ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


রাজা ও রানী

প্রথম অঙ্ক

ষষ্ঠ দৃশ্য

অন্তঃপুর
পুষ্পোদ্যান
বিক্রমদেব ও রাজমাতুল বৃদ্ধ অমাত্য

বিক্রমদেব।   শুনো না অলীক কথা, মিথ্যা অভিযোগ
                 যুধাজিৎ, জয়সেন, উদয়ভাস্কর,
                 সুযোগ্য সুজন। একমাত্র অপরাধ
                 বিদেশী তাহারাতাই এ রাজ্যের মনে
                 বিদ্বেষ-অনল উদগারিছে কৃষ্ণধূম
                 নিন্দা রাশি রাশি।
অমাত্য।                              সহস্র প্রমাণ আছে,
                 বিচার করিয়া দেখো।
বিক্রমদেব।                             কী হবে প্রমাণ?
                 চলিছে বিশাল রাজ্য বিশ্বাসের বলে

                 যার 'পরে রয়েছে সে ভার, সযতনে
                 তাই সে পালিছে। প্রতিদিন তাহাদের
                 বিচার করিতে হবে নিন্দাবাক্য শুনে,
                 নহে ইহা রাজধর্ম। আর্য, যাও ঘরে,
                 করিয়ো না বিশ্রামে ব্যাঘাত।
অমাত্য।                                        পাঠায়েছে
                মন্ত্রী মোরে; সানুনয়ে করিছে প্রার্থনা
                দর্শন তোমার, গুরু রাজকার্য-তরে।
বিক্রমদেব।  চিরকাল আছে রাজ্য, আছে রাজকার্য

                সুমধুর অবসর শুধু মাঝে মাঝে
                দেখা দেয়, অতি ভীরু, অতি সুকুমার।
                ফুটে ওঠে পুষ্পটির মতো, টুটে যায়
                বেলা না ফুরাতে। কে তারে ভাঙিতে চাহে
                অকালে চিন্তার ভারে? বিশ্রামেরে জেনো
                কর্তব্য কাজের অঙ্গ।
অমাত্য।                                    যাই মহারাজ।   [ প্রস্থান

                 রানীর আত্মীয় অমাত্যের প্রবেশ

অমাত্য।      বিচারের আজ্ঞা হোক।
বিক্রমদেব।                              কিসের বিচার?
অমাত্য।       শুনি নাকি, মহারাজ, নির্দোষীর নামে
                 মিথ্যা অভিযোগ

বিক্রমদেব।                         সত্য হবে! কিন্তু যতক্ষণ
                 বিশ্বাস রেখেছি আমি তোমাদের 'পরে
                 ততক্ষণ থাকো মৌন হয়ে। এ বিশ্বাস
                 ভাঙিবে যখন, তখন আপনি আমি
                 সত্য মিথ্যা করিব বিচার। যাও চলে। [ অমাত্যের প্রস্থান
বিক্রমদেব।   হায় কষ্ট মানব-জীবন। পদে পদে
                 নিয়মের বেড়া। আপন রচিত জালে
                 আপনি জড়িত। অশান্ত আকাঙক্ষা-পাখি
                 মরিতেছে মাথা খুঁড়ে পিঞ্জরে পিঞ্জরে।
                 কেন এ জটিল অধীনতা? কেন এত
                 আত্মপীড়া? কেন এ কর্তব্য-কারাগার?
                 তুই সুখী অয়ি মাধবিকা, বসন্তের
                 আনন্দমঞ্জরী! শুধু প্রভাতের আলো,
                 নিশার শিশির, শুধু গন্ধ, শুধু মধু,
                 শুধু মধুপের গান, বায়ুর হিল্লোল,
                 স্নিগ্ধ পল্লবশয়ন, প্রস্ফুট শোভায়
                 সুনীল আকাশ-পানে নীরবে উত্থান,
                 তার পরে ধীরে ধীরে শ্যাম দূর্বাদলে
                 নীরবে পতন। নাই তর্ক, নাই বিধি,
                 নিদ্রিত নিশায় মর্মে সংশয়দংশন,
                 নিরাশ্বাস প্রণয়ের নিষ্ফল আবেগ।

                           সুমিত্রার প্রবেশ

                এসেছ পাষাণী! দয়া হয়েছে কি মনে?
                হল সারা সংসারের যত কাজ ছিল?
                মনে কি পড়িল তবে অধীন এ জনে
                সংসারের সব শেষে? জান না কি, প্রিয়ে
                সকল কর্তব্য চেয়ে প্রেম গুরুতর!
                প্রেম এই হৃদয়ের স্বাধীন কর্তব্য।
সুমিত্রা।      হায়, ধিক মোরে। কেমনে বোঝাব, নাথ,
               তোমারে যে ছেড়ে যাই সে তোমারি প্রেমে।
               মহারাজ, অধীনার শোনো নিবেদন

               এ রাজ্যের প্রজার জননী আমি। প্রভু,
               পারি নে শুনিতে আর কাতর অভাগা
               সন্তানের করুণ ক্রন্দন। রক্ষা করো
               পীড়িত প্রজারে।
বিক্রমদেব।                      কী করিতে চাহ রানী?
সুমিত্রা।       আমার প্রজারে যারা করিছে পীড়ন
                 রাজ্য হতে দূর করে দাও তাহাদের।
বিক্রমদেব।   কে তাহারা জান?
সুমিত্রা।                               জানি।
বিক্রমদেব।                                 তোমার আত্মীয়!
সুমিত্রা।        নহে মহারাজ। আমার সন্তান চেয়ে
                 নহে তারা অধিক আত্মীয়। এ রাজ্যের
                 অনাথ আতুর যত তাড়িত ক্ষুধিত
                 তারাই আমার আপনার। সিংহাসন-
                 রাজচ্ছত্রছায়ে ফিরে যারা গুপ্তভাবে
                 শিকার-সন্ধানে
তারা দস্যু, তারা চোর।
বিক্রমদেব।   যুধাজিৎ, শিলাদিত্য, জয়সেন তারা।
সুমিত্রা।        এই দণ্ডে তাহাদের দাও দূর করে।
বিক্রমদেব।    আরামে রয়েছে তারা, যুদ্ধ ছাড়া কভু
                  নড়িবে না এক পদ।
সুমিত্রা।                                   তবে যুদ্ধ করো।
বিক্রমদেব।    যুদ্ধ করো! হায় নারী, তুমি কি রমণী?
                   ভালো, যুদ্ধে যাব আমি। কিন্তু তার আগে
                   তুমি মানো অধীনতা, তুমি দাও ধরা

                   ধর্মাধর্ম, আত্মপর, সংসারের কাজ
                   সব ছেড়ে হও তুমি আমারি কেবল।
                   তবেই ফুরাবে কাজ
তৃপ্তমন হয়ে
                   বাহিরিব বিশ্বরাজ্য জয় করিবারে।
                   অতৃপ্ত রাখিবে মোরে যতদিন তুমি
                   তোমার অদৃষ্ট-সম রব তব সাথে।
সুমিত্রা।         আজ্ঞা করো মহারাজ, মহিষী হইয়া
                   আপনি প্রজারে আমি করিব রক্ষণ। [প্রস্থান

বিক্রমদেব।    এমনি করেই মোরে করেছ বিকল।
                   আছ তুমি আপনার মহত্ত্বশিখরে
                   বসি একাকিনী; আমি পাইনে তোমারে।
                   দিবানিশি চাহি তাই। তুমি যাও কাজে,
                   আমি ফিরি তোমারে চাহিয়া। হায় হায়,
                   তোমায় আমায় কভু হবে কি মিলন?

                         দেবদত্তের প্রবেশ
দেবদত্ত।       জয় হোক মহারানী-- কোথা মহারানী,
                  একা তুমি মহারাজ?
বিক্রমদেব।                             তুমি কেন হেথা?
                  ব্রাহ্মণের ষড়যন্ত্র অন্তঃপুরমাঝে?
                  কে দিয়েছে মহিষীরে রাজ্যের সংবাদ?
দেবদত্ত।       রাজ্যের সংবাদ রাজ্য আপনি দিয়েছে।
                  ঊর্ধ্বস্বরে কেঁদে মরে রাজ্য উৎপীড়িত
                  নিতান্ত প্রাণের দায়ে
সে কি ভাবে কভু
                  পাছে তব বিশ্রামের হয় কোনো ক্ষতি?
                  ভয় নাই, মহারাজ, এসেছি কিঞ্চিৎ
                  ভিক্ষা মাগিবার তরে রানীমার কাছে।
                  ব্রাহ্মণী বড়োই রুক্ষ, গৃহে অন্ন নাই,
                 অথচ ক্ষুধার কিছু নাই অপ্রতুল।
                                                          [প্রস্থান
বিক্রমদেব।    সুখী হোক, সুখে থাক্‌ এ রাজ্যের সবে।
                  কেন দুঃখ, কেন পীড়া, কেন এ ক্রন্দন?
                  অত্যাচার, উৎপীড়ন, অন্যায় বিচার,
                 কেন এ-সকল? কেন মানুষের 'পরে
                 মানুষের এত উপদ্রব? দুর্বলের
                 ক্ষুদ্র সুখ, ক্ষুদ্র শান্তিটুকু, তার 'পরে
                 সবলের শ্যেনদৃষ্টি কেন? যাই, দেখি,
                 যদি কিছু খুঁজে পাই শান্তির উপায়।