ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


রাজা ও রানী

প্রথম অঙ্ক

দ্বিতীয় দৃশ্য

রাজপথ
লোকারণ্য
 

  কিনু নাপিত। ওরে ভাই কান্নার দিন নয়। অনেক কেঁদেছি তাতে কিছু হল কি?
  মন্‌সুখ চাষা। ঠিক বলেছিল রে, সাহসে সব কাজ হয়,-- ওই যে কথায় বলে "আছে যার বুকের পাটা, যমরাজকে সে দেখায় ঝাঁটা।"
  কুঞ্জরলাল কামার। ভিক্ষে করে কিছু হবে না, আমরা লুট করব।
  কিনু নাপিত। ভিক্ষেং নৈম নৈমচং। কী বল খুড়ো, তুমি তো স্মার্ত ব্রাহ্মণের ছেলে, লুটপাটে দোষ আছে কি?
  নন্দলাল। কিছু না, খিদের কাছে পাপ নেই রে বাবা। জানিস তো অগ্নিকে বলে পাবক, অগ্নিতে সকল পাপ নষ্ট করে। জঠরাগ্নির বাড়া তো আর অগ্নি নেই।
  অনেকে। আগুন। তা ঠিক বলেছ। বেঁচে থাকো ঠাকুর। তবে তাই হবে। তা আমরা আগুনই লাগিয়ে দেব। ওরে আগুনে পাপ নেই রে। এবার ওঁদের বড়ো বড়ো ভিটেতে ঘুঘু চরাব।
  কুঞ্জর। আমার তিনটে সড়কি আছে।
  মন্‌সুখ। আমার একগাছা লাঙ্গল আছে, এবার তাজপরা মাথাগুলো মাটির ঢেলার মতো চষে ফেলব।
  শ্রীহর কলু। আমার একগাছ বড়ো কুড়ুল আছে, কিন্তু পালাবার সময় সেটা বাড়িতে ফেলে এসেছি।
  হরিদীন কুমোর। ওরে তোরা মরতে বসেছিস না কি? বলিস কী রে। আগে রাজাকে জানা, তার পরে যদি না শোনে, তখন অন্য পরামর্শ হবে।
  কিনু নাপিত। আমিও তো সেই কথা বলি।
  কুঞ্জর। আমিও তো তাই ঠাওরাচ্ছি।
  শ্রীহর। আমি বরাবর বলে আসছি, ঐ কায়স্থর পোকে বলতে দাও। আচ্ছা, দাদা, তুমি রাজাকে ভয় করবে না?
  মন্নুরাম কায়স্থ। ভয় আমি কাউকে করি নে। তোরা লুঠ করতে যাচ্ছিস, আর আমি দুটো কথা বলতে পারি নে?
  মন্‌সুখ। দাঙ্গা করা এক, আর কথা বলা এক। এই তো বরাবর দেখে আসছি, হাত চলে, কিন্তু মুখ চলে না।
  কিনু। মুখের কোনো কাজটাই হয় না
অন্নও জোটে না, কথাও ফোটে না।
  কুঞ্জর। আচ্ছা, তুমি কী বলবে বলো।
  মন্নুরাম। আমি ভয় করে বলব না; আমি প্রথমেই শাস্ত্র বলব।
  শ্রীহর। বল কী? তোমার শাস্তর জানা আছে? আমি তো তাই গোড়াগুড়িই বলছিলুম কায়স্থর পোকে বলতে দাও
ও জানে শোনে।
  মন্নুরাম। আমি প্রথমেই বলব

             অতিদর্পে হতা লঙ্কা, অতিমানে চ কৌরবাঃ
             অতিদানে বলির্বদ্ধঃ সর্বমত্যন্তগর্হিতম্‌।
 হরিদীন। হাঁ, এ শাস্ত্র বটে।
 কিনু। (ব্রাহ্মণের প্রতি) কেমন খুড়ো, তুমি তো ব্রাহ্মণের ছেলে, এ শাস্ত্র কি না? তুমি তো এ সমস্তই বোঝ।
 নন্দ। হাঁ
তা ইয়ে ওর নাম কী তা বুঝি বই কি। কিন্তু রাজা যদি না বোঝে, তুমি কী করে বুঝিয়ে দেবে, বলো তো শুনি।
 মন্নুরাম। অর্থাৎ বাড়াবাড়িটে কিছু নয়।
 জওহর তাঁতি। ঐ অতবড়ো কথাটার এইটুকু মানে হল?
 শ্রীহর। তা না হলে আর শাস্তর কিসের।
 নন্দ। চাষাভুষোর মুখে যে-কথাটা ছোট্ট, বড়োলোকের মুখে সেইটেই কত বড়ো শোনায়।
 মন্‌সুখ। কিন্তু কথাটা ভালো, "বাড়াবাড়ি কিছু নয়" শুনে রাজার চোখ ফুটবে।
 জওহর। কিন্তু ওই একটাতে হবে না, আরও শাস্তর চাই।
 মন্নুরাম। তা আমার পুঁজি আছে, আমি বলব

               লালনে বহবো দোষাস্তাড়নে বহবো গুণাঃ।
               তস্মাৎ মিত্রঞ্চ পুত্রঞ্চ তাড়য়েৎ ন তু লালয়েৎ

তা আমরা কি পুত্র নই? হে মহারাজ, আমাদের তাড়না করবে না
ঐটে ভালো নয়।
  হরিদীন। এ ভালো কথা, মস্ত কথা, ঐ-যে কী বললে
ও কথাগুলো শোনাচ্ছে ভালো।
  শ্রীহর। কিন্তু কেবল শাস্তর বললে তো চলবে না
আমার ঘানির কথাটা কখন আসবে? অমনি ওই সঙ্গে জুড়ে দিলে হয় না?
  নন্দ। বেটা তুমি ঘানির সঙ্গে শাস্তর জুড়বে? এ কি তোমার গোরু পেয়েছ?
  জওহর। কলুর ছেলে, ওর আর কত বুদ্ধি হবে!
  কুঞ্জর। দু ঘা না পিঠে পড়লে ওর শিক্ষা হবে না। কিন্তু আমার কথাটা কখন পাড়বে? মনে থাকবে তো? আমার নাম কুঞ্জরলাল। কাঞ্জিলাল নয়
সে আমার ভাইপো, সে বুধকোটে থাকে সে যখন সবে তিন বছর তখন তাকে
  হরিদীন। সব বুঝলুম, কিন্তু যে-রকম কাল পড়েছে, রাজা যদি শাস্তর না শোনে।
  কুঞ্জর। তখন আমরাও শাস্তর ছেড়ে অস্তর ধরব।
  কিনু। শাবাশ বলেছ, শাস্তর ছেড়ে অস্তর।
  মন্‌সুখ। কে বললে হে? কথাটা কে বললে?
  কুঞ্জর। (সগর্বে) আমি বলেছি। আমার নাম কুঞ্জরলাল, কাঞ্জিলাল আমার ভাইপো।
  কিনু। তা ঠিক বলেছ ভাই
শাস্তর আর অস্তর কখনো শাস্তর কখনো অস্তর আবার কখনো অস্তর কখনো শাস্তর।
  জওহর। কিন্তু বড়ো গোলমাল হচ্ছে। কথাটা কী যে স্থির হল বুঝতে পারছি নে। শাস্তর না অস্তর?
  শ্রীহর। বেটা তাঁতি কি না, এইটে আর বুঝতে পারলি নে? তবে এতক্ষণ ধরে কথাটা হল কী? স্থির হল যে শাস্তরের মহিমা বুঝতে ঢের দেরি হয়, কিন্তু অন্তরের মহিমা খুব চটপট বোঝা যায়।
  অনেকে। (উচ্চস্বরে) তবে শাস্তর চুলোয় যাক-- অস্তর ধরো।
 

                  দেবদত্তের প্রবেশ
   দেবদত্ত। বেশি ব্যস্ত হবার দরকার করে না; চুলোতেই যাবে শিগগির, তার আয়োজন হচ্ছে। বেটা তোরা কী বলছিলি রে?
   শ্রীহর। আমরা ওই ভদ্রলোকের ছেলেটির কাছে শাস্তর শুনছিলুম ঠাকুর।
   দেবদত্ত। এমনি মন দিয়েই শাস্তর শোনে বটে। চীৎকারের চোটে রাজ্যের কানে তালা ধরিয়ে দিলে। যেন ধোবাপাড়ায় আগুন লেগেছে।
   কিনু। তোমার কী ঠাকুর। তুমি তো রাজবাড়ির সিধে খেয়ে খেয়ে ফুলছ
আমাদের পেটে নাড়ীগুলো জ্বলে জ্বলে ম'ল আমরা কি বড়ো সুখে চেঁচাচ্ছি।
   মন্‌সুখ। আজকালের দিনে আস্তে বললে শোনে কে? এখন চেঁচিয়ে কথা কইতে হয়।
   কুঞ্জর। কান্নাকাটি ঢের হয়েছে, এখন দেখছি অন্য উপায় আছে কি না।
   দেবদত্ত। কী বলিস রে। তোদের বড়ো আস্পর্ধা হয়েছে। তবে শুনবি? তবে বলব?

                     নসমানসমানসমানসমাগমমাপ সমীক্ষ্য বসন্তনভঃ।
                     ভ্রমদভ্রমদভ্রমদভ্রমদভ্রমরচ্ছলতঃ খলু কামিজনঃ॥"
  হরিদীন। ও বাবা, শাপ দিচ্ছে নাকি?
  দেবদত্ত। (মন্নুর প্রতি) তুমি তো ভদ্রলোকের ছেলে, তুমি তো শাস্তর বোঝ কেমন, এ ঠিক কথা কি না? "নস মানস মানস মানসং
"
  মন্নুরাম। আহা ঠিক। শাস্ত্র যদি চাও তো এই বটে। তা আমিও তো ঠিক ওই কথাটাই বোঝাচ্ছিলুম।
  দেবদত্ত। (নন্দের প্রতি) নমস্কার। তুমি তো ব্রাহ্মণ দেখছি। কী বল ঠাকুর, পরিণামে এই সব মূর্খরা "ভ্রমদভ্রমদভ্রমদং" হয়ে মরবে না?
  নন্দ। বরাবর তাই বলছি, কিন্তু বোঝে কে? ছোটোলোক কিনা।
  দেবদত্ত। (মন্‌সুখের প্রতি) তোমাকে এর মধ্যে বুদ্ধিমানের মতো দেখাচ্ছে, আচ্ছা তুমি বলো দেখি, কথাগুলো কি ভালো হচ্ছিল? (কুঞ্জরের প্রতি) আর তোমাকেও তো বেশ ভালোমানুষ দেখছি হে, তোমার নাম কী?
  কুঞ্জর। আমার নাম কুঞ্জরলাল
কাঞ্জিলাল আমার ভাইপোর নাম।
  দেবদত্ত। ওঃ! তোমারই ভাইপোর নাম কাঞ্জিলাল বটে? তা, আমি রাজার কাছে বিশেষ করে তোমাদের নাম করব।
  হরিদীন। আর আমাদের কী হবে?
  দেবদত্ত। তা আমি বলতে পারি নে বাপু। এখন তো তোরা কান্না ধরেছিস
এই একটু আগে আর-এক সুর বের করেছিলি। সে কথাগুলো কি রাজা শোনে নি? রাজা সব শুনতে পায়?
  অনেকে। দোহাই ঠাকুর, আমরা কিছু বলি নি, ওই কাঞ্জুলাল না মাঞ্জুলাল অন্তরের কথা পেড়েছিল।
  কুঞ্জর। চুপ কর্‌। আমার নাম খারাপ করিস নে। আমার নাম কুঞ্জরলাল, তা মিছে কথা বলব না, আমি বলছিলুম, 'যেমন শাস্তর আছে, তেমনি অস্তরও আছে, রাজা যদি শাস্তরের দোহাই না মানে, তখন অস্তর আছে।' কেমন বলেছি ঠাকুর?
  দেবদত্ত। ঠিক বলেছ, তোমার উপযুক্ত কথাই বলেছ। অস্ত্র কী? না বল। তা তোমাদের বল কী? না, 'দুর্বলস্য বলং রাজা।'। কি না, রাজাই দুর্বলের বল। আবার 'বালানাং রোদনং বলং'। রাজার কাছে তোমরা বালক বই নও। অতএব এখানে কান্নাই তোমাদের অস্ত্র। অতএব শাস্তর যদি না খাটে তো তোমাদের অস্ত্র আছে কান্না। বড়ো বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছ। প্রথমে আমাকেই ধাঁধা লেগে গিয়েছিল। তোমার নামটা মনে রাখতে হবে। কী হে তোমার নাম কী।
  কুঞ্জর। আমার নাম কুঞ্জরলাল। কাঞ্জিলাল আমার ভাইপো।
  অন্য সকলে। ঠাকুর, আমাদের মাপ করো, ঠাকুর মাপ করো।
  দেবদত্ত। আমি মাপ করবার কে? তবে দেখো কান্নাকাটি করে দেখো, রাজা যদি মাপ করে।            [প্রস্থান