ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
দ্বিতীয় অঙ্ক
দ্বিতীয় দৃশ্য
অন্তঃপুর
বিক্রমদেব ও রানীর আত্মীয় সভাসদ
সভাসদ। ধন্য
মহারাজ!
বিক্রমদেব।
কেন এত ধন্যবাদ?
সভাসদ।
মহত্ত্বের এই তো লক্ষণ, দৃষ্টি তার
সকলের 'পরে। ক্ষুদ্রপ্রাণ ক্ষুদ্র জনে
পায় না দেখিতে। প্রবাসে পড়িয়া আছে
সেবক যাহারা, জয়সেন, যুধাজিৎ
দেবদত্তের প্রবেশ
দেবদত্ত।
রাজ্যের নায়কগণ রাজ-নিমন্ত্রণ
করিয়াছে অবহেলা, বিদ্রোহের তরে
হয়েছে প্রস্তুত।
সুমিত্রা।
শুনিতেছ মহারাজ?
বিক্রমদেব।
দেবদত্ত, অন্তঃপুর নহে মন্ত্রগৃহ।
দেবদত্ত।
মহারাজ, মন্ত্রগৃহ অন্তঃপুর নহে
তাই সেথা নৃপতির পাই নে দর্শন।
সুমিত্রা।
স্পর্ধিত কুক্কুর যত বর্ধিত হয়েছে
রাজ্যের উচ্ছিষ্ট অন্নে। রাজার বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ করিতে চাহে। এ কী অহংকার।
মহারাজ, মন্ত্রণার আছে কি সময়।
মন্ত্রণার কী আছে বিষয়। সৈন্য লয়ে
যাও অবিলম্বে, রক্তশোষী কীটদের
দলন করিয়া ফেলো চরণের তলে।
বিক্রমদেব। সেনাপতি শত্রুপক্ষ—
সুমিত্রা।
নিজে যাও তুমি।
বিক্রমদেব।
আমি কি তোমার উপদ্রব, অভিশাপ,
দুরদৃষ্ট, দুঃস্বপন, করলগ্ন কাঁটা?
হেথা হতে এক পদ নড়িব না, রানী,
পাঠাইব সন্ধির প্রস্তাব। কে ঘটালে
এই উপদ্রব। ব্রাহ্মণে নারীতে মিলে
বিবরের সুপ্তসর্প জাগাইয়া তুলি
এ কী খেলা। আত্মরক্ষা-অসমর্থ যারা
নিশ্চিন্তে ঘটায় তারা পরের বিপদ।
সুমিত্রা।
ধিক এ অভাগা রাজ্য, হতভাগ্য প্রজা।
ধিক আমি, এ রাজ্যের রানী।
[ প্রস্থান
বিক্রমদেব।
দেবদত্ত,
বন্ধুত্বের এই পুরস্কার? বৃথা আশা।
রাজার অদৃষ্টে বিধি লেখে নি প্রণয়;
ছায়াহীন সঙ্গীহীন পর্বতের মতো
এক মহাশূন্যমাঝে দগ্ধ উচ্চ শিরে
প্রেমহীন নীরস মহিমা; ঝঞ্ঝাবায়ু
করে আক্রমণ, বজ্র এসে বিঁধে, সূর্য
রক্তনেত্রে চাহে; ধরণী পড়িয়া থাকে
চরণ ধরিয়া। কিন্তু ভালোবাসা কোথা।
রাজার হৃদয় সেও হৃদয়ের তরে
কাঁদে। হায় বন্ধু, মানবজীবন লয়ে
রাজত্বের ভান করা শুধু বিড়ম্বনা।
দম্ভ-উচ্চ সিংহাসন চূর্ণ হয়ে গিয়ে
ধরা সাথে হোক সমতল, একবার
হৃদয়ের কাছাকাছি পাই তোমাদের।
বাল্যসখা, রাজা বলে ভুলে যাও মোরে,
একবার ভালো করে করো অনুভব
বান্ধব-হৃদয়-ব্যথা বান্ধব-হৃদয়ে।
দেবদত্ত।
সখা, এ হৃদয় মোর জানিয়ো তোমার।
কেবল প্রণয় নয়, অপ্রণয় তব
সেও আমি সব' অকাতরে, রোষানল
লব বক্ষ পাতি—
যেমন অগাধ সিন্ধু
আকাশের বজ্র লয় বুকে।
বিক্রমদেব।
দেবদত্ত,
সুখনীড় মাঝে কেন হানিছ বিরহ।
সুখস্বর্গ মাঝে কেন আনিছ বহিয়া
হাহাধ্বনি?
দেবদত্ত।
সখা, আগুন লেগেছে ঘরে
আমি শুধু এনেছি সংবাদ। সুখনিদ্রা
দিয়েছি ভাঙায়ে।
বিক্রমদেব।
এর চেয়ে সুখস্বপ্নে
মৃত্যু ছিল ভালো।
দেবদত্ত।
ধিক লজ্জা মহারাজ,
রাজ্যের মৃত্যুর চেয়ে তুচ্ছ স্বপ্নসুখ
বেশি হল?
বিক্রমদেব।
যোগাসনে লীন যোগিবর
তার কাছে কোথা আছে বিশ্বের প্রলয়।
স্বপ্ন এ সংসার। অর্ধশত বর্ষপরে
আজিকার সুখদুঃখ কার মনে রবে?
যাও যাও, দেবদত্ত, যেথা ইচ্ছা তব।
আপন সান্ত্বনা আছে আপনার কাছে।
দেখে আসি ঘৃণাভরে কোথা গেল রানী।
[প্রস্থান