ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


রাজা ও রানী

প্রথম অঙ্ক

তৃতীয় দৃশ্য

অন্তঃপুর
প্রমোদ-কানন
বিক্রমদেব ও সুমিত্রা


বিক্রমদেব।    মৌনমুগ্ধ সন্ধ্যা ওই মন্দ মন্দ আসে
                   কুঞ্জবনমাঝে, প্রিয়তমে, লজ্জানম্র
                   নববধূসম, সম্মুখে গম্ভীর নিশা
                  বিস্তার করিয়া অন্তহীন অন্ধকার
                  এ কনককান্তিটুকু চাহে গ্রাসিবারে।
                  তেমনি দাঁড়ায়ে আছি হৃদয় প্রসারি
                 ওই হাসি, ওই রূপ, ওই তব জ্যোতি
                  পান করিবারে
দিবালোক-তট হতে
                  এস, নেমে এস, কনক-চরণ দিয়ে
                  এ অগাধ হৃদয়ের নিশীথ-সাগরে।
                  কোথা ছিলে প্রিয়ে?
সুমিত্রা।                   নিতান্ত তোমারি আমি
                  সদা মনে রেখো এ বিশ্বাস। থাকি যবে
                  গৃহকাজে, জেনো নাথ, তোমারি সে গৃহ,
                  তোমারি সে কাজ।
বিক্রমদেব।              থাক্‌ গৃহ, গৃহকাজ।
                  সংসারের কেহ নহ, অন্তরের তুমি।
                  অন্তরে তোমার গৃহ, আর গৃহ নাই

                  বাহিরে কাঁদুক্‌ পড়ে বাহিরের কাজ।
সুমিত্রা।       কেবল অন্তরে তব? নহে, নাথ, নহে

                 রাজন্‌, তোমারি আমি অন্তরে বাহিরে।
                 অন্তরে প্রেয়সী তব বাহিরে মহিষী।
বিক্রমদেব।   হায়, প্রিয়ে, আজ কেন স্বপ্ন মনে হয়
                 সে সুখের দিন? সেই প্রথম মিলন

                 প্রথম প্রেমের ছটা; দেখিতে দেখিতে
                 সমস্ত হৃদয়ে দেহে যৌবনবিকাশ,
                 সেই নিশি-সমাগমে দুরুদুরু হিয়া

                 নয়নপল্লবে লজ্জা, ফুলদলপ্রান্তে
                 শিশিরবিন্দুর মতো; অধরের হাসি
                 নিমেষে জাগিয়া ওঠে নিমেষে মিলায়,
                 সন্ধ্যার বাতাস লেগে কাতরকম্পিত
                 দীপশিখাসম, নয়নে-নয়নে হয়ে
                 ফিরে আসে আঁখি, বেধে যায় হৃদয়ের
                 কথা, হাসে চাঁদ কৌতুকে আকাশে, চাহে
                 নিশীথের তারা, লুকায়ে জানালা-পাশে

                 সেই নিশি-অবসানে আঁখি ছলছল,
                 সেই বিরহের ভয়ে বদ্ধ আলিঙ্গন;
                 তিলেক বিচ্ছেদ লাগি কাতর হৃদয়।
                 কোথা ছিল গৃহকাজ! কোথা ছিল, প্রিয়ে,
                 সংসার-ভাবনা?
সুমিত্রা।                        তখন ছিলাম শুধু
                 ছোট দুটি বালক বালিকা, আজি মোরা
                 রাজা রানী।
বিক্রমদেব।        রাজা রানী! কে রাজা? কে রানী?
                 নহি আমি রাজা। শূন্য সিংহাসন কাঁদে।
                 জীর্ণ রাজকার্যরাশি চূর্ণ হয়ে যায়
                 তোমার চরণতলে ধূলির মাঝারে।
সুমিত্রা।       শুনিয়া লজ্জায় মরি। ছি ছি মহারাজ,
                 এ কি ভালোবাসা? এ যে মেঘের মতন
                রেখেছে আচ্ছন্ন করে মধ্যাহ্ন-আকাশে
                উজ্জ্বল প্রতাপ তব। শোনো প্রিয়তম,
                আমার সকলি তুমি, তুমি মহারাজ,
                তুমি স্বামী
আমি শুধু অনুগত ছায়া,
                তার বেশি নই; আমারে দিয়ো না লাজ,
                আমারে বেসো না ভালো রাজশ্রীর চেয়ে।
বিক্রমদেব।  চাহ না আমার প্রেম?
সুমিত্রা।                                  কিছু চাই নাথ;
                 সব নহে। স্থান দিয়ো হৃদয়ের পাশে,
                 সমস্ত হৃদয় তুমি দিয়ো না আমারে।
বিক্রমদেব।   আজো রমণীর মন নারিনু বুঝিতে।
সুমিত্রা।        তোমরা পুরুষ, দৃঢ় তরুর মতন
                 আপনি অটল রবে আপনার 'পরে
                 স্বতন্ত্র উন্নত, তবে তো আশ্রয় পাব
                 আমরা লতার মতো তোমাদের শাখে।
                 তোমরা সকল মন দিয়ে ফেল যদি
                 কে রহিবে আমাদের ভালোবাসা নিতে,
                 কে রহিবে বহিবারে সংসারের ভার?
                 তোমরা রহিবে কিছু স্নেহময়, কিছু
                 উদাসীন; কিছু মুক্ত, কিছু বা জড়িত

                 সহস্র পাখির গৃহ, পান্থের বিশ্রাম,
                 তপ্ত ধরণীর ছায়া, মেঘের বান্ধব,
                 ঝটিকার প্রতিদ্বন্দ্বী, লতার আশ্রয়।
বিক্রমদেব।   কথা দূর করো প্রিয়ে; হেরো সন্ধ্যাবেলা
                 মৌন-প্রেমসুখে সুপ্ত বিহঙ্গের নীড়,
                 নীরব কাকলি! তবে মোরা কেন দোঁহে
                 কথার উপরে কথা করি বরিষন?
                 অধর অধরে বসি প্রহরীর মতো
                 চপল কথার দ্বার রাখুক রুধিয়া।

                          কঞ্চুকীর প্রবেশ
কঞ্চুকী।      এখনি দর্শনপ্রার্থী মন্ত্রী মহাশয়,
                গুরুতর রাজকার্য, বিলম্ব সহে না।
বিক্রমদেব।  ধিক্‌ তুমি! ধিক্‌ মন্ত্রী! ধিক্‌ রাজকার্য!
                 রাজ্য রসাতলে যাক মন্ত্রী লয়ে সাথে।
                                        [ কঞ্চুকীর প্রস্থান
সুমিত্রা।       যাও, নাথ, যাও।
বিক্রমদেব।                       বার বার এক কথা।
                 নির্মম, নিষ্ঠুর। কাজ, কাজ, যাও যাও।
                 যেতে কি পারি নে আমি? কে চাহে থাকিতে?
                 সবিনয় করপুটে কে মাগে তোমার
                 সযত্নে ওজন-করা বিন্দু বিন্দু কৃপা?
                 এখনি চলিনু।
                                     অয়ি হৃদিলগ্না লতা,
                 ক্ষম মোরে, ক্ষম অপরাধ; মোছো আঁখি,
                 ম্লান মুখে হাসি আনো, অথবা ভ্রূকুটি

                 দাও শাস্তি, করো তিরস্কার।
সুমিত্রা।                                       মহারাজ,
                এখন সময় নয়,-- আসিয়ো না কাছে;
                এই মুছিয়াছি অশ্রু, যাও রাজ-কাজে।
বিক্রমদেব।  হায় নারী, কী কঠিন হৃদয় তোমার!
                 কোনো কাজ নাই প্রিয়ে, মিছে উপদ্রব।
                 ধান্যপূর্ণ বসুন্ধরা, প্রজা সুখে আছে,
                 রাজকার্য চলিছে অবাধে
এ কেবল
                 সামান্য কী বিঘ্ন নিয়ে তুচ্ছ কথা তুলে
                 বিজ্ঞ বৃদ্ধ অমাত্যের অতি-সাবধান।
সুমিত্রা।       ওই শোনো ক্রন্দনের ধ্বনি
সকাতরে
                 প্রজার আহ্বান। ওরে বৎস, মাতৃহীন
                 নস তোরা কেহ, আমি আছি
আমি আছি
                 আমি এ রাজ্যের রানী, জননী তোদের।
                                          [প্রস্থান