ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


রাজা ও রানী

প্রথম অঙ্ক

চতুর্থ দৃশ্য
অন্তঃপুরের কক্ষ
সুমিত্রা

সুমিত্রা।       এখনো এল না কেন? কোথায় ব্রাহ্মণ?
                 ওই ক্রমে বেড়ে ওঠে ক্রন্দনের ধ্বনি।

                            দেবদত্তের প্রবেশ
দেবদত্ত।       জয় হোক।
সুমিত্রা।                       ঠাকুর, কিসের কোলাহল?
দেবদত্ত।       শোন কেন মাতঃ। শুনিলেই কোলাহল।
                  সুখে থাকো, রুদ্ধ করো কান। অন্তঃপুরে,
                  সেথাও কি পশে কোলাহল? শান্তি নেই
                  সেখানেও? বল তো এখনি সৈন্য লয়ে
                  তাড়া করে নিয়ে যাই পথ হতে পথে
                  জীর্ণচীর ক্ষুধিত তৃষিত কোলাহল।
সুমিত্রা।        বলো শীঘ্র কী হয়েছে।
দেবদত্ত।                                  কিছু না, কিছু না।
                 শুধু ক্ষুধা, হীন ক্ষুধা, দরিদ্রের ক্ষুধা।
                 অভদ্র অসভ্য যত বর্বরের দল
                 মরিছে চীৎকার করি ক্ষুধার তাড়নে
                 কর্কশ ভাষায়। রাজকুঞ্জে ভয়ে মৌন
                 কোকিল পাপিয়া যত।
সুমিত্রা।                          আহা কে ক্ষুধিত?
দেবদত্ত।      অভাগ্যের দুরদৃষ্ট। দীন প্রজা যত
                 চিরদিন কেটে গেছে অর্ধাশনে যার
                 আজো তার অনশন হল না অভ্যাস,
                 এমনি আশ্চর্য।
সুমিত্রা।                          হে ঠাকুর, এ কী শুনি।
                 ধান্যপূর্ণ বসুন্ধরা, তবু প্রজা কাঁদে
                 অনাহারে?
দেবদত্ত।                    ধান্য তার বসুন্ধরা যার।
                 দরিদ্রের নহে বসুন্ধরা। এরা শুধু
                 যজ্ঞভূমে কুক্কুরের মতো লোলজিহ্ব
                 একপাশে পড়ে থাকে, পায় ভাগ্যক্রমে
                 কভু যষ্টি, উচ্ছিষ্ট কখনো। বেঁচে যায়
                 দয়া হয় যদি, নহে তো কাঁদিয়া ফেরে
                 পথপ্রান্তে মরিবার তরে।
সুমিত্রা।                                      কী বলিলে,
                 রাজা কি নির্দয় তবে? দেশ অরাজক?
দেবদত্ত।      অরাজক কে বলিবে। সহস্ররাজক।
সুমিত্রা।       রাজকার্যে অমাত্যের দৃষ্টি নাই বুঝি?
দেবদত্ত।      দৃষ্টি নাই? সে কী কথা। বিলক্ষণ আছে।
                 গৃহপতি নিদ্রাগত, তা বলিয়া গৃহে
                 চোরের কি দৃষ্টি নাই? সে যে শনিদৃষ্টি।
                 তাদের কী দোষ? এসেছে বিদেশ হতে
                 রিক্ত হস্তে, সে কি শুধু দীন প্রজাদের
                 আশীর্বাদ করিবারে দুই হাত তুলে?
সুমিত্রা।        বিদেশী! কে তারা? তবে আমার আত্মীয়?
দেবদত্ত।      রানীর আত্মীয় তারা, প্রজার মাতুল,
                 যেমন মাতুল কংস, মামা কালনেমি।
সুমিত্রা।        জয়সেন?
দেবদত্ত।                   ব্যস্ত তিনি প্রজা-সুশাসনে।
                 প্রবল শাসনে তাঁর সিংহগড় দেশে
                 যত উপসর্গ ছিল অন্নবস্ত্র আদি
                 সব গেছে, আছে শুধু অস্থি আর চর্ম।
সুমিত্রা।       শিলাদিত্য?
দেবদত্ত।                     তাঁর দৃষ্টি বাণিজ্যের প্রতি।
                 বণিকের ধনভার করিয়া লাঘব
                 নিজস্কন্ধে করেন বহন।
সুমিত্রা।       যুধাজিৎ?
দেবদত্ত।      নিতান্তই ভদ্রলোক, অতি মিষ্টভাষী।
                 থাকেন বিজয়কোটে মুখে লেগে আছে
                 'বাপু বাছা', আড়চক্ষে চাহেন চৌদিকে,
                 আদরে বুলান হাত ধরণীর পিঠে;
                 যাহা কিছু হাতে ঠেকে যত্নে লন তুলি।
সুমিত্রা।       এ কী লজ্জা। এ কী পাপ। আমার আত্মীয়।
                 পিতৃকুল-অপযশ। ছি ছি এ কলঙ্ক
                 করিব মোচন। তিলেক বিলম্ব নহে।
                                              [ প্রস্থান