ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


নবজাতক

 


 

           কেন

    জ্যোতিষীরা বলে,
সবিতার আত্মদান-যজ্ঞের হোমাগ্নিবেদিতলে
    যে জ্যোতি উৎসর্গ হয় মহারুদ্রতপে
            এ বিশ্বের মন্দিরমণ্ডপে,
         অতিতুচ্ছ অংশ তার ঝরে
   পৃথিবীর অতিক্ষুদ্র মৃৎপাত্রের 'পরে।
           অবশিষ্ট অমেয় আলোকধারা
                   পথহারা,
              আদিম দিগন্ত হতে
      অক্লান্ত চলেছে ধেয়ে নিরুদ্দেশ স্রোতে।
সঙ্গে সঙ্গে ছুটিয়াছে অপার তিমির-তেপান্তরে
অসংখ্য নক্ষত্র হয়ে রশ্মিপ্লাবী নিরন্ত নির্ঝরে
             সর্বত্যাগী অপব্যয়,
    আপন সৃষ্টির ‘ পরে বিধাতার নির্মম অন্যায়।
কিংবা এ কি মহাকাল কল্পকল্পান্তের দিনে রাতে
এক হাতে দান ক ' রে ফিরে ফিরে নেয় অন্য হাতে।
     সঞ্চয়ে ও অপচয়ে যুগে যুগে কাড়াকাড়ি যেন

               কিন্তু, কেন ।

তার পরে চেয়ে দেখি মানুষের চৈতন্যজগতে
ভেসে চলে সুখদুঃখ কল্পনাভাবনা কত পথে।
       কোথাও বা জ্ব ' লে ওঠে জীবন-উৎসাহ,
            কোথাও বা সভ্যতার চিতাবহ্নিদাহ
      নিভে আসে নিঃস্বতার ভস্ম-অবশেষে।
            নির্ঝর ঝরিছে দেশে দেশে

লক্ষ্যহীন প্রাণস্রোতে মৃত্যুর গহ্বরে ঢালে মহী
    বাসনার বেদনার অজস্র বুদ‌্‌বুদ‌্ পুঞ্জ বহি।
            কে তার হিসাব রাখে লিখি।
                নিত্য নিত্য এমনি কি
     অফুরান আত্মহত্যা মানবসৃষ্টির
           নিরন্তর প্রলয়বৃষ্টির
                   অশ্রান্ত প্লাবনে।
          নিরর্থক হরণে ভরণে
    মানুষের চিত্ত নিয়ে সারাবেলা
মহাকাল করিতেছে দ্যূতখেলা
        বাঁ হাতে দক্ষিণ হাতে যেন

                কিন্তু, কেন।

প্রথম বয়সে কবে ভাবনার কী আঘাত লেগে
                 এ প্রশ্নই মনে উঠেছিল জেগে

      শুধায়েছি, এ বিশ্বের কোন্‌ কেন্দ্রস্থলে
                 মিলিতেছে প্রতি দণ্ডে পলে
         অরণ্যের পর্বতের সমুদ্রের উল্লোল গর্জন,
                    ঝটিকার মন্দ্রস্বন,
                               দিবসনিশার
   বেদনাবীণার তারে চেতনার মিশ্রিত ঝংকার,
                 পূর্ণ করি ঋতুর উৎসব
        জীবনের মরণের নিত্যকলরব,
                      আলোকের নিঃশব্দ চরণপাত
   নিয়ত স্পন্দিত করি দ্যুলোকের অস্তহীন রাত।
কল্পনায় দেখেছিনু, প্রতিধ্বনিমণ্ডল বিরাজে
            ব্রহ্মাণ্ডের অন্তরকন্দর-মাঝে।
                  সেথা বাঁধে বাসা
            চতুর্দিক হতে আসি জগতের পাখা-মেলা ভাষা।
সেথা হতে পুরানো স্মৃতিরে দীর্ণ করি
      সৃষ্টির আরম্ভবীজ লয় ভরি ভরি
           আপনার পক্ষপুটে ফিরে-চলা যত প্রতিধ্বনি।
                  অনুভব করেছি তখনি,
   বহু যুগযুগান্তের কোন্‌ এক বাণীধারা
            নক্ষত্রে নক্ষত্রে ঠেকি পথহারা
      সংহত হয়েছে অবশেষে
            মোর মাঝে এসে।
  প্রশ্ন মনে আসে আরবার,
        আবার কি ছিন্ন হয়ে যাবে সূত্র তার

               রূপহারা গতিবেগ প্রেতের জগতে
  চলে যাবে বহু কোটি বৎসরের শূন্য যাত্রাপথে ?
           উজাড় করিয়া দিবে তার
  পান্থের পাথেয়পত্র আপন স্বল্পায়ু বেদনার

          ভোজশেষে উচ্ছিষ্টের ভাঙা ভাণ্ড হেন ?
                    কিন্তু, কেন।

 

   শান্তিনিকেতন

৭ জানুয়ারি ১৯৩৮


                  হিন্দুস্থান
                মোরে হিন্দুস্থান
          বারবার করেছে আহ্বান
    কোন্‌ শিশুকাল হতে পশ্চিমদিগন্ত-পানে
ভারতের ভাগ্য যেথা নৃত্যলীলা করেছে শ্মশানে,
                   কালে কালে
            তাণ্ডবের তালে তালে,
                  দিল্লিতে আগ্রাতে
      মঞ্জীরঝংকার আর দূর শকুনির ধ্বনি-সাথে ;
               কালের মন্থনদণ্ডঘাতে
          উচ্ছলি উঠেছে যেথা পাথরের ফেনস্তূপে
     অদৃষ্টের অট্টহাস্য অভ্রভেদী প্রাসাদের রূপে।
          লক্ষ্মী-অলক্ষ্মীর দুই বিপরীত পথে
                     রথে প্রতিরথে
ধূলিতে ধূলিতে যেথা পাকে পাকে করেছে রচনা
    জটিল রেখার জালে শুভ-অশুভের আল্‌পনা।
          নব নব ধ্বজা হাতে নব নব সৈনিকবাহিনী
এক কাহিনীর সূত্র ছিন্ন করি আরেক কাহিনী
     বারংবার গ্রন্থি দিয়ে করেছে যোজন।
প্রাঙ্গণপ্রাচীর যার অকস্মাৎ করেছে লঙ্ঘন
                 দস্যুদল,
   অর্ধরাত্রে দ্বার ভেঙে জাগিয়েছে আর্ত কোলাহল,
              করেছে আসন-কাড়াকাড়ি,
       ক্ষুধিতের অন্নথালি নিয়েছে উজাড়ি ।
রাত্রিরে ভুলিল তারা ঐশ্বর্যের মশাল-আলোয়

    পীড়িত পীড়নকারী দোঁহে মিলি সাদায় কালোয়
         যেখানে রচিয়াছিল দ্যূতখেলাঘর,
অবশেষে সেথা আজ একমাত্র বিরাট কবর
                  প্রান্ত হতে প্রান্তে প্রসারিত;
     সেথা জয়ী আর পরাজিত
             একত্রে করেছে অবসান
     বহু শতাব্দীর যত মান অসম্মান।
ভগ্নজানু প্রতাপের ছায়া সেথা শীর্ণ যমুনায়
        প্রেতের আহ্বান বহি চলে যায়,
                 বলে যায়

আরো ছায়া ঘনাইছে অস্তদিগন্তের
        জীর্ণ যুগান্তের।

 

 শান্তিনিকেতন

১৯ এপ্রিল ১৯৩৭


         রাজপুতানা
    এই ছবি রাজপুতানার;
এ দেখি মৃত্যুর পৃষ্ঠে বেঁচে থাকিবার
         দুর্বিষহ বোঝা।
হতবুদ্ধি অতীতের এই যেন খোঁজা
    পথভ্রষ্ট বর্তমানে অর্থ আপনার,
          শূন্যেতে হারানো অধিকার।
ঐ তার গিরিদুর্গে অবরুদ্ধ নিরর্থ ভ্রূকুটি
         ঐ তার জয়স্তম্ভ তোলে ক্রুদ্ধ মুঠি
              বিরুদ্ধ ভাগ্যের পানে।
মৃত্যুতে করেছে গ্রাস তবুও যে মরিতে না জানে,
    ভোগ করে অসম্মান অকালের হাতে
                 দিনে রাতে,
            অসাড় অন্তরে
     গ্লানি অনুভব নাহি করে,
আপনারি চাটুবাক্যে আপনারে ভুলায় আশ্বাসে

              জানে না সে,
     পরিপূর্ণ কত শতাব্দীর পণ্যরথ
              উত্তীর্ণ না হতে পথ
     ভগ্নচক্র পড়ে আছে মরুর প্রান্তরে,
ম্রিয়মাণ আলোকের প্রহরে প্রহরে
         বেড়িয়াছে অন্ধ বিভাবরী
   নাগপাশে ; ভাষাভোলা ধূলির করুণা লাভ করি
           একমাত্র শান্তি তাহাদের।
   লঙ্ঘন যে করে নাই ভোলামনে কালের বাঁধের
              অন্তিম নিষেধসীমা

ভগ্নস্তূপে থাকে তার নামহীন প্রচ্ছন্ন মহিমা;
        জেগে থাকে কল্পনার ভিতে
   ইতিবৃত্তহারা তার ইতিহাস উদার ইঙ্গিতে।
কিন্তু এ নির্লজ্জ কারা! কালের উপেক্ষাদৃষ্টি-কাছে
      না থেকেও তবু আছে ।
         একি আত্মবিস্মরণমোহ,
   বীর্যহীন ভিত্তি- 'পরে কেন রচে শূন্য সমারোহ।
        রাজ্যহীন সিংহাসনে অত্যুক্তির রাজা,
                বিধাতার সাজা।

             হোথা যারা মাটি করে চাষ
     রৌদ্রবৃষ্টি শিরে ধরি বারো মাস,
             ওরা কভু আধামিথ্যা রূপে
     সত্যেরে তো হানে না বিদ্রূপে।
            ওরা আছে নিজ স্থান পেয়ে;
   দারিদ্র্যের মূল্য বেশি লুপ্তমূল্য ঐশ্বর্যের চেয়ে।

এদিকে চাহিয়া দেখো টিটাগড়।
    লোষ্ট্রে লৌহে বন্দী হেথা কালবৈশাখীর পণ্যঝড়।
          বণিকের দম্ভে নাই বাধা,
    আসমুদ্র পৃথ্বীতলে দৃপ্ত তার অক্ষুণ্ন মর্যাদা ।
             প্রয়োজন নাহি জানে ওরা
                 ভূষণে সাজায়ে হাতিঘোড়া
                      সম্মানের ভান করিবার,
    ভুলাইতে ছদ্মবেশী সমুচ্চ তুচ্ছতা আপনার ।
শেষের পংক্তিতে যবে থামিবে ওদের ভাগ্যলিখা,
              নামিবে অন্তিম যবনিকা,
    উত্তাল রজতপিণ্ড-উদ্ধারের শেষ হবে পালা,
           যন্ত্রের কিঙ্করগুলো নিয়ে ভস্মডালা
                   লুপ্ত হবে নেপথ্যে যখন,
পশ্চাতে যাবে না রেখে প্রেতের প্রগল্‌ভ প্রহসন।

      উদাত্ত যুগের রথে বল্গাধরা সে রাজপুতানা
          মরুপ্রস্তরের স্তরে একদিন দিল মুষ্টি হানা;
              তুলিল উদ্ভেদ করি কলোল্লোলে মহা-ইতিহাস
প্রাণে উচ্ছ্বসিত, মৃত্যুতে ফেনিল ; তারি তপ্তশ্বাস
    স্পর্শ দেয় মনে, রক্ত উঠে আবর্তিয়া বুকে

               সে যুগের সুদূর সম্মুখে
    স্তব্ধ হয়ে ভুলি এই কৃপণ কালের দৈন্যপাশে
        জর্জরিত, নতশির অদৃষ্টের অট্ট হাসে,
        গলবদ্ধ পশুশ্রেণীসম চলে দিন পরে দিন
                   লজ্জাহীন।
           জীবনমৃত্যুর দ্বন্দ্ব-মাঝে
   সেদিন যে দুন্দুভি মন্দ্রিয়াছিল তার প্রতিধ্বনি বাজে
        প্রাণের কুহরে গুমরিয়া। নির্ভয় দুর্দান্ত খেলা,
    মনে হয়, সেই তো সহজ, দূরে নিক্ষেপিয়া ফেলা
আপনারে নিঃসংশয় নিষ্ঠুর সংকটে। তুচ্ছ প্রাণ
     নহে তো সহজ ; মৃত্যুর বেদিতে যার কোনো দান
নাই কোনো কালে সেই তো দুর্ভর অতি,
    আপনার সঙ্গে নিত্য বাল্যপনা দুঃসহ দুর্গতি।
প্রচণ্ড সত্যেরে ভেঙে গল্পে রচে অলস কল্পনা
              নিষ্কর্মার স্বাদু উত্তেজনা,
      নাট্যমঞ্চে ব্যঙ্গ করি বীরসাজে
তারস্বর আস্ফালনে উন্মত্ততা করে কোন্‌ লাজে।
         তাই ভাবি হে রাজপুতানা,
   কেন তুমি মানিলে না যথাকালে প্রলয়ের মানা,
        লভিলে না বিনষ্টির শেষ স্বর্গলোক;
            জনতার চোখ
                 দীপ্তিহীন
    কৌতুকের দৃষ্টিপাতে পলে পলে করে যে মলিন।
           শঙ্করের তৃতীয় নয়ন হতে
    সম্মান নিলে না কেন যুগান্তের বহ্নির আলোতে।

 

মংপু

২২ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৫
 

                     ভাগ্যরাজ্য
আমার এ ভাগ্যরাজ্যে পুরানো কালের যে প্রদেশ,
       আয়ুহারাদের ভগ্নশেষ
           সেথা পড়ে আছে
                পূর্বদিগন্তের কাছে।
নিঃশেষ করেছে মূল্য সংসারের হাটে,
     অনাবশ্যকের ভাঙা ঘাটে
          জীর্ণ দিন কাটাইছে তারা
               অর্থহারা।
ভগ্ন গৃহে লগ্ন ঐ অর্ধেক প্রাচীর;
    আশাহীন পূর্ব আসক্তির
          কাঙাল শিকড়জাল
বৃথা আঁকড়িয়া ধরে প্রাণপণে বর্তমান কাল।
    আকাশে তাকায় শিলালেখ,
         তাহার প্রত্যেক
    অস্পষ্ট অক্ষর আজ পাশের অক্ষরে
          ক্লান্ত সুরে প্রশ্ন করে,
   
"আরো কি রয়েছে বাকি কোনো কথা,
          শেষ হয়ে যায় নি বারতা।"

এ আমার ভাগ্যরাজ্যে অন্যত্র হোথায় দিগন্তরে
           অসংলগ্ন ভিত্তি- 'পরে
                    করে আছে চুপ
অসমাপ্ত আকাঙ্ক্ষার অসম্পূর্ণ রূপ।
           অকথিত বাণীর ইঙ্গিতে
                   চারিভিতে
          নীরবতা-উৎকণ্ঠিত মুখ
                  রয়েছে উৎসুক।
একদা যে যাত্রীদের সংকল্পে ঘটেছে অপঘাত,
          অন্য পথে গেছে অকস্মাৎ,
               তাদের চকিত আশা,
          স্থকিত চলার স্তব্ধ ভাষা
                 জানায়, হয় নি চলা সারা

দুরাশার দূরতীর্থ আজো নিত্য করিছে ইশারা।
        আজিও কালের সভা-মাঝে
                 তাদের প্রথম সাজে
        পড়ে নাই জীর্ণতার দাগ,
লক্ষ্যচ্যুত কামনায় রয়েছে আদিম রক্তরাগ।
        কিছু শেষ করা হয় নাই,
                হেরো, তাই
সময় যে পেল না নবীন
                কোনোদিন
        পুরাতন হতে
 
শৈবালে ঢাকে নি তারে বাঁধা-পড়া ঘাটে-লাগা স্রোতে;
        স্মৃতির বেদনা কিছু, কিছু পরিতাপ,
                কিছু অপ্রাপ্তির অভিশাপ
            তারে নিত্য রেখেছে উজ্জ্বল;
না দেয় নীরস হতে মজ্জাগত গুপ্ত অশ্রুজল।
                  যাত্রাপথ-পাশে
        আছ তুমি আধো-ঢাকা ঘাসে

পাথরে খুদিতেছিনু, হে মূর্তি, তোমারে কোন্‌ ক্ষণে
               কিসের কল্পনে।
    অপূর্ণ তোমার কাছে পা ই না উত্তর।
           মনে যে কী ছিল মোর
যেদিন ফুটিত তাহা শিল্পের সম্পূর্ণ সাধনাতে
                শেষ-রেখাপাতে,
          সেদিন তা জানিতাম আমি;
               তার আগে চেষ্টা গেছে থামি।
                       সেই শেষ না-জানার
     নিত্য নিরুত্তরখানি মর্ম-মাঝে রয়েছে আমার;
                   স্বপ্নে তার প্রতিবিম্ব ফেলি
সচকিত আলোকের কটাক্ষে সে করিতেছে কেলি।

  আলমোড়া

৬ মে ১৯৩৭

 

                     ভূমিকম্প
হায় ধরিত্রী, তোমার আঁধার পাতালদেশে
অন্ধ রিপু লুকিয়েছিল ছদ্মবেশে

       সোনার পুঞ্জ যেথায় রাখ,
       আঁচলতলে যেথায় ঢাক
কঠিন লৌহ, মৃত্যুদূতের চরণধূলির
       পিণ্ড তারা, খেলা জোগায়
             যমালয়ের ডাণ্ডাগুলির।

উপর তলায় হাওয়ার দোলায় নবীন ধানে
ধানশ্রীসুর মূর্ছনা দেয় সবুজ গানে।
        দুঃখে সুখে স্নেহে প্রেমে
        স্বর্গ আসে মর্তে নেমে,
ঋতুর ডালি ফুল-ফসলের অর্ঘ্য বিলায়,
        ওড়না রাঙে ধূপছায়াতে
             প্রাণনটিনীর নৃত্যলীলায়।

অন্তরে তোর গুপ্ত যে পাপ রাখলি চেপে
তার ঢাকা আজ স্তরে স্তরে উঠল কেঁপে।
        যে বিশ্বাসের আবাসখানি
        ধ্রুব বলেই সবাই জানি
এক নিমেষে মিশিয়ে দিলি ধূলির সাথে,
       প্রাণের দারুণ অবমানন
             ঘটিয়ে দিলি জড়ের হাতে।

বিপুল প্রতাপ থাক্‌-না যতই বাহির দিকে
কেবল সেটা স্পর্ধাবলে রয় না টিঁকে।
      দুর্বলতা কুটিল হেসে
      ফাটল ধরায় তলায় এসে

হঠাৎ কখন দিগ্‌ব্যাপিনী কীর্তি যত
      দর্পহারীর অট্টহাস্যে
           যায় মিলিয়ে স্বপ্নমতো।

হে ধরণী, এই ইতিহাস সহস্রবার
যুগে যুগে উদঘাটিলে সামনে সবার।
           জাগল দম্ভ বিরাট রূপে,
           মজ্জায় তার চুপে চুপে
     লাগল রিপুর অলক্ষ্য বিষ সর্বনাশা

           রূপক নাট্যে ব্যাখ্যা তারি
                দিয়েছ আজ ভীষণ ভাষায়।

যে যথার্থ শক্তি সে তো শান্তিময়ী,
সৌম্য তাহার কল্যাণরূপ বিশ্বজয়ী।
          অশক্তি তার আসন পেতে
          ছিল তোমার অন্তরেতে

    সেই তো ভীষণ, নিষ্ঠুর তার বীভৎসতা,
          নিজের মধ্যে প্রতিষ্ঠাহীন
              তাই সে এমন হিংসারতা।

৬ চৈত্র ১৩৪০


             
পক্ষীমানব
যন্ত্রদানব, মানবে করিলে পাখি।
     স্থল জল যত তার পদানত
           আকাশ আছিল বাকি।
বিধাতার দান পাখিদের ডানাদুটি
 
     রঙের রেখায় চিত্রলেখায়
         আনন্দ উঠে ফুটি;
তারা যে রঙিন পান্থা মেঘের সাথি।
     নীল গগনের মহাপবনের
        যেন তারা একজাতি।
তাহাদের লীলা বায়ুর ছন্দে বাঁধা;
    তাহাদের প্রাণ, তাহাদের গান
         আকাশের সুরে সাধা;
তাই প্রতিদিন ধরণীর বনে বনে
     আলোক জাগিলে একতানে মিলে
         তাহাদের জাগরণে।
মহাকাশতলে যে মহাশান্তি আছে
    তাহাতে লহরী কাঁপে থরথরি
        তাদের পাখার নাচে।

যুগে যুগে তারা গগনের পথে পথে
    জীবনের বাণী দিয়েছিল আনি
         অরণ্যে পর্বতে;
আজি একি হল, অর্থ কে তার জানে।
     স্পর্ধা পতাকা মেলিয়াছে পাখা
          শক্তির অভিমানে।
তারে প্রাণদেব করে নি আশীর্বাদ।
     তাহারে আপন করে নি তপন,
         মানে নি তাহারে চাঁদ।
আকাশের সাথে অমিল প্রচার করি
     কর্কশ স্বরে গর্জন করে
          বাতাসেরে জর্জরি।
আজি মানুষের কলুষিত ইতিহাসে
    উঠি মেঘলোকে স্বর্গ-আলোকে
           হানিছে অট্টহাসে।
যুগান্ত এল বুঝিলাম অনুমানে

     অশান্তি আজ উদ্যত বাজ
           কোথাও না বাধা মানে;
ঈর্ষা হিংসা জ্বালি মৃত্যুর শিখা
     আকাশে আকাশে বিরাট বিনাশে
            জাগাইল বিভীষিকা।
দেবতা যেথায় পাতিবে আসনখানি
    যদি তার ঠাঁই কোনোখানে নাই
           তবে, হে বজ্রপাণি,
এ ইতিহাসের শেষ অধ্যায়তলে
    রুদ্রের বাণী দিক দাঁড়ি টানি
          প্রলয়ের রোষানলে।

আর্ত ধরার এই প্রার্থনা শুন
 
     শ্যামবনবীথি পাখিদের গীতি
            সার্থক হোক পুন।

 

২৫ ফাল্গুন ১৩৩৮