ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


রাজা ও রানী

দ্বিতীয় অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য

সিংহগড়
জয়সেনের প্রাসাদ
জয়সেন, ত্রিবেদী ও মিহিরগুপ্ত

    ত্রিবেদী। তা বাপু, তুমি যদি চক্ষু অমন রক্তবর্ণ কর তাহলে আমার আপ্তবিশ্রুতি হবে। ভক্তবৎসল হরি। দেবদত্ত আর মন্ত্রী আমাকে অনেক করে শিখিয়ে দিয়েছে কী বলছিলেম ভালো? আমাদের রাজা কালভৈরবের পুজো নামক একটা উপলক্ষ করে
    জয়সেন। উপলক্ষ করে?
    ত্রিবেদী। হাঁ, তা নয় উপলক্ষই হল, তাতে দোষ হয়েছে কী? মধুসূদন। যা তোমার চিন্তা হতে পারে বটে। উপলক্ষ শব্দটা কিঞ্চিৎ কাঠিন্যরসাসক্ত হয়ে পড়েছে
ওর যা যথার্থ অর্থ সেটা নিরাকার করতে অনেকেরই গোল ঠেকে দেখেছি।
    জয়সেন। তাই তো ঠাকুর, ওর যথার্থ অর্থটাই ঠাওরাচ্ছি।
    ত্রিবেদী। রাম নাম সত্য। তা না হয় উপলক্ষ না বলে উপসর্গ বলা গেল। শব্দের অভাব কী বাপু? শাস্ত্রে বলে শব্দ ব্রহ্ম। অতএব উপলক্ষই বল আর উপসর্গই বল, অর্থ সমানই রইল।
    জয়সেন। তা বটে। রাজা যে আমাদের আহ্বান করেছেন তার উপলক্ষ এবং উপসর্গ পর্যন্ত বোঝা গেল
কিন্তু তার যথার্থ কারণটা কী খুলে বলো দেখি।
    ত্রিবেদী। ওইটে বলতে পারলুম না বাপু
ওইটে আমায় কেউ বুঝিয়ে বলে নি। হরি হে।
    জয়সেন। ব্রাহ্মণ, তুমি বড়ো কঠিন স্থানে এসেছ, কথা গোপন কর তো বিপদে পড়বে।
    ত্রিবেদী। হে ভগবান! হ্যাঁ দেখো বাপু, তুমি রাগ ক'রো না, তোমার স্বভাবটা নিতান্ত যে মধুমত্ত মধুকরের মতো তা বোধ হচ্ছে না।
    জয়সেন। বেশি ব'কো না ঠাকুর, যথার্থ কারণ যা জান বলে ফেলো।
    ত্রিবেদী। বাসুদেব! সকল জিনিসেরই কি যথার্থ কারণ থাকে। যদি বা থাকে তো সকল লোকে কি টের পায়? যারা গোপনে পরামর্শ করেছে তারাই জানে! মন্ত্রী জানে, দেবদত্ত জানে। তা বাপু, তুমি অধিক ভেবো না, বোধ করি সেখানে যাবামাত্রই যথার্থ কারণ অবিলম্বে টের পাবে।
    জয়সেন। মন্ত্রী তোমাকে আর কিছুই বলে নি?
    ত্রিবেদী। নারায়ণ, নারায়ণ! তোমার দিব্য, কিছু বলে নি। মন্ত্রী বললে, "ঠাকুর, যা বললুম তা ছাড়া একটি কথা ব'লো না। দেখো, তোমাকে যেন একটুও সন্দেহ না করে।" আমি বললুম, "হে রাম। সন্দেহ কেন করবে? তবে বলা যায় না! আমি তো সরলচিত্তে বলে যাব, যিনি সন্দগ্ধ হবেন তিনি হবেন!" হরি হে তুমিই সত্য।
    জয়সেন। পুজো উপলক্ষে নিমন্ত্রণ, এ তো সামান্য কথা,
এতে সন্দেহ হবার কী কারণ থাকতে পারে?
    ত্রিবেদী। তোমরা বড়োলোক, তোমাদের এইরকমই হয়। নইলে "ধর্মস্য সূক্ষ্ণা গতি" বলবে কেন? যদি তোমাদের কেউ এসে বলে, "আয় তো রে পাষণ্ড, তোর মুণ্ডুটা টান মেরে ছিঁড়ে ফেলি" অমনি তোমাদের উপলুব্ধ হয় যে, আর যাই হোক লোকটা প্রবঞ্চনা করছে না, মুণ্ডুটার উপরে বাস্তবিক তার নজর আছে বটে। কিন্তু যদি কেউ বলে, "এস তো বাপধন, আস্তে আস্তে তোমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিই", অমনি তোমাদের সন্দেহ হয়। যেন আস্ত মুণ্ডুটা ধরে টান মারার চেয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়া শক্ত কাজ। হে ভগবান, যদি রাজা স্পষ্ট করেই বলত
একবার হাতের কাছে এস তো, তোমাদের একেকটাকে ধরে রাজ্য থেকে নির্বসন করে পাঠাই তাহলে এটা কখনও সন্দেহ করতে না যে, হয়তো বা রাজকন্যার সঙ্গে পরিণাম-বন্ধন করবার জন্যেই রাজা ডেকে থাকবেন। কিন্তু রাজা বলছেন নাকি, "হে বন্ধুসকল, রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠতি স বান্ধব, অতএব তোমরা পুজো উপলক্ষে এখানে এসে কিঞ্চিৎ ফলাহার করবে"অমনি তোমাদের সন্দেহ হয়েছে সে ফলাহারটা কী রকমের না জানি। হে মধুসূদন। তা এমনি হয় বটে। বড়োলোকের সামান্য কথায় সন্দেহ হয়, আবার সামান্য লোকের বড়ো কথায় সন্দেহ হয়।
    জয়সেন। ঠাকুর, তুমি অতি সরল প্রকৃতির লোক। আমার যেটুকু বা সন্দেহ ছিল, তোমার কথায় সমস্ত ভেঙে গেছে।
    ত্রিবেদী। তা লেহ্য কথা বলেছ। আমি তোমাদের মতো বুদ্ধিমান নই-- সকল কথা তলিয়ে বুঝতে পারি নে
কিন্তু, বাবা, সরল পুরাণ-সংহিতায় যাকে বলে, অন্যে পরে কা কথা অর্থাৎ অন্যের কথা নিয়ে কখনো থাকি নে।
    জয়সেন। আর কাকে কাকে তুমি নিমন্ত্রণ করতে বেরিয়েছ?
    ত্রিবেদী। তোমাদের পোড়া নাম আমার মনে থাকে না। তোমাদের কাশ্মীরী স্বভাব যেমন তোমাদের নামগুলোও ঠিক তেমনি শ্রুতিপৌরুষ। তা এ-রাজ্যে তোমাদের গুষ্টির যেখানে যে আছে সকলকেই ডাক পড়েছে। শূলপাণি। কেউ বাদ যাবে না।
    জয়সেন। যাও, ঠাকুর, এখন বিশ্রাম করো গে।
    ত্রিবেদী। যা হোক, তোমার মন থেকে যে সমস্ত সন্দেহ দূর হয়েছে, মন্ত্রী এ-কথা শুনলে ভারি খুশি হবে! মুকুন্দ মুরহর মুরারে। [ প্রস্থান
    জয়সেন। মিহিরগুপ্ত, সমস্ত অবস্থা বুঝলে তো? এখন গৌরসেন যুধাজিৎ উদয়ভাস্কর ওদের কাছে শীঘ্র লোক পাঠাও। বলো, অবিলম্বে সকলে একত্র মিলে একটা পরামর্শ করা আবশ্যক।
    মিহিরগুপ্ত। যে আজ্ঞা।