ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
প্রথম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
জালন্ধর
প্রাসাদের এক কক্ষ
বিক্রমদেব ও দেবদত্ত
দেবদত্ত। মহারাজ,
এ কী উপদ্রব!
বিক্রমদেব।
হয়েছে কী!
দেবদত্ত। আমাকে বরিবে নাকি পুরোহিতপদে?
কী দোষ করেছি প্রভো? কবে শুনিয়াছ
ত্রিষ্টুভ্ অনুষ্টুভ্ এই পাপমুখে?
তোমার সংসর্গে পড়ে ভুলে বসে আছি
যত যাগযজ্ঞবিধি। আমি পুরোহিত?
শ্রুতিস্মৃতি ঢালিয়াছি বিস্মৃতির জলে।
এক বই পিতা নয় তাঁরি নাম ভুলি,
দেবতা তেত্রিশ কোটি গড় করি সবে।
স্কন্ধে ঝুলে পড়ে আছে শুধু পৈতেখানা
তেজোহীন ব্রহ্মণ্যের নির্বিষ খোলশ।
বিক্রমদেব। তাই তো নির্ভয়ে আমি দিয়েছি তোমারে
পৌরোহিত্যভার। শাস্ত্র নাই, মন্ত্র নাই,
নাই কোনো ব্রহ্মণ্য-বালাই।
দেবদত্ত।
তুমি চাও
নখদন্তভাঙা এক পোষা পুরোহিত।
বিক্রমদেব। পুরোহিত, একেকটা ব্রহ্মদৈত্য যেন।
একে তো আহার করে রাজস্কন্ধে চেপে
সুখে বারো মাস, তার পরে দিন রাত
অনুষ্ঠান, উপদ্রব, নিষেধ, বিধান,
অনুযোগ, অনুস্বর-বিসর্গের ঘটা‒
দক্ষিণায় পূর্ণ হস্তে শূন্য আশীর্বাদ।
দেবদত্ত। শাস্ত্রহীন ব্রাহ্মণের প্রয়োজন যদি
আছেন ত্রিবেদী‒
অতিশয় সাধুলোক,
সর্বদাই রয়েছেন জপমালা হাতে
ক্রিয়াকর্ম নিয়ে; শুধু মন্ত্র-উচ্চারণে
লেশমাত্র নাই তাঁর ক্রিয়াকর্মজ্ঞান।
বিক্রমদেব।
অতি ভয়ানক। সখা, শাস্ত্র নাই যার
শাস্ত্রের উপদ্রব তার চতুর্গুণ।
নাই যার বেদবিদ্যা, ব্যাকরণবিধি,
নাই তার বাধাবিঘ্ন‒ শুধু বুলি ছোটে
পশ্চাতে ফেলিয়া রেখে তদ্ধিত প্রত্যয়
অমর পাণিনি। একসঙ্গে নাহি সয়
রাজা আর ব্যাকরণ দোঁহারে পীড়ন।
দেবদত্ত।
আমি পুরোহিত? মহারাজ, এ সংবাদে
ঘন আন্দোলিত হবে কেশলেশহীন
যতেক চিক্কণ মাথা; অমঙ্গল স্মরি
রাজ্যের টিকি যত হবে কণ্টকিত।
বিক্রমদেব।
কেন অমঙ্গলশঙ্কা?
দেবদত্ত।
কর্মকাণ্ডহীন
এ দীন বিপ্রের দোষে কুলদেবতার
রোষ-হুতাশন‒
বিক্রমদেব।
রেখে দাও বিভীষিকা।
কুলদেবতার রোষ নতশির পাতি
সহিতে প্রস্তুত আছি; সহে না কেবল
কুলপুরোহিত-আস্ফালন। জান সখা,
দীপ্ত সূর্য সহ্য হয় তপ্ত বালি চেয়ে।
দূর করো মিছে তর্ক যত। এসো করি
কাব্য-আলোচনা। কাল বলেছিলে তুমি
পুরাতন কবিবাক্য 'নাহিকো বিশ্বাস
রমণীরে'‒ আর বারবলো শুনি।
দেবদত্ত।
শাস্ত্রং‒
বিক্রমদেব। রক্ষা করো‒ ছেড়ে দাও অনুস্বরগুলো।
দেবদত্ত।
অনুস্বর ধনুঃশর নহে, মহারাজ,
কেবল টংকারমাত্র। হে বীরপুরুষ,
ভয় নাই। ভালো, আমি ভাষায় বলিব।‒
'যত চিন্তা কর শাস্ত্র, চিন্তা আরো বাড়ে,
যত পূজা কর ভূপে, ভয় নাহি ছাড়ে।
কোলে থাকিলেও নারী রেখো সাবধানে।
শাস্ত্র, নৃপ, নারী কভু বশ নাহি মানে।'
বিক্রমদেব।
বশ নাহি মানে! ধিক স্পর্ধা কবি, তব!
চাহে কে করিতে বশ? বিদ্রোহী সে জন।
বশ করিবার নহে নৃপতি, রমণী!
দেবদত্ত।
তা বটে। পুরুষ রবে রমণীর বশে।
বিক্রমদেব।
রমণীর হৃদয়ের রহস্য কে জানে?
বিধির বিধান সব অজ্ঞেয়‒ তা বলে
অবিশ্বাস জন্মে যদি বিধির বিধানে,
রমণীর প্রেমে‒ আশ্রয় কোথায় পাবে?
নদী ধায়, বায়ু বহে কেমনে কে জানে।
সেই নদী দেশের কল্যাণপ্রবাহিণী,
সেই বায়ু জীবের জীবন।
দেবদত্ত।
বন্যা আনে
সেই নদী; সেই বায়ু ঝঞ্ঝা নিয়ে আসে।
বিক্রমদেব।
প্রাণ দেয়, মৃত্যু দেয়‒ লই শিরে তুলি;
তাই বলে কোন্ মূর্খ চাহে তাহাদের
বশ করিবারে। বদ্ধনদী, বদ্ধবায়ু
রোগ-শোক-মৃত্যুর নিদান। হে ব্রাহ্মণ,
নারীর কী জান তুমি?
দেবদত্ত।
কিছু না রাজন্।
ছিলাম উজ্জ্বল করে পিতৃমাতৃকুল
ভদ্র ব্রাহ্মণের ছেলে। তিন সন্ধ্যা ছিল
আহ্নিক তর্পণ। শেষে তোমারি সংসর্গে
বিসর্জন করিয়াছি সকল দেবতা,
কেবল অনঙ্গদেব রয়েছেন বাকি।
ভুলেছি মহিম্নস্তব, শিখেছি গাহিতে
নারীর মহিমা; সে বিদ্যাও পুঁথিগত‒
তার পরে মাঝে মাঝে চক্ষু রাঙাইলে
সে বিদ্যাও ছুটে যায় স্বপ্নের মতন।
বিক্রমদেব। না না ভয় নাই সখা, মৌন রহিলাম‒
তোমার নূতন বিদ্যা বলে যাও তুমি।
দেবদত্ত। শুন তবে‒
বলিছেন কবি ভর্তৃ হরি,‒
'নারীর বচনে মধু, হৃদয়েতে হলাহল,
অধরে পিয়ায় সুধা, চিত্তে জ্বালে দাবানল।'
বিক্রমদেব।
সেই পুরাতন কথা!
দেবদত্ত।
সত্য পুরাতন।
কী করিব মহারাজ, যত পুঁথি খুলি
ওই এক কথা। যত প্রাচীন পণ্ডিত
প্রেয়সীরে ঘরে নিয়ে এক দণ্ড কভু
ছিল না সুস্থির। আমি শুধু ভাবি, যার
ঘরের ব্রাহ্মণী ফিরে পরের সন্ধানে
সে কেমনে কাব্য লেখে ছন্দ গেঁথে গেঁথে
পরম নিশ্চিন্ত মনে?
বিক্রমদেব।
মিথ্যা অবিশ্বাস!
ও কেবল ইচ্ছাকৃত আত্মপ্রবঞ্চনা।
ক্ষুদ্র হৃদয়ের প্রেম নিতান্ত বিশ্বাসে
হয়ে আসে মৃত জড়বৎ, তাই তারে
জাগায়ে তুলিতে হয় মিথ্যা অবিশ্বাসে।
হেরো ওই আসিছেন মন্ত্রী, স্তূপাকার
রাজ্যভার স্কন্ধে নিয়ে। পলায়ন করি।
দেবদত্ত।
রানীর রাজত্বে তুমি লও গে আশ্রয়!
ধাও অন্তঃপুরে। অসম্পুর্ণ রাজকার্য
দুয়ার-বাহিরে পড়ে থাক্; স্ফীত হোক
যত যায় দিন। তোমার দুয়ার ছাড়ি
ক্রমে উঠিবে সে ঊর্ধ্বদিকে, দেবতার
বিচার-আসন পানে।
বিক্রমদেব।
এ কি উপদেশ?
দেবদত্ত।
না রাজন্! প্রলাপ-বচন! যাও তুমি,
কাল নষ্ট হয়!
[ বিক্রমদেবের প্রস্থান
মন্ত্রীর প্রবেশ
মন্ত্রী।
ছিলেন না মহারাজ?
দেবদত্ত।
করেছেন অন্তর্ধান অন্তঃপুর পানে।
(বসিয়া পড়িয়া)
মন্ত্রী।
হা বিধাতঃ, এ রাজ্যের কী দশা করিলে?
কোথা রাজা, কোথা দণ্ড, কোথা সিংহাসন!
শ্মশানভূমির মতো বিষণ্ন বিশাল
রাজ্যের বক্ষের 'পরে সগর্বে দাঁড়ায়ে
বধির পাষাণ রুদ্ধ অন্ধ অন্তঃপুর।
রাজশ্রী দুয়ারে বসি অনাথার বেশে
কাঁদে হাহাকার রবে।
দেবদত্ত।
দেখে হাসি আসে।
রাজা করে পলায়ন, রাজ্য ধায় পিছে‒
হল ভালো মন্ত্রিবর, অহর্নিশি যেন
রাজ্য ও রাজায় মিলে লুকোচুরি খেলা।
মন্ত্রী।
এ কি হাসিবার কথা ব্রাহ্মণ ঠাকুর?
দেবদত্ত।
না হাসিয়া করিব কী? অরণ্যে ক্রন্দন
সে তো বালকের কাজ। দিবসরজনী
বিলাপ না হয় সহ্য তাই মাঝে মাঝে
রোদনের পরিবর্তে শুষ্ক শ্বেত হাসি
জমাট অশ্রুর মতো তুষার-কঠিন।
কী ঘটেছে বলো শুনি।
মন্ত্রী।
জান তো সকলি।
রানীর কুটুম্ব যত বিদেশী কাশ্মীরী
দেশ জুড়ে বসিয়াছে। রাজার প্রতাপ
ভাগ করে লইয়াছে খণ্ড খণ্ড করি,
বিষ্ণুচক্রে ছিন্ন মৃত সতীদেহ সম।
বিদেশীর অত্যাচারে জর্জর কাতর
কাঁদে প্রজা। অরাজক রাজসভামাঝে
মিলায় ক্রন্দন। বিদেশী অমাত্য যত
বসে বসে হাসে। শূন্য সিংহাসন-পার্শ্বে
বিদীর্ণ হৃদয় মন্ত্রী বসি নতশিরে।
দেবদত্ত।
বহে ঝড়, ডোবে তরী, কাঁদে যাত্রী যত,
রিক্তহস্ত কর্ণধার উচ্চে একা বসি
বলে 'কর্ণ কোথা গেল।' মিছে খুঁজে মর,
রমণী নিয়েছে টেনে রাজকর্ণখানা,
বাহিছে প্রেমের তরী লীলা-সরোবরে
বসন্তপবনে। রাজ্যের বোঝাই নিয়ে
মন্ত্রীটা মরুক ডুবে অকূল পাথারে।
মন্ত্রী।
হেসো না ঠাকুর। ছি ছি, শোকের সময়ে
হাসি অকল্যাণ।
দেবদত্ত।
আমি বলি মন্ত্রিবর,
রাজারে ডিঙায়ে, একেবারে পড়ো গিয়ে
রানীর চরণে।
মন্ত্রী।
আমি পারিব না তাহা।
আপন আত্মীয়-জনে করিবে বিচার
রমণী, এমন কথা শুনি নাই কভু।
দেবদত্ত।
শুধু শাস্ত্র জান মন্ত্রী, চেন না মানুষ।
বরঞ্চ আপন জনে আপনার হাতে
দণ্ড দিতে পারে নারী; পারে না সহিতে
পরের বিচার।
মন্ত্রী।
ওই শোনো কোলাহল।
দেবদত্ত।
এ কি প্রজার বিদ্রোহ?
মন্ত্রী।
চলো দেখে আসি।