ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


রাজা ও রানী

প্রথম অঙ্ক

পঞ্চম দৃশ্য
দেবদত্তের গৃহ
নারায়ণী গৃহকার্যে নিযুক্ত
দেবদত্তের প্রবেশ
 

    দেবদত্ত। প্রিয়ে, বলি ঘরে কিছু আছে কি?
    নারায়ণী। তোমার থাকার মধ্যে আছি আমি। তাও না থাকলেই আপদ চোকে।
    দেবদত্ত। ও আবার কী কথা।
    নারায়ণী। তুমি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে যত রাজ্যের ভিক্ষুক জুটিয়ে আন, ঘরে খুদকুঁড়ো আর বাকি রইল না। খেটে খেটে আমার শরীরও আর থাকে না।
    দেবদত্ত। আমি সাধে আনি? হাতে কাজ থাকলে তুমি থাক ভালো, সুতরাং আমিও ভালো থাকি। আর কিছু না হোক তোমার ওই মুখখানি বন্ধ থাকে।
    নারায়ণী। বটে? তা আমি এই চুপ করলুম। আমার কথা যে তোমার অসহ্য হয়ে উঠেছে তা কে জানত। তা কে বলে আমার কথা শুনতে

    দেবদত্ত। তুমিই বল, আবার কে বলবে? এক কথা না শুনলে দশ কথা শুনিয়ে দাও।
    নারায়ণী। বটে। আমি দশ কথা শোনাই? তা আমি এই চুপ করলুম। আমি একেবারে থামলেই তুমি বাঁচ। এখন কি আর সেদিন আছে
সেদিন গেছে। এখন আবার নতুন মুখের নতুন কথা শুনতে সাধ গিয়েছে এখন আমার কথা পুরোনো হয়ে গেছে।
    দেবদত্ত। বাপ রে। আবার নতুন মুখের নতুন কথা। শুনলে আতঙ্ক হয়। তবু পুরোনো কথাগুলো অনেকটা অভ্যেস হয়ে এসেছে।
    নারায়ণী। আচ্ছা বেশ। এতই জ্বালাতন হয়ে থাক তো আমি এই চুপ করলুম। আমি আর একটি কথাও কব না। আগে বললেই হত
আমি তো জানতুম না। জানলে কে তোমাকে
    দেবদত্ত। আগে বলি নি? কত বার বলেছি। কই, কিছু হল না তো।
    নারায়ণী। বটে। তা বেশ, আজ থেকে তবে এই চুপ করলুম। তুমিও সুখে থাকবে, আমিও সুখে থাকব। আমি সাধে বকি? তোমার রকম দেখে

    দেবদত্ত। এই বুঝি তোমার চুপ করা।
    নারায়ণী। আচ্ছা।    [ বিমুখ
    দেবদত্ত। প্রিয়ে! প্রেয়সী! মধুরভাষিণী! কোকিলগঞ্জিনী!
    নারায়ণী। চুপ করো।
    দেবদত্ত। রাগ কোরো না প্রিয়ে
কোকিলের মতো রং বলছি নে, কোকিলের মতো পঞ্চমস্বর।
    নারায়ণী। যাও যাও বোকো না। কিন্তু তা বলছি, তুমি যদি আরো ভিখিরি জুটিয়ে আন তাহলে হয় তাদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করব, নয় নিজে বনবাসিনী হয়ে বেরিয়ে যাব।
    দেবদত্ত। তা হলে আমিও তোমার পিছনে পিছনে যাব
এবং ভিক্ষুকগুলোও যাবে।
    নারায়ণী। মিছে না। ঢেঁকির স্বর্গেও সুখ নেই।   [ নারায়ণীর প্রস্থান

                  ত্রিবেদীর মালা জপিতে জপিতে প্রবেশ
    ত্রিবেদী। শিব শিব শিব! তুমি রাজপুরোহিত হয়েছ?
    দেবদত্ত। তা হয়েছি, কিন্তু রাগ কেন ঠাকুর? কোনো দোষ ছিল না। মালাও জপি নে, ভগবানের নামও করি নে। রাজার মরজি।
    ত্রিবেদী। পিপীলিকার পক্ষচ্ছেদ হয়েছে। শ্রীহরি।
    দেবদত্ত। আমার উপর রাগ করে শব্দশাস্ত্রের প্রতি উপদ্রব কেন? পক্ষচ্ছেদ নয়, পক্ষোদ্ভেদ।
    ত্রিবেদী। তা ও একই কথা। ছেদও যা ভেদও তা। কথায় বলে ছেদভেদ। হে ভবকাণ্ডারী। যা হোক তোমার যতদূর বার্ধক্য হবার তা হয়েছে।
    দেবদত্ত। ব্রাহ্মণী সাক্ষী এখনো আমার যৌবন পেরোয় নি।
    ত্রিবেদী। আমিও তাই বলছি। যৌবনের দর্পেই তোমার এতটা বার্ধক্য হয়েছে। তা তুমি মরবে। হরি হে দীনবন্ধু।
    দেবদত্ত। ব্রাহ্মণবাক্য মিথ্যে হবে না
তা আমি মরব। কিন্তু সেজন্যে তোমার বিশেষ আয়োজন করতে হবে না; স্বয়ং যম রয়েছেন। ঠাকুর, তোমার চেয়ে আমার সঙ্গে যে তাঁর বেশি কুটুম্বিতা তা নয় সকলেরই প্রতি তাঁর সমান নজর।
    ত্রিবেদী। তোমার সময় নিতান্ত এগিয়ে এসেছে। দয়াময় হরি।
    দেবদত্ত। তা কী করে জানব? দেখেছি বটে আজকাল মরে ঢের লোক
কেউ বা গলায় দড়ি দিয়ে মরে, কেউ বা গলায় কলসী বেঁধে মরে, আবার সর্পাঘাতেও মরে, কিন্তু ব্রহ্মশাপে মরে না। ব্রাহ্মণের লাঠিতে কেউ কেউ মরেছে শুনেছি কিন্তু ব্রাহ্মণের কথায় কেউ মরে না। অতএব যদি শীঘ্র না মরে উঠতে পারি তো রাগ কোরো না ঠাকুর সে আমার দোষ নয়, সে কালের দোষ।
    ত্রিবেদী। প্রণিপাত। শিব শিব শিব।
    দেবদত্ত। আর কিছু প্রয়োজন আছে?
    ত্রিবেদী। না। কেবল এই খবরটা দিতে এলুম। দয়াময়। তা তোমার চালে যদি দু-একটা বেশি কুমড়ো ফলে থাকে তো দিতে পার-- আমার দরকার আছে।
    দেবদত্ত। এনে দিচ্ছি।    [ প্রস্থান