ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


রাজা ও রানী

প্রথম অঙ্ক

সপ্তম দৃশ্য
মন্ত্রগৃহ
বিক্রমদেব ও মন্ত্রী

বিক্রমদেব।  এই দণ্ডে রাজ্য হতে দাও দূর করে
                 যত সব বিদেশী দস্যুরে। সদা দুঃখ,
                 সদা ভয়, রাজ্য জুড়ে কেবল ক্রন্দন!
                 আর যেন এক দিন না শুনিতে হয়
                 পীড়িত প্রজার এই নিত্য কোলাহল।
মন্ত্রী।           মহারাজ, ধৈর্য চাই। কিছুদিন ধরে
                  রাজার নিয়ত দৃষ্টি পড়ুক সর্বত্র,
                  ভয় শোক বিশৃঙ্খলা তবে দূর হবে।
                  অন্ধকারে বাড়িয়াছে বহুকাল ধরে
                  অমঙ্গল
একদিনে কী করিবে তার?
বিক্রমদেব।    এক দিনে চাহি তারে সমূলে নাশিতে।
                  শত বরষের শাল যেমন সবলে
                  একদিনে কাঠুরিয়া করে ভূমিসাৎ।
মন্ত্রী।            অস্ত্র চাই, লোক চাই

বিক্রমদেব।                               সেনাপতি কোথা?
মন্ত্রী।            সেনাপতি নিজেই বিদেশী।
বিক্রমদেব।                                      বিড়ম্বনা।
                  তবে ডেকে নিয়ে এস দীন প্রজাদের,
                  খাদ্য দিয়ে তাহাদের বন্ধ করো মুখ,
                  অর্থ দিয়ে করহ বিদায়। রাজ্য ছেড়ে
                  যাক চলে, যেথা গিয়ে সুখী হয় তারা।  [ প্রস্থান

                         দেবদত্তের সহিত সুমিত্রার প্রবেশ
সুমিত্রা।        আমি এ রাজ্যের রানী-- তুমি মন্ত্রী বুঝি?
মন্ত্রী।           প্রণাম জননী! দাস আমি। কেন মাতঃ,
                 অন্তঃপুর ছেড়ে আজ মন্ত্রগৃহে কেন।
সুমিত্রা।       প্রজার ক্রন্দন শুনে পারি নে তিষ্ঠিতে
                অন্তঃপুরে। এসেছি করিতে প্রতিকার।
মন্ত্রী।          কী আদেশ মাতঃ।
সুমিত্রা।                              বিদেশী নায়ক
                এ রাজ্যে যতেক আছে করহ আহ্বান
                মোর নামে ত্বরা করি।
মন্ত্রী।                                     সহসা আহ্বানে
               সংশয় জন্মিবে মনে, কেহ আসিবে না।
সুমিত্রা।     মানিবে না রানীর আদেশ?
দেবদত্ত।                                     রাজা রানী
              ভুলে গেছে সবে। কদাচিৎ জনশ্রুতি
              শোনা যায়!
সুমিত্রা।                   কালভৈরবের পূজোৎসবে
              করো নিমন্ত্রণ। সেদিন বিচার হবে।
              গর্বে অন্ধ দণ্ড যদি না করে স্বীকার
              সৈন্যবল কাছাকাছি রাখিয়ো প্রস্তুত।   [ প্রস্থান
দেবদত্ত।   কাহারে পাঠাবে দূত?
মন্ত্রী।                                   ত্রিবেদী ঠাকুরে।
              নির্বোধ সরলমন ধার্মিক ব্রাহ্মণ,
              তার 'পরে কারো আর সন্দেহ হবে না।
দেবদত্ত।   ত্রিবেদী সরল? নির্বুদ্ধিই বুদ্ধি তার,
              সরলতা বক্রতার নির্ভরের দণ্ড।


প্রথম অঙ্ক

অষ্টম দৃশ্
ত্রিবেদীর কুটির
মন্ত্রী ও ত্রিবেদী

    মন্ত্রী। বুঝেছ ঠাকুর, এ কাজ তোমাকে ছাড়া আর কাউকে দেওয়া যায় না।
    ত্রিবেদী। তা বুঝেছি। হরি হে। কিন্তু মন্ত্রী, কাজের সময় আমাকে ডাক, আর পৈরহিত্যের বেলায় দেবদত্তের খোঁজ পড়ে।
    মন্ত্রী। তুমি তো জান ঠাকুর, দেবদত্ত বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ, ওঁকে দিয়ে আর তো কোনো কাজ হয় না। উনি কেবল মন্ত্র পড়তে আর ঘণ্টা নাড়তে পারেন।
    ত্রিবেদী। কেন, আমার কি বেদের উপর কম ভক্তি? আমি বেদ পুজো করি, তাই বেদ পাঠ করবার সুবিধে হয়ে ওঠে না। চন্দনে আর সিঁদুরে আমার বেদের একটা অক্ষরও দেখবার জো নেই। আজই আমি যাব। হে মধুসূদন।
    মন্ত্রী। কী বলবে?
    ত্রিবেদী। তা আমি বলব কালভৈরবের পুজো, তাই রাজা তোমাদের নিমন্ত্রণ করেছেন। আমি খুব বড়োরকম সালংকার দিয়েই বলব। সব কথা এখন মনে আসছে না
পথে যেতে যেতে ভেবে নেব। হরি হে তুমিই সত্য।
    মন্ত্রী। যাবার আগে একবার দেখা করে যেয়ো ঠাকুর। [ প্রস্থান
    ত্রিবেদী। আমি নির্বোধ, আমি শিশু, আমি সরল, আমি তোমাদের কাজ উদ্ধার করবার গোরু! পিঠে বস্তা, নাকে দড়ি, কিছু বুঝব না, শুধু লেজে মোড়া খেয়ে চলব-- আর সন্ধ্যেবেলায় দুটিখানি শুকনো বিচিলি খেতে দেবে। হরি হে, তোমারি ইচ্ছে। দেখা যাবে কে কতখানি বোঝে। ওরে এখনো পুজোর সামগ্রী দিলি নে? বেলা যায় যে। নারায়ণ। নারায়ণ।