহণ করেছিলেন সেই স্থান তেমন ক'রে আর কে নেবে;
আশ্রমের সকলের হৃদয়ে তিনি যে সৌহার্দের আসন পেয়েছেন সে আসন আর কী
ক'রে পূর্ণ হবে।
আজকের দিনে আমরা কেবল বৃথা শোক
করতে পারি। আমাদের আদর্শকে যিনি রূপ দান করেছিলেন তাঁকে অকালে
নিষ্ঠুরভাবে নেপথ্যে সরিয়ে দেওয়ায় মনে একটা অক্ষম বিদ্রোহের ভাব
আসতে পারে। কিন্তু আজ মনকে শান্ত করতে হবে এই ভেবে যে, তিনি যে
অকৃত্রিম মানবিকতার আদর্শ অনুসরণ ক'রে গেছেন সেটা বিশ্বভারতীতে
তাঁর শাশ্বত দান হয়ে রইল! তাঁর সুস্থ চরিত্রের সৌন্দর্য, সৌহার্দের
মাধুর্য ও হৃদয়ের গভীরতা তিনি আশ্রমকে দান ক'রে গেছেন, এটুকু
আমাদের পরম সৌভাগ্য। সকলকে তো আমরা আকর্ষণ করতে পারি না।
জিয়াউদ্দীনকে কেবল যে আশ্রম আকর্ষণ করেছিল তা নয়, এখানে তিনি তৈরী
হয়েছিলেন, এখানকার হাওয়া ও মাটির রসসম্পদে, এখানকার সৌহার্দে তাঁর
হৃদয়মন পরিপুষ্টি লাভ করেছিল। তিনি যে সম্পদ দিয়ে গেলেন তা আমাদের
মনে গাঁথা হয়ে রইবে, তাঁর দৃষ্টান্ত আমরা ভুলব না।
আমার নিজের দিক থেকে কেবল এই
কথাই বলতে পারি যে, এরকম বন্ধু দুর্লভ। এই বন্ধুত্বের অঙ্কুর একদিন
বিরাট মহীরুহ হয়ে তার সুশীতল ছায়ায় আমায় শান্তি দিয়েছে- এ আমার
জীবনে একটা চিরস্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকল। অন্তরে তাঁর সন্নিধির
উপলব্ধি থাকবে, বাইরের কথায় সে গভীর অনুভূতি প্রকাশ করা যাবে না।
শান্তিনিকেতন
৮।৭।৩৮
'ইস্টেশন' কবিতার কেবলমাত্র দীর্ঘতর স্তবকগুলি প্রথমে রচিত হয়।
পাণ্ডুলিপি অনুসারে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ উহা ১৯৩৭ সালের ২৯ মে
তারিখে আলমোড়ায় বাসকালে রচনা করেন। কবিতাটির গ্রন্থে মুদ্রিত তারিখ
ও স্থান, বলা বাহুল্য, শেষ সংশোধনের হিসাবে বসানো হইয়াছে। কবিতাটির
উক্ত প্রথম পাঠ পাণ্ডুলিপি হইতে নিম্নে উদ্ধৃত হইল-
|
ইস্টেশনে এ সংসারে পরে পরে ভিড় জমা হয় কত, খানিক বাদে ঘণ্টা বাজে কে কোথা হয় গত। এর পিছনে সুখদুঃখ ক্ষতিলাভের তাড়া দেয় সবল নাড়া। কিন্তু তাদের থাকায় আর কিছু নেই, ছবির পরে তারা ছবি আঁকায়। চিত্রকরের বিশ্বভূবনখানি। এই কথাটাই নিলেম মনে জানি- কর্মকারের নয় এ গড়া-পেটা আঁকড়ে ধরার জিনিস এ নয়, দেখার জিনিস এটা। কালের পরে যায় চলে কাল, হয় না কভু হারা ছবির বাহন চলাফেরার ধারা। দুবেলা সেই এ সংসারের চল্তি ছবি দেখা এই নিয়ে রও যাওয়া-আসার ইস্টেশনে একা। আলমোড়া ২৯ মে ১৯৩৭ |
'সাড়ে নটা' কবিতাটি সম্বন্ধে
'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' (প্রথম মুদ্রণ, পৃ ৯২-৯৩)
গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, সর্বপ্রথমে উহা সানাই গ্রন্থে মুদ্রিত
'মানসী' ('মনে নেই বুঝি হবে অগ্রহান মাস')-নামক কবিতার সহিত যুক্ত
আকারে রচিত হইয়াছিল এবং পরবর্তী সংশোধন ও পরিবর্তনের ফলে ক্রমে
বিচ্ছিন্ন হইয়া স্বতন্ত্র আকার লাভ করিয়াছে।
'অবর্জিত' কবিতাটি, প্রবাসী
পত্রে প্রকাশিত পাঠ অনুসারে, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের উদ্দেশে
উদ্দেশে রচিত হইয়াছিল। |