ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
পথের সঞ্চয়
যাত্রার পূর্বপত্র
|
বোম্বাই
শহর
|
জলস্থল
|
সমুদ্রপাড়ি
|
যাত্রা
|
আনন্দরূপ
|
দুই ইচ্ছা
|
অন্তর বাহির |
খেলা ও
কাজ
|
লণ্ডনে
|
বন্ধু
|
কবি
য়েট্স্
|
স্টপ্ফোর্ড্
ব্রুক
|
ইংলণ্ডের ভাবুক সমাজ
|
ইংলণ্ডের পল্লীগ্রাম ও পাদ্রি
|
সংগীত
|
সমাজভেদ
|
সীমার সার্থকতা
|
সীমা ও অসীমতা
|
শিক্ষাবিধি
|
লক্ষ্য ও
শিক্ষা
|
আমেরিকার
চিঠি
|
ভূমধ্য-সাগরের প্রথম ঘাট পোর্ট-সৈয়দ।
এইখান হইতে আমাদিগকে য়ুরোপের পারে পাড়ি দিতে হইবে। সন্ধ্যার সময় আমরা বন্দরে
পৌঁছিলাম। শহরের বাতায়নগুলিতে তখন আলো জ্বলিয়াছে। আরোহীদিগকে ডাঙায় পৌঁছাইয়া দিবার
জন্য ছোটো ছোটো নৌকা এবং মোটর-বোট ঝাঁকে ঝাঁকে চারি দিকে আসিয়া আমাদের জাহাজ
ঘিরিয়াছে। পোর্ট-সৈয়দের দোকান-বাজার ঘুরিবার জন্য অনেকেই সেখানে নামিলেন। আমি সেই
ভিড়ের মধ্যে নামিলাম না। জাহাজের রেলিঙ ধরিয়া দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিলাম। অন্ধকার
সমুদ্র এবং অন্ধকার আকাশ–
দুইয়ের সংগমস্থলে অল্প একটুখানি জায়গায় মানুষ আপনার আলো কয়টি জ্বালাইয়া রাত্রিকে
একেবারে অস্বীকার করিয়া বসিয়াছে।
পোর্ট-সৈয়দে অনেকগুলি নূতন আরোহী
উঠিবার কথা। পুরাতনের দল এই সংবাদে বিশেষ ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে। আর-সমস্ত নূতনকে
মানুষ খুঁজিয়া বাহির করে, কিন্তু নূতন মানুষ! এমন উদ্বেগের বিষয় আর-কিছুই নাই। সে
কাছে আসিলে তাহার সঙ্গে ভিতরে বাহিরে বোঝাপড়া করিয়া লইতেই হইবে। সে তো কেবলমাত্র
কৌতূহলের বিষয় নহে। তাহার মন লইয়া সে অন্যের মনকে ঠেলাঠেলি করে। মানুষের ভিড়ের মতো
এমন ভিড় আর নাই।
পোর্ট-সৈয়দে যাহারা জাহাজে চড়িল
তাহারা প্রায় সকলেই ফরাসি। আমাদের ডেক এখন মানুষে মানুষে ভরিয়া গিয়াছে। এখন
পরস্পরের দেহতরী বাঁচাইয়া চলিতে হইলে রীতিমতো মাঝিগিরির প্রয়োজন হয়।
সকাল হইতে রাত্রি দশটা পর্যন্ত ডেকের
উপর য়ুরোপীয় নরনারীদের প্রতিদিনের কালযাপন আমি আরও কয়েকবার দেখিয়াছি, এবারও
দেখিতেছি। প্রথমটা চোখে পড়ে, ইহারা সর্বদাই চঞ্চল হইয়া আছে। এতটা চাঞ্চল্য আমাদের
অভ্যস্ত নহে। আমাদের গরম দেশে আমরা কোনোমতে ঠাণ্ডা থাকিতে চাই–
চোখের সামনে অন্য কেহ অস্থিরতা প্রকাশ করিলেও আমাদের গরম বোধ হয়।
'চুপ করো, স্থির থাকো, মিছামিছি কাজ বাড়াইয়ো না'
ইহাই আমাদের সমস্ত দেশের অনুশাসন। আর ইহারা কেবলই বলে, 'একটা-কিছু
করা যাক।' এইজন্য ইহারা ছেলে বুড়া সকলে মিলিয়া কেবলই
দাপাদাপি করিতেছে। হাসি গল্প খেলা আমোদের বিরাম নাই, অবসান নাই।
অভ্যাসের বাধা সরাইয়া দিয়া আমি যখন
এই দৃশ্য দেখি আমার মনে হয়, আমি যেন বাহ্য প্রকৃতির একটা লীলা দেখিতেছি। যেন ঝরনা
ঝরিতেছে, যেন নদী চলিতেছে, যেন গাছপালা বাতাসে মাতামাতি করিতেছে। আপনার সমস্ত
প্রয়োজন সারিয়াও প্রাণের বেগ আপনাকে নিঃশেষ করিতে পারিতেছে না; তখন সে আপনার সেই
উদ্বৃত্ত প্রাচুর্যের দ্বারা আপনাকেই আপনি প্রকাশ করিতেছে।
আমরা যখন ছোটো ছেলেকে কোথাও সঙ্গে
করিয়া লইয়া যাই, তখন কিছু খেলনার আয়োজন রাখি; নহিলে তাহাকে শান্ত রাখা শক্ত হয়।
কেননা, তাহার প্রাণের স্রোত তাহার প্রয়োজনের সীমাকে ছাপাইয়া চলিয়াছে। সেই উচ্ছলিত
প্রাণের বেগ আপনার লীলার উপকরণ না পাইলে অধীর হইয়া উঠে। এইজন্যই ছেলেদের বিনা কারণে
ছুটাছুটি করিতে হয়, তাহারা যে চেঁচামেচি করে তাহার কোনো অর্থই নাই এবং তাহাদের খেলা
দেখিলে বিজ্ঞ ব্যক্তির হাসি আসে এবং কাহারও কাহারও বিরক্তি বোধ হয়। কিন্তু, তাহাদের
এই খেলার উৎপাত আমাদের পক্ষে যত বড়ো উপদ্রব হউক, খেলা বন্ধ করিলে উপদ্রব আরও গুরুতর
হইয়া উঠে সন্দেহ নাই।
এই-যে য়ুরোপীয় যাত্রীরা জাহাজে
চড়িয়াছে, ইহাদের জন্যও কতরকম খেলার আয়োজন রাখিতে হইয়াছে তাহার আর সংখ্যা নাই।
আমাদের যদি জাহাজ থাকিত তাহা হইলে তাস পাশা প্রভৃতি অত্যন্ত ঠাণ্ডা খেলা ছাড়া
এ-সমস্ত দৌড়ধাপের খেলার ব্যবস্থা করার দিকে আমরা দৃক্পাতমাত্র করিতাম না। বিশেষত
কয়দিনের জন্য পথ চলার মুখে এ-সমস্ত অনাবশ্যক বোঝা নিশ্চয়ই বর্জন করিতাম এবং কেহ
তাহাতে কিছু মনেও করিত না।
কিন্তু, য়ুরোপীয় যাত্রীদিগকে ঠাণ্ডা
রাখিবার জন্য খেলা চাই। তাহাদের প্রাণের বেগের মধ্যে প্রাত্যহিক ব্যবহারের অতিরিক্ত
মস্ত একটা পরিশিষ্ট ভাগ আছে, তাহাকে চুপ করিয়া বসাইয়া রাখিবে কে! তাহাকে নিয়ত
ব্যাপৃত রাখা চাই। এইজন্য খেলনার পর খেলনা জোগাইতে হয় এবং খেলার পর খেলা সৃষ্টি
করিয়া তাহাকে ভুলাইয়া রাখার প্রয়োজন।
তাই দেখি, ইহারা ছেলেবুড়ো কেবলই
ছট্ফট্ এবং মাতামাতি করিতেছে। সেটা আমাদের পক্ষে একেবারেই অনাবশ্যক বলিয়া প্রথমটা
কেমন অদ্ভুত ঠেকে। মনে ভাবি, বয়স্ক লোকের পক্ষে এ-সমস্ত ছেলেমানুষি নিরর্থক অসংযমের
পরিচয়মাত্র। ছেলেদের খেলার বয়স বলিয়াই খেলা তাহাদিগকে শোভা পায়; কাজের বয়সে এতটা
খেলার উৎসাহ অত্যন্ত অসংগত।
কিন্তু, যখন নিশ্চয় বুঝিতে পারি
য়ুরোপীয়ের পক্ষে এই চাঞ্চল্য এবং খেলার উদ্যম নিতান্তই স্বভাবসংগত, তখন ইহার একটি
শোভনতা দেখিতে পাই। ইহা যেন বসন্তকালের অনাবশ্যক প্রাচুর্যের মতো। যত ফল ধরিবে
তাহার চেয়ে অনেক বেশি মুকুল ধরিয়াছে। কিন্তু, এই অনাবশ্যক ঐশ্বর্য না থাকিলে
আবশ্যকে পদে পদে কৃপণতা ঘটিত।
ইহাদের খেলার মধ্যে কিছুমাত্র লজ্জার
বিষয় নাই। কেননা, এই খেলা অলসের কালযাপন নহে; কেননা, আমরা দেখিয়াছি, ইহাদের প্রাণের
শক্তি কেবলমাত্র খেলা করে না। কর্মক্ষেত্রে এই শক্তির নিরলস উদ্যম, ইহার অপ্রতিহত
প্রভাব। কী আশ্চর্য ক্ষমতার সঙ্গে ইহারা সমস্ত পৃথিবী জুড়িয়া বিপুল কর্মজাল বিস্তার
করিয়াছে, তাহা ভাবিয়া দেখিলে স্তম্ভিত হইতে হয়। তাহার পশ্চাতে শরীর ও মনের কী
অপরিমিত অধ্যবসায় নিযুক্ত। সেখানে কোথাও কিছুমাত্র জড়ত্ব নাই, শৈথিল্য নাই; সতর্কতা
সর্বদা জাগ্রত; সুযোগের তিলমাত্র অপব্যয় দেখা যায় না।
যে শক্তি কর্মের উদ্যোগে আপনাকে
সর্বদা প্রবাহিত করিতেছে সেই শক্তিই খেলার চাঞ্চল্যে আপনাকে তরঙ্গিত করিতেছে।
শক্তির এই প্রাচুর্যকে বিজ্ঞের মতো অবজ্ঞা করিতে পারি না। ইহাই মানুষের ঐশ্বর্যকে
নব নব সৃষ্টির মধ্যে বিস্তার করিয়া চলিয়াছে। ইহা নিজেকে দিকে দিকে অনায়াসে অজস্র
ত্যাগ করিতেছে, সেইজন্যই নিজেকে বহুগুণে ফিরিয়া পাইতেছে। ইহাই সাম্রাজ্যে বাণিজ্যে
বিজ্ঞানে সাহিত্যে কোথাও কোনো সীমা মানিতেছে না, দুর্লভের রুদ্ধ দ্বারে অহোরাত্র
প্রবল বেগে আঘাত করিতেছে।
এই-যে উদ্যত শক্তি, যাহার এক দিকে
ক্রীড়া ও অন্য দিকে কর্ম, ইহাই যথার্থ সুন্দর। রমণীর মধ্যে যেখানে আমরা লক্ষ্মীর
প্রকাশ দেখিতে পাই সেখানে আমরা এক দিকে দেখি সাজসজ্জা লীলামাধুর্য, আর-এক দিকে দেখি
অক্লান্ত কর্মপরতা ও সেবানৈপুণ্য। এই উভয়ের বিচ্ছেদই কুশ্রী। বস্তুত, শক্তিই
সৌন্দর্যরূপে আপনাকে প্রকাশ করে, আর শক্তিহীনতাই শৈথিল্য ও অব্যবস্থার মধ্য দিয়া
কেবলই কদর্যতার পঙ্কের মধ্যে আপনাকে নিমগ্ন করে। কদর্যতাই মানুষের শক্তির পরাভব;
এইখানেই অস্বাস্থ্য, দারিদ্র্য, অন্ধসংস্কার; এইখানেই মানুষ বলে,
'আমি হাল ছাড়িয়া দিলাম, এখন অদৃষ্টে যাহা করে!'
এইখানেই পরস্পরে কেবল বিচ্ছেদ ঘটে,আরব্ধ কর্ম শেষ হয় না, এবং যাহাই গড়িয়া তুলিতে
চাই তাহাই বিশ্লিষ্ট হইয়া পড়ে। শক্তিহীনতাই যথার্থ শ্রীহীনতা।
আমি জাহাজের ডেকের উপরে ইহাদের
প্রচুর আমোদ-আহ্লাদের মধ্যেও ইহাই দেখিতে পাই। ইহাদের সমস্ত খেলাধুলার ভিতরে ভিতরে
স্বভাবতই একটি বিধান দেখা দেয়। এইজন্য ইহাদের আমোদ-প্রমোদও কোনোমতে বিশৃঙ্খল হইয়া
উঠে না। যথাসময়ে যথাবিহিতভদ্রবেশ প্রত্যেকেই পরিয়া আসিতে হয়। পরস্পরের সঙ্গে
আলাপ-পরিচয়ের ভিতরে ভিতরে নিয়ম প্রচ্ছন্ন আছে; সেই নিয়মের সীমা লঙ্ঘন করিবার জো
নাই। বিধানের উপরে নির্ভর করিয়া থাকে বলিয়াই ইহাদের আমোদ-আহ্লাদ এমন উচ্ছ্বসিত
প্রবল বেগে বিপত্তি বাঁচাইয়া প্রবাহিত হইতে পারে।
এই ডেকের উপর আর কেহ নহে, কেবল
আমাদের দেশের লোকে মিলিত হইয়াছে, সে দৃশ্য আমি মনে মনে কল্পনা না করিয়া থাকিতে পারি
না। প্রথমেই দেখা যাইত, কোনো একই ব্যবস্থা দুইজনের মধ্যে খাটিত না। আমাদের অভ্যাস ও
আচরণ পরস্পরের সঙ্গে আপনার মিল করিতে জানে না। য়ুরোপীয়দের মধ্যে একটা জায়গা আছে
সেখানে ইহারা স্বতন্ত্র, আর-একটা জায়গা আছে যেখানে ইহারা সকলের। যেখানে ইহারা
স্বতন্ত্র সে জায়গাটা ইহাদের প্রাইভেট। সেখানটা প্রচ্ছন্ন। সেখানে সকলের অবারিত
অধিকার নাই এবং সেই অনধিকারকে সকলেই সহজেই মানিয়া চলে। সেখানে তাহারা নিজের ইচ্ছা ও
অভ্যাস-অনুসারে আপনার ব্যক্তিগত জীবন বহন করে। কিন্তু, যখনই সেখান হইতে তাহারা
বাহির হইয়া আসে তখনই সকলের বিধানের মধ্যে ধরা দেয়করিয়া থাকিতে পারি না। প্রথমেই
দেখা যাইত, কোনো একই ব্যবস্থা দুইজনের মধ্যে খাটিত না। আমাদের অভ্যাস ও আচরণ
পরস্পরের সঙ্গে আপনার মিল করিতে জানে না। য়ুরোপীয়দের মধ্যে একটা জায়গা আছে সেখানে
ইহারা স্বতন্ত্র, আর-একটা জায়গা আছে যেখানে ইহারা সকলের। যেখানে ইহারা স্বতন্ত্র সে
জায়গাটা ইহাদের প্রাইভেট। সেখানটা প্রচ্ছন্ন। সেখানে সকলের অবারিত অধিকার নাই এবং
সেই অনধিকারকে সকলেই সহজেই মানিয়া চলে। সেখানে তাহারা নিজের ইচ্ছা ও অভ্যাস-অনুসারে
আপনার ব্যক্তিগত জীবন বহন করে। কিন্তু, যখনই সেখান হইতে তাহারা বাহির হইয়া আসে তখনই
সকলের বিধানের মধ্যে ধরা দেয়–
সে জায়গায় কোনোমতেই তাহারা আপনার প্রাইভেটকে টানিয়া আনে না। এই দুই বিভাগ সুস্পষ্ট
থাকতেই পরস্পর মেলামেশা ইহাদের পক্ষে এত সহজ ও সুশৃঙ্খল। আমাদের মধ্যে এই বিভাগ নাই
বলিয়া সমস্ত এলোমেলো হইয়া যায়, কেহ কোনোখানে সীমা মানিতে চায় না। আমরা এই ডেক পাইলে
নিজের প্রয়োজন-মতো চলিতাম। পোঁটলা-পুঁটলি যেখানে সেখানে ছড়াইয়া রাখিতাম। কেহ বা
দাঁতন করিতাম, কেহ বা যেখানে খুশি বিছানা পাতিয়া পথ রোধ করিয়া নিদ্রা দিতাম, কেহ বা
হুঁকার জল ফিরাইতাম ও কলিকাটা উপুড় করিয়া ছাই ও পোড়া তামাক যেখানে হোক একটা জায়গা
ঢালিয়া দিতাম, কেহ বা চাকরকে দিয়া শরীর দলাইয়া সশব্দে তেল মাখিতে থাকিতাম। ঘটিবাটি
জিনিসপত্র কোথায় কী পড়িয়া থাকিত তাহার ঠিকানা পাওয়া যাইত না, এবং ডাকাডাকি
হাঁকাহাঁকির অন্ত থাকিত না। ইহার মধ্যে যদি কেহ নিয়ম ও শৃঙ্খলা আনিতে চেষ্টামাত্র
করিত তাহা হইলে অত্যন্ত অপমান বোধ করিতাম এবং মহা রাগারাগির পালা পড়িয়া যাইত। তাহার
পরে অন্য লোকের যে লেখাপড়া কাজকর্ম থাকিতে পারে, কিম্বা মাঝে মাঝে সে তাহার অবসর
ইচ্ছা করিতে পারে, সে সম্বন্ধে কাহারও চিন্তামাত্রা থাকিত না–
হঠাৎ দেখা যাইত, যে বইটা পড়িতেছিলাম সেটা আর-একজন টানিয়া লইয়া পড়িতেছে; আমার
দূরবীনটা পাঁচজনের হাতে হাতে ফিরিতেছে, সেটা আমার হাতে ফিরাইয়া দিবার কোনো তাগিদ
নাই; অনায়াসেই আমার টেবিলের উপর হইতে আমার খাতাটা লইয়া কেহ টানিয়া দেখিতেছে, বিনা
আহ্বানে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া গল্প জুড়িয়া দিতেছে, এবং রসিক ব্যক্তি সময় অসময়
বিচার না করিয়া উচ্চৈঃস্বরে গান গাহিতেছে, কণ্ঠে স্বরমাধুর্যের অভাব থাকিলেও
কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করিতেছে না। যেখানে যেটা পড়িত সেখানে সেটা পড়িয়াই থাকিত। যদি
ফল খাইতাম তবে তাহার খোসা ও বিচি ডেকের উপরেই ছড়ানো থাকিত, এবং ঘটিবাটি চাদর মোজা
গলাবন্দ হাজার বার করিয়া খোঁজাখুঁজি করিতে করিতেই দিন কাটিয়া যাইত।
ইহাতে যে কেবল পরস্পরের অসুবিধা ঘটিত
তাহা নহে, সুখ স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য চারি দিকে হইতে অন্তর্ধান করিত। ইহাতে
আমোদ-আহ্লাদও অব্যাহত হইত না এবং কাজকর্মের তো কথাই নাই। যে শক্তি কর্মের মধ্যে
নিয়মকে মানিয়া সফল হয় সেই শক্তিই আমোদ-আহ্লাদের মধ্যেও নিয়মকে রক্ষা করিয়া তাহাকে
সরস ও সুন্দর করিয়া তোলে। যোদ্ধা যেমন স্বভাবতই আপনার তলোয়ারকে ভালোবাসিয়া ধারণ
করে, শক্তিমান তেমনি স্বভাবতই নিয়মকে আন্তরিক প্রীতির সহিত রক্ষা করে। কারণ, ইহাই
তাহার অস্ত্র; শক্তি যদি নিয়মকে না মানে তবে আপনাকেই ব্যর্থ করে।
শক্তি এই-যে নিয়মকে মানে সে কেবল
নিয়মকে মানিবার জন্য নহে, আপনাকেই মানিবার জন্য। আর, শক্তিহীনতা যখন নিয়মকে মানে
তখন সে নিয়মকেই মানে; তখন সে ভয়ে হোক, লোভে হোক, বা কেবলমাত্র চিরাভ্যাসের
জড়ত্ব-বশত হোক, নিয়মকে নতজানু হইয়া শিরোধার্য করিয়া লয়। কিন্তু যেখানে সে বাধ্য
নয়,যেখানে কেবল নিজের খাতিরেই নিয়ম স্বীকার করিতে হয়, দুর্বলতা সেইখানেই নিয়মকে
ফাঁকি দিয়া নিজেকে ফাঁকি দেয়। সেখানেই তাহার সমস্ত কুশ্রী ও যদৃচ্ছাকৃত।
যে দেশে মানুষকে বাহিরের শাসন চালনা করিয়া আসিয়াছে, যেখানেই মানুষের স্বাধীন
শক্তিকে মানুষ শ্রদ্ধা করে নাই এবং রাজা গুরু ও শাস্ত্র বিনা যুক্তিতে মানুষকে
তাহার হিতসাধনে বলপূর্বক প্রবৃত্ত করিয়াছে, সেখানেই মানুষ আত্মশক্তির আনন্দে
নিয়মপালনের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হইতে বঞ্চিত হইয়াছে। মানুষকে বাঁধিয়া কাজ করানো
একবার অভ্যাস করাইলেই, বাঁধন কাটিয়া আর তাহার কাছে কাজ পাওয়া যায় না। এইজন্য যেখানে
আমরা নিয়ম মানি সেখানে দাসের মতো মানি, যেখানে মানি না সেখানে দাসের মতোই ফাঁকি
দিই। সেইজন্য যখন আমাদের সমাজের শাসন ছিল তখন জলাশয়ে জল, চতুষ্পাঠীতে শিক্ষা,
পানথশালায় আশ্রয় সহজে মিলিত; যখন সামাজিক বাহ্যশাসন শিথিল হইয়াছে তখন আমাদের রাস্তা
নাই, ঘাট নাই, জলাশয়ের জল নাই, সাধারণের অভাব দূর ও লোকের হিতসাধন করিবার কোনো
স্বাভাবিক শক্তি কোথাও উদ্বোধিত হইয়া কাজ করিতেছে না। হয় আমরা দৈবকে নিন্দা
করিতেছি নয় সরকার-বাহাদুরের মুখ চাহিয়া আছি।
কিন্তু, এ-সকল বিষয়ে কোন্টা যে
কার্য এবং কোন্টা কারণ তাহা ঠাহর করিয়া বলা শক্ত। যাহারা বাহিরের নিয়মকে অবাধে
শৃঙ্খল করিয়া পরে বাহিরের নিয়ম তাহাদিগকেই বাঁধে; যাহারা নিজের শক্তির প্রাবল্যে সে
নিয়মকে কোনোমতেই অন্ধভাবে স্বীকার করিতে পারে না তাহারাই আপনার আনন্দে আপনার নিয়মকে
উদ্ভাবিত করিয়া অধিকার লাভ করে। নতুবা, এই অধিকারকে হাতে তুলিয়া দিলেই ইহাকে
ব্যবহার করা যায় না। স্বাধীনতা বাহিরের জিনিস নহে, ভিতরের জিনিস, সুতরাং তাহা
কাহারও কাছ হইতে চাহিয়া পাইবার জো নাই। যতক্ষণ নিজের স্বাভাবিক শক্তির দ্বারা আমরা
সেই স্বাধীনতাকে লাভ না করি ততক্ষণ নানা আকারে বাহিরের শাসন আমাদের চোখে ঠুলি দিয়া
ও গলায় দড়ি বাঁধিয়া চালনা করিবেই। ততক্ষণ আমরা মুখে যাহাই বলি, কাজের বেলায় আপনি
আপনা হইতেই যেখানে সুযোগ পাইব সেখানেই অন্যের প্রতি অনুশাসন প্রবর্তিত করিতে চাহিব।
রাষ্ট্রনৈতিক অধিকার-লাভের বেলায় য়ুরোপীয় ইতিহাসের বচন আওড়াইব, আর সমাজনৈতিক
গৃহনৈতিক ক্ষেত্রে কেবলই জ্যেষ্ঠ যিনি তিনি কনিষ্ঠের ও প্রবল যিনি তিনি দুর্বলের
অধিকারকে সংকুচিত করিতে থাকিব। আমরা যখন কাহারও ভালো করিতে চাহিব সে আমারই নিজের
মতে, আমারই নিজের নিয়মে, যাহার ভালো করিতে চাই তাহাকে তাহার নিজের নিয়মে ভালো হইতে
দিতে আমরা সাহস করি না। এমনি করিয়া দুর্বলতাকে আমরা অস্থিমজ্জার মধ্যে পোষণ করিতে
থাকি, অথচ সবলের অধিকারকে আমরা বাহিরের দিক হইতে স্বপ্নলব্ধ দৈবসম্পত্তির মতো লাভ
করিতে চাই।
এইজন্যই পরম বেদনার সহিত দেখিতেছি,
যেখানেই আমরা সম্মিলিত হইয়া কোনো কাজ করিতে গিয়াছি যেখানেই নিজেদের নিয়মের দ্বারা
নিজেদের কোনো প্রতিষ্ঠানকে চালনা করিবার সুযোগ পাইয়াছি, সেখানেই পদে পদে বিচ্ছেদ ও
শৈথিল্য প্রবেশ করিয়া সমস্ত ছারখার করিয়া দিতেছে। বাহিরের কোনো শত্রুর হাত হইতে
নহে, কিন্তু অন্তরের এই শক্তিহীনতা শ্রীহীনতা হইতে আপনাদিগকে রক্ষা করা, ইহাই
আমাদের একটিমাত্র সমস্যা। যে নিয়ম মানুষের গলার হার তাহাকে পায়ের বেড়ি করিয়া পরিব
না, এই কথা একদিন আমাদিগকে সমস্ত মনের সঙ্গে বলিতে হইবে। এই কথা স্পষ্ট করিয়া
জানিতে হইবে যে, সত্যকে যেমন করিয়া হউক মানিতেই হইবে কিন্তু সত্যকে যখন অন্তরের
মধ্যে মানি তখনি তাহা আনন্দ, বাহিরে যখন মানি তখনি তাহা দুঃখ। অন্তরে সত্যকে
মানিবার শক্তি যখন না থাকে তখনি বাহিরে তাহার শাসন প্রবল হইয়া উঠে। সেজন্য যেন
বাহিরকেই ধিক্কার দিয়া নিজেকে অপরাধ হইতে নিষ্কৃতি দিবার চেষ্টা না করি।
সমুদ্রের
পালা শেষ হইল। শেষ দুই দিন প্রবল বেগে বাতাস উঠিল; তাহাতে সমুদ্রের আন্দোলনের সমতলে
আমাদের আভ্যন্তরিক আলোড়ন চলিতে লাগিল। আমি ভাবিয়া দেখিলাম, ইহাতে সমুদ্রের অপরাধ
নাই, কাপ্তেনেরই দোষ। যেদিন পৌঁছিবার কথা ছিল তাহার দুই দিন পরে পৌঁছিয়াছি। বরুণদেব
নিশ্চয়ই এই দুর্বলান্তঃকরণ যাত্রীটির জন্য ঠিকমতো হিসাব করিয়া ঝড়-বাতাসের ব্যবস্থা
করিয়া রাখিয়াছিলেন–
কিন্তু, মানুষের হিসাব ঠিক রহিল না।
মার্সেল্স্ হইতে এক দৌড়ে পারিসে আসিয়া এক দিনের মতো হাঁপ
ছাড়িলাম। শরীর হইতে সমুদ্রের নিমক সাফ করিয়া ফেলিয়া ডাঙার হাতে আত্মসমর্পণ করিলাম।
পানাহারের পর একটা মোটরগাড়িতে চড়িয়া পারিসের রাস্তায় রাস্তায় একবার হুহু করিয়া
ঘুরিয়া আসিলাম।
বাহির হইতে দেখিলে মনে হয়, পারিস সমস্ত য়ুরোপের খেলাঘর। এখানে
রঙ্গশালার প্রদীপ আর নেবে না। চারি দিকে আমোদ-আহ্লাদের বিরাট আয়োজন। মানুষকে খুশি
করিবার জন্য সুন্দরী পারিস-নগরীর কতই সাজসজ্জা। এই কথাই কেবল মনে হয়, মানুষকে খুশি
করাটা সহজে সারিবার কোনো চেষ্টা নাই।
যখন পৃথিবীতে রাজাদের একাধিপত্যের দিন ছিল তখন প্রমোদের চূড়ান্ত
ছিল কেবল রাজারই ঘরে। এখন সমস্ত মানুষ রাজা। এই সমগ্র মানুষের বিলাসভবনটি কী
প্রকাণ্ড ব্যাপার। ইহার জন্য কত দাস যে অহোরাত্র খাটিয়া মরিতেছে তাহার সীমা নাই।
ইহার জন্য প্রত্যহ কত জাহাজ, কত রেলগাড়ি বোঝাই করিয়া পৃথিবীর কত দুর্গম দেশ হইতে
উপকরণ আসিতেছে তাহার ঠিকানা কে রাখে।
এই মানুষ-রাজার আমোদ এমন প্রকাণ্ড, এমন বিচিত্র হইয়া উঠিয়াছে
যে, ইহাকে অলস বিলাসীর প্রমোদের সঙ্গে তুলনা করিতে প্রবৃত্তি হয় না। ইহা প্রবল
চিত্তের প্রবল আমোদ; যে সহজে সন্তুষ্ট হইতে চায় না তাহাকে খুশি করিবার দুঃসাধ্য
সাধন। বহু লোক ভোগ করিতে করিতে এবং বহু লোক ভোগ জোগাইতে জোগাইতে এই
প্রমোদ-পারাবারের মধ্যে তলাইয়া মরিতেছে, কিন্তু তবুও মোটের উপরে ইহার ভিতর হইতে
মানুষের যে একটা বিজয়ী শক্তির মূর্তি দেখা যাইতেছে তাহাকে অবজ্ঞা করিতে পারি না।
রবিবারের দিন ক্যালে হইতে সমুদ্রে পাড়ি দিয়া ডোভারে পৌঁছিলাম।
সেখানে ইংরেজ যাত্রীর সঙ্গে যখন রেলগাড়িতে চড়িয়া বসিলাম তখন মনের মধ্যে ভারি একটি
আরাম বোধ হইল। মনে হইল, আত্মীয়দের মধ্যে আসিয়াছি। ইংরেজের যে ভাষা জানি। মানুষের
ভাষা যে আলোর মতো। এই ভাষা যত দূর ছড়ায় তত দূর মানুষের হৃদয় আপনি আপনাকে প্রকাশ
করিয়া চলে। ইংরেজের ভাষা যখনি পাইয়াছি তখনি ইংরেজের মন পাইয়াছি। যাহা জানা যায়
তাহাতেই আনন্দ। ফ্রান্সে আমার পক্ষে কেবল চোখের জানা ছিল, কিন্তু হৃদয়ের জানা হইতে
বঞ্চিত ছিলাম–
সেইজন্যই আনন্দের ব্যাঘাত হইতেছিল। ডোভারে পা দিতেই আমার মনে হইল, সেই ব্যাঘাত আমার
কাটিয়া গেল। যেখানে দাঁড়াইলাম সেখানে কেবল যে মাটির উপর দাঁড়াইলাম তাহা নহে,
মানুষের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করিলাম।
অনেক কাল পরে লণ্ডনে আসিলাম। তখনো লণ্ডনের রাস্তায় যথেষ্ট ভিড়
দেখিয়াছি, কিন্তু এখন মোটর-গাড়ির একটা নূতন উপসর্গ জুটিয়াছে। তাহাতে শহরের ব্যস্ততা
আরও প্রবলভাবে মূর্তিমান হইয়া উঠিয়াছে। মোটর-রথ, মোটর-বিশ্বম্বহ (অম্নিবাস),
মোটর-মালগাড়ি লণ্ডনের নাড়ীতে নাড়ীতে শতধারায় ছুটিয়া চলিতেছে। আমি ভাবি, লণ্ডনের
সমস্ত রাস্তার ভিতর দিয়া কেবলমাত্র এই চলিবার বেগ পরিমাণে কী ভয়ানক প্রকান্ড! যে
মনের বেগের ইহা বাহ্যমূর্তি তাহাই বা কী ভীষণ! দেশ-কালকে লইয়া কী প্রচণ্ড বলে ইহারা
টানাটানি করিতেছে। পথ দিয়া পদাতিক যাহারা চলিতেছে প্রতিদিন তাহাদের সতর্কতা তীব্রতর
হইয়া উঠিতেছে। মন অন্য যে-কোনো ভাবনাই ভাবুক-না কেন,তাহার সঙ্গে সঙ্গে বাহিরের এই
বিচিত্র গতিবধির সঙ্গে তাহাকে প্রতিনিয়ত আপোষ করিয়া চলিতে হইবে। হিসাবের ভুল হইলেই
বিপদ। হিংস্র পশুর হাত হইতে পরিত্রাণ পাইবার প্রয়াসে হরিণের সতর্কতাবৃত্তি যেমন
প্রখর হইয়া উঠিয়াছে, চারি দিকে ব্যস্ততার তাড়া খাইয়া খাইয়া এখানকার মানুষের
সাবধানতা তেমনি অসামান্য তীক্ষ্ণতা লাভ করিতেছে। দ্রুত দেখা, দ্রুত শোনা ও দ্রুত
চিন্তা করিয়া কর্তব্য স্থির করিবার শক্তি কেবলই বাড়িয়া উঠিতেছে। দেখিতে শুনিতে ও
ভাবিতে যাহার সময় লাগে সেই এখানে হঠিয়া যাইবে।
ক্রমে বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ঘটিতেছে। যে যত্ন ও প্রীতি
পাইতেছি তাহা বিদেশী হাত হইতে পাইতেছি বলিয়া আমার কাছে দ্বিগুণ মূল্যবান হইয়া
উঠিতেছে; মানুষ যে মানুষের কত নিকটের তাহা দূরত্বের মধ্যে দিয়াই নিবিড়তর করিয়া
অনুভব করা যায়।
ইতিমধ্যে একদিন আমি 'নেশন' পত্রের মধ্যাহ্নভোজে আহূত হইয়াছিলাম।
নেশন এখানকার উদারপন্থীদের প্রধান সাপ্তাহিক পত্র। ইংলণ্ডে যে-সকল মহাত্মা স্বদেশ ও
বিদেশ, স্বজাতি ও পরজাতিকে স্বার্থপরতার ঝুঁটা বাটখারায় মাপিয়া বিচার করেন না,
অন্যায়কে যাঁহারা কোনো ছুতায় কোথাও আশ্রয় দিতে চান না, যাঁহারা সমস্ত মানবের
অকৃত্রিম বন্ধু, নেশন তাহদেরই বাণী বহন করিবার জন্য নিযুক্ত।
নেশন পত্রের সম্পাদক ও লেখকেরা সপ্তাহে একদিন মধ্যাহ্নভোজে
একত্র হন। এখানে তাঁহারা আহার করিতে করিতে আলাপ করেন ও আহারান্তে আগামী সপ্তাহের
প্রবন্ধের বিষয় লইয়া আলোচনা করিয়া থাকেন। বলা বাহুল্য, এরূপ প্রথম শ্রেণীর
সংবাদপত্রের লেখকেরা সকলেই পাণ্ডিত্যে ও দক্ষতায় অসামান্য ব্যক্তি। সেদিন ইহাদের
আলোচনা-ভোজে স্থান পাইয়া আমি বড়োই আনন্দ লাভ করিয়াছি।
ইহাদের মধ্যে বসিয়া আমার বারংবার কেবল এই কথাই মনে হইতে লাগিল
যে, ইহারা সকলেই জানেন ইঁহাদের প্রত্যেকেরই একটি সত্যকার দায়িত্ব আছে। ইঁহারা কেবল
বাক্য রচনা করিতেছেন না, ইঁহাদের প্রত্যেক প্রবন্ধ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যতরীর হালটাকে
ডাইনে বা বাঁয়ে কিছু-না-কিছু টান দিতেছেই। এমন অবস্থায় লেখক লেখার মধ্যে আপনার
সমস্ত চিত্তকে প্রয়োগ না করিয়া থাকিতে পারে না। আমাদের দেশের খবরের কাগজে তাহার
কোনো প্রয়োজন নাই; আমরা লেখকের কাছে কোনো দায়িত্ব দাবি করি না,এই কারণে লেখকের
শক্তি সম্পূর্ণ আলস্য ত্যাগ করে না ও ফাঁকি দিয়া কাজ সারিয়া দেয়। এইজন্য আমাদের
সম্পাদকেরা লেখকদের শিক্ষা ও সতর্কতার কোনো প্রয়োজন দেখেন না, যে-সে লোক যাহা-তাহা
লেখেন এবং পাঠকেরা তাহা নির্বিচারে পড়িয়া যান। আমরা সত্যক্ষেত্রে চাষ করিতেছি না
বলিয়াই আমাদের মঞ্জরীতে শস্য-অংশ অতি সামান্য দেখা যায়—মনের খাদ্য পুরাপুরি
জন্মিতেছে না।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা-সভা আমি
দেখিয়াছি; তাহাতে কথার চেয়ে কণ্ঠের জোর কত বেশি! এখানে কিরূপ প্রশান্ত ভাবে এবং
কিরূপ প্রণিধানের সঙ্গে তর্কবিতর্ক চলিতে লাগিল। মতের অনৈক্যর দ্বারা বিষয়কে বাধা
না দিয়া তাহাকে অগ্রসরই করিয়া দিল। অনেকে মিলিয়া কাজ করিবার অভ্যাস ইহাদের মধ্যে কত
সহজ হইয়াছে তাহা এই ক্ষণকালের মধ্যে বুঝিতে পারিলাম। ইহাদের কাজ গুরুতর, অথচ কাজের
প্রণালীর মধ্যে অনাবশ্যক সংঘর্ষ ও অপব্যয় লেশমাত্র নাই। ইহাদের রথ প্রকাণ্ড, তাহার
গতিও দ্রুত, কিন্তু তাহার চাকা অনায়াসে ঘোরে এবং কিছুমাত্র শব্দ করে না।
লণ্ডনে আসিয়া একটা হোটেলে আশ্রয় লইলাম; মনে হইল, এখানকার লোকালয়ের দেউড়িতে
আনাগোনার পথে আসিয়া বসিলাম। ভিতরে কী হইতেছে খবর পাই না, লোকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ও
হয় না–কেবল
দেখি, মানুষ যাইতেছে আর আসিতেছে। এইটুকুই চোখে পড়ে, মানুষের ব্যস্ততার সীমা পরিসীমা
নাই; এত অত্যন্ত বেশি দরকার কিসের তাহা আমরা বুঝিতে পারি না। এই প্রচণ্ড ব্যস্ততার
ধাক্কাটা কোন্খানে গিয়া লাগিতেছে, তাহাতে ক্ষতি করিতেছে কি বৃদ্ধি করিতেছে তাহার
কোনো হিসাব কেহ রাখিতেছে কি না কিছুই জানি না। ঢং ঢং করিয়া ঘণ্টা বাজে, আহারের
স্থানে গিয়া দেখি–এক-একটা
ছোটো টেবিল ঘেরিয়া দুই-তিনটি করিয়া স্ত্রীপুরুষ নিঃশব্দে আহার করিতেছে; পাত্র হাতে
দীর্ঘকায় পরিবেশক গম্ভীরমুখে দ্রুতপদে ক্ষিপ্রহস্তে পরিবেষন করিয়া চলিয়াছে; কেহ কেহ
বা খাইতে খাইতেই খবরের কাগজ পড়া সারিয়া লইতেছে; তাহার পরে ঘড়িটা খুলিয়া একবার
তাকাইয়া টুপিটা মাথায় চাপিয়া দিয়া, হন্ হন্ করিয়া চলিয়া যাইতেছে; ঘর শূন্য
হইতেছে। কেবল আহারের সময় বার-কয়েক কয়েকজন মানুষ একত্র হয়, তাহার পরে কে কোথায় যায়
কেহ তাহার ঠিকানা রাখে না। আমার কোনো প্রয়োজন নাই; সকলের দেখাদেখি মিথ্যা এক-একবার
ঘড়ি খুলিয়া দেখি, আবার ঘড়ি বন্ধ করিয়া পকেটে রাখি। যখন আহারেরও সময় নয়, নিদ্রারও
সময় নহে, তখন হোটেলে যেন ডাঙায় বাঁধা নৌকার মতো–
তখন যদি সেখানে থাকিতে হয় তবে কেন যে আছি তাহার কোনো কৈফিয়ত ভাবিয়া পাওয়া
যায় না। যাহাদের বাসস্থান নাই, কেবল কর্মস্থানই আছে, তাহাদেরই পক্ষে হোটেল মানায়।
যাহারা আমার মতো নিতান্ত অনাবশ্যক লোক তাহাদের পক্ষে বাসের আয়োজনটা এমনতরো পাইকারি
রকমের হইলে পোষায় না। জানলা খুলিয়া দেখি, জনস্রোত নানা দিকে ছুটিয়া চলিয়াছে। মনে
মনে ভাবি, ইহারা যেন কোন্-এক অদৃশ্য কারিগরের হাতুড়ি। যে জিনিসটা গড়িয়া উঠিতেছে
সেটাও মোটের উপর অদৃশ্য; মস্ত একটা ইতিহাসের কারখানা; লক্ষ লক্ষ হাতুড়ি দ্রুত প্রবল
বেগে লক্ষ লক্ষ জায়গায় আসিয়া পড়িতেছে। আমি সেই এঞ্জিনের বাহিরে দাঁড়াইয়া চাহিয়া
থাকি–
ক্ষুধার স্টীমে চালিত সজীব হাতুড়িগুলা দুনিবার বেগে ছটিতেছে, ইহাই দেখিতে
পাই।
যাহারা বিদেশী, প্রথম এখানে আসিয়া
এখানকার ইতিহাস-বিধাতার এই অতি-বিপুল মানুষ-কালের চেহারাটাই তাহাদের চোখে পড়ে। কী
দাহ, কী শব্দ, কী চাকার ঘূর্ণি। এই লণ্ডন শহরের সমস্ত গতি, সমস্ত কর্মকে একবার চোখ
বুজিয়া ভাবিয়া দেখিতে চেষ্টা করি–
কী ভয়ঙ্কর অধ্যবসায়। এই অবিশ্রাম বেগ কোন্ লক্ষ্যের অভিমুখে আঘাত করিতেছে
এবং কোন্ অব্যক্তকে প্রকাশের অভিমুখে জাগাইয়া তুলিতেছে।
কিন্তু, মানুষকে কেবল এই যন্ত্রের
দিক হইতে দেখিয়া তো দিন কাটে না। সেখানে সে মানুষ সেখানে তাহার পরিচয় না পাইলে কী
করিতে আসিলাম। কিন্তু, মানুষ যেখানে কল সেখানে দৃষ্টি পড়া যত সহজ, মানুষ যেখানে
মানুষ সেখানে তত সহজ নহে। ভিতরকার মানুষ আপনি আসিয়া সেখানে ডাকিয়া না লইয়া গেলে
প্রবেশ পাওয়া যায় না। কিন্তু, সে তো থিয়েটারের টিকিট কেনার মতো নহে; সে দাম দিয়া
মেলে না, সে বিনামূল্যের জিনিস।
আমার সৌভাগ্যক্রমে একটি সুযোগ ঘটিয়া
গেল–
আমি একজন বন্ধুর১ দেখা পাইলাম। বাগানের মধ্যে গোলাপ যেমন একটি
বিশেষ জাতের ফুল, বন্ধু তেমনি একটি বিশেষ জাতের মানুষ। এক-একটি লোক আছেন পৃথিবীতে
তাঁহারা বন্ধু হইয়াই জন্মগ্রহণ করেন। মানুষকে সঙ্গদান করিবার শক্তি তাঁহাদের
অসামান্য এবং স্বাভাবিক। আমরা সকলেই পৃথিবীতে কাহাকেও না কাহাকেও ভালোবাসি, কিন্তু
ভালোবাসিলেও বন্ধু হইবার শক্তি আমাদের সকলের নাই। বন্ধু হইতে গেলে সঙ্গদান করিতে
হয়। অন্যান্য সকল দানের মতো এ দানেরও একটা তহবিল দরকার, কেবলমাত্র ইচ্ছাই যথেষ্ট
নহে। রত্ন হইতে জ্যোতি যেমন সহজেই ঠিকরিয়া পড়ে তেমনি বিশেষ ক্ষমতাশালী মানুষের জীবন
হইতে সঙ্গ আপনি বিচ্ছুরিত হইতে থাকে। প্রীতিতে প্রসন্নতাতে সেবাতে শুভ-ইচ্ছাতে এবং
করুণাপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টিতে জড়িত এই-যে সহজ সঙ্গ, ইহার মতো দুর্লভ সামগ্রী পৃথিবীতে
অতি অল্পই আছে। কবি কেমন আপনার আনন্দকে ভাষায় প্রকাশ করেন, তেমনি যাঁহারা
স্বভাববন্ধু তাঁহারা মানুষের মধ্যে আপন আনন্দকে প্রতিদিনের জীবনে প্রকাশ করিয়া
থাকেন।
১ উইলিয়ম রোটেন্তস্টাইন (William
Rothenstein)
আমি এখানে যে বন্ধুটিকে পাইলাম
তাঁহার মধ্যে এই আনন্দ পাওয়া এবং আনন্দ দেওয়ার অবারিত ক্ষমতা আছে। এইরূপ
বন্ধুত্বধনে ধনী লোককে লাভ করার সুবিধা এই যে, একজনকে পাইলেই অনেককে পাওয়া যায়।
কেননা ইঁহাদের জীবনের সকলের চেয়ে প্রধান সঞ্চয় মনের মতো মানুষ-সঞ্চয়।
ইনি একজন সুবিখ্যাত চিত্রকর; ইনি
অল্পকাল পূর্বে অল্পদিনের জন্য ভারতবর্ষে গিয়াছিলেন। সেই অল্পকালের মধ্যে ইনি
ভারতবর্ষের মর্মস্থানটি দেখিয়া লইয়াছেন। হৃদয় দিয়া দেখা চোখে দেখারই মতো—ইহা
বিশ্লেষণের ব্যাপার নহে, সুতরাং ইহাতে বেশি সময় লাগে না। হৃদয়দৃষ্টি সম্বন্ধে কত
জন্মান্ধ ভারতবর্ষে জীবন কাটাইয়া দিতেছে; তাহারা আমাদের দেশের সেই আলোকটিকেই দেখিল
না যাহাকে দেখিলে আর সমস্তকেই অনায়াসে দেখা যায়। যাহাদের দেখিবার চোখ আছে তাহাদের
অল্পকালের পরিচয় অন্ধের চিরজীবনের পরিচয়ের চেয়ে বেশি।
ভারতবর্ষে ইহার সঙ্গে আমার ক্ষণকালের
জন্য আলাপ হইয়াছিল। ইঁহার সহৃদয়তা সর্বদাই এমন অবাধে প্রকাশ পায় যে তখনি আমার চিত্ত
ইঁহার প্রতি বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হইয়াছিল। ইঁহার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হইতে পারিব
এই লোভটি য়ুরোপে যাত্রার সময় আমাকে সকলের চেয়ে টানিয়াছিল।
ইঁহার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটিবামাত্র এক
মুহূর্তে হোটেলের দেউড়ি পার হইয়া গেলাম—কেহ আর বাধা দিবার রহিল না। ভিড়ের
ঠেলাঠেলিতে যেখানে তামাসা ভালো করিয়া দেখা যায় না, সেখানে বাপ যেমন ছোটো ছেলেকে
নিজের কাঁধের উপর চড়িয়া বসিবার জায়গা করিয়া দেন, তেমনি লণ্ডন শহর দুই-এক জায়গায়
আপনার উচ্চ কাঁধের উপর ফাঁকা জায়গা রাখিয়া গিয়াছে; তাহার যে-সব ছেলেরা ভিড়ের লোকের
মাথা ছাড়াইয়া আরও দূরের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করিতে চায় তাহাদের পক্ষে এই
জায়গাগুলির বিশেষ প্রয়োজন আছে। লণ্ডনের হ্যাম্প্রস্টেড্-হীথ্ সেই জাতের একটি
উচ্চ পাহাড়ে-প্রান্তর; লণ্ডন এইখানে আপনার হইতে আপনাকে যেন তুলিয়া ধরিয়াছে। এখানে
শহরের পাষাণহৃদয়ের একটি প্রান্ত এখনো নবীন ও শ্যামল আছে, এবং তাহার ভয়ংকর আপিসের
ভিড়ের মধ্যে এই জায়গাটিতে এখনো তাহার খোলা আকাশের জানলার ধারে একলা বসিবার আসন পাতা
আছে।
আমার বন্ধুর বাড়িটির পিছন দিকে ঢালু
পাহাড়ের গায়ে ছোটো একটুক্রা বাগান আছে। ঐটুকু বাগান আনন্দিত ছোটো ছেলের আঁচলটির
মতো ফুলের সৌন্দর্যে ভরিয়া উঠিয়াছে। সেই বাগানের দিকে মুখ করিয়া তাঁহাদের
বৈঠকখানা-ঘরের সংলগ্ন একটি লম্বা বারান্দা অপর্যাপ্ত ফুলের স্তবকে আমোদিত গোলাপের
লতায় অর্ধপ্রচ্ছন্ন হইয়া আছে। এই বারান্দায় আমি যখন খুশি একখানা বই হাতে করিয়া বসি,
তাহার পরে আর বই পড়িবার কোনো প্রয়োজন বোধ করি না। ইঁহার দুটি ছোটো ছেলে ও ছোটো
মেয়ের মধ্যে বাল্যবয়সের চিরানন্দময় নবীনতার উচ্ছ্বাস দেখিতে আমার ভারি ভালো লাগে।
আমাদের দেশের ছেলেদের সঙ্গে ইহাদের আমি একটা গভীর প্রভেদ দেখিতে পাই। আমার মনে হয়,
যেন আমরা অত্যন্ত পুরাতন যুগের মানুষ; আমাদের দেশের শিশুরাও যেন কোথা হইতে সেই
পুরাতনত্বের বোঝা পিঠে করিয়া এই পৃথিবীতে আসিয়া উপস্থিত হয়। তাহারা ভালোমানুষ,
তাহাদের গতিবিধি সংযত,
তাহাদের বড়ো বড়ো কালো চোখদুটি করুণ—তাহারা বেশি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে না, আপনার মনেই
যেন তাহার মীমাংসা করিতে থাকে। আর এই-সব ছেলেরা পৃথিবীর নবীনযুগের মহলে জন্মিয়াছে;
তাহারা জীবনের নবীনতার আস্বাদে মাতিয়া উঠিয়াছে; তাহাদের সমস্তই ভাবিয়া-চিন্তিয়া
করিয়া-কর্মিয়া লইতে হইবে, এইজন্য সব জায়গাতেই তাহাদের চঞ্চল পা ছুটিতে চায় এবং সকল
জিনিসেই তাহাদের চঞ্চল হাত গিয়া পড়ে। আমাদের দেশের ছেলেদেরও একটা স্বাভাবিক চঞ্চলতা
আছে সন্দেহ নাই, কিন্তু তাহার সঙ্গে সঙ্গেই একটা অচঞ্চলতার ভারাকর্ষণ তাহাকে
সর্বদাই যেন অনেকটা পরিমাণে স্থির করিয়া রাখিয়াছে। ইহাদের মধ্যে সেই অদৃশ্য ভারটা
নাই বলিয়া ইহাদের জীবন তরুণ ঝরনার মতো কলশব্দে নৃত্য করিতে করিতে কেবলই যেন
ঝিক্মিক্ করিয়া উঠিতেছে।
আমাদের বন্ধুর গৃহিণীও বন্ধুবৎসলা। তাঁহার স্বামীর বিস্তৃত বন্ধুমণ্ডলী সম্বন্ধে
তাঁহাকে স্ত্রীর কর্তব্য পালন করিতে হয়। তাহাদের সেবা যত্ন করা, তাহাদের সঙ্গে
আত্মীয়তার সম্বন্ধকে সর্বাংশে সুন্দররূপে হৃদ্য করিয়া তোলা, রোগে শোকে তাহাদের
সংবাদ লওয়া ও সান্ত্বনা করা, ইহা তাঁহার সাংসারিক কর্তব্যের একটা প্রধান অঙ্গ। ইহা
তো কেবল স্বজনসমাজের আত্মীয়তা নহে, ইহা বন্ধুসমাজের আত্মীয়তা—এই বৃহৎ আত্মীয়তার
মর্মস্থলে সাধ্বী স্ত্রীর যে আসন তাহা এ দেশে শূন্য নাই।
পূর্বেই বলিয়াছি, আমার বন্ধুটি
স্বভাববন্ধু—তাঁহার বন্ধুত্বের প্রতিভা অসামান্য। ইঁহার পক্ষে বন্ধুত্ব জিনিসটি
সত্য বলিয়াই ইঁহাকে বিশেষ যত্নে বন্ধু বাছিয়া লইতে হয়। যে লোক খাঁটি আর্টিস্ট্ নয়
সে যেমন কেবলমাত্র দস্তুর রক্ষার জন্য ঘর সাজাইবার উপলক্ষ্যে যেমন-তেমন ছবি
বাঁধাইয়া দেয়ালে টাঙাইয়া কোনোমতে শূন্যস্থান পূর্ণ করিতে পারে কিন্তু যে লোক খাঁটি
আর্টিস্ট্, ছবি যাহার পক্ষে সত্যবস্তু, সে স্বভাবতই বাজে ছবি দিয়া ঘর ভরিতে পারে
না, সে আপনার স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধির দ্বারা ছবি বাছিয়া লয়—ইনিও তেমনি কেবলমাত্র
বাজে পরিচিতবর্গের সামাজিক ভাবের দ্বারা আপনাকে আক্রান্ত করেন নাই। ইঁহার সঙ্গে
যাঁহাদের সম্বন্ধ আছে সকলেই ইঁহার বন্ধু এবং সকলেই গুণী এবং বিশেষভাবে সমাদরের
যোগ্য।
এমনতরো বরেণ্য বন্ধুমণ্ডলীকে যিনি
আপনার চার দিকে ধরিয়া রাখিতে পারেন তাঁহার যে বিশেষ গুণের দরকার সে কথা বলাই
বাহুল্য। ইনি রসজ্ঞ। মৌমাছি যেমন ফুলের মধুকোষের গোপন রাস্তাটি অনায়াসে বাহির করিতে
পারে ইনিও তেমনি রসের পথে অনায়াসে প্রবেশ করেন; ভালো জিনিসকে একেবারেই দ্বিধাবিহীন
জোরের সঙ্গে ধরিতে পারেন। ভালো লাগা এবং ভালো বলার সম্বন্ধে অনেক লোকেরই একটা
ভীরুতা আছে, ‘পাছে ভুল করিয়া অপদস্থ হই’ এ ভয় তাহারা ছাড়িতে পারে না। এইজন্য ভালোকে
অভ্যর্থনা করিয়া লইবার বেলায় তাহারা বরাবর অন্য লোকের পিছনে পড়িয়া যায়। ইঁহার
বোধশক্তির মধ্যে একটি যথার্থ প্রবলতা আছে বলিয়াই ইঁহার সেই ভয় নাই। এমনি করিয়া তিনি
যে মৌমাছির মতো কেবলমাত্র মধু-রসটিকেই আহরণ করিতে জানেন তাহা নহে, সেই সঙ্গে
ফুলটিকেও ভালোবাসিবার ক্ষমতা তাঁহার আছে। তিনি ভোগী নহেন, তিনি প্রেমিক। এইজন্য
তিনি গ্রহণও করেন, তিনি দানও করেন।
অপরিচয় হইতে পরিচয়ের পথ অতি দীর্ঘ।
সেই দুঃসাধ্য পথ অতিক্রম করিবার মতো সময় আমার ছিল না। আমার শক্তিও অল্প। বরাবর কোণে
থাকা অভ্যাস বলিয়া নিজের জোরে ভিড় ঠেলিয়া-ঠুলিয়া ইচ্ছিত জায়গাটিতে পৌঁছানোর চেষ্টা
করিতেও আমি পারি না। তা ছাড়া ইংরেজির ভাষার সদর দরজার চাবিটা আমার হাতে নাই; আমাকে
কেবলই বেড়া ডিঙাইয়া চলিতে হয়—তেমন করিয়া পথ চলা একটা ব্যায়াম, তেমনভাবে আপনার
স্বভাবকে রক্ষা করিয়া চলা যায় না। নিজেকে অবাধে পরিচিত করিবার শক্তি না থাকিলে
অন্যের সহজ পরিচয় পাওয়া সম্ভবপর হয় না। সুতরাং কিছুকাল এখানকার মোটর-গাড়ি দানবরথের
চাকা বাঁচাইবার চেষ্টায় শ্রান্ত হইয়া অবশেষে এখানকার পথ হইতেই ফিরিতাম, আমার সেই
নদী-বাহুপাশে-ঘেরা বাংলাদেশের শরৎরৌদ্রালোকিত আমন-ধানের খেতের ধারে। এমন সময় প্রবেশ
করিলেন বন্ধু, পর্দা তুলিয়া দিলেন। দেখিলাম আসন পাতা, দেখিলাম আলো জ্বলিতেছে;
বিদেশীর অপরিচয়ের মস্ত বোঝাটা বাহিরে রাখিয়া, পথিকের ধূলিলিপ্ত বেশ ছাড়িয়া ফেলিয়া,
এক মুহূর্তেই ভিড়ের মধ্য হইতে নিভৃতে আসিয়া প্রবেশ করিলাম।