ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


রাজা ও রানী

দ্বিতীয় অঙ্ক
তৃতীয় দৃশ্য

মন্দির
পুরুষবেশে রানী সুমিত্রা, বাহিরে অনুচর

সুমিত্রা।  জগৎ-জননী মাতা, দুর্বল-হৃদয়
            তনয়ারে করিয়ো মার্জনা। আজ সব
            পূজা ব্যর্থ হল
শুধু সে সুন্দর মুখ
            পড়ে মনে, সেই প্রেমপূর্ণ চক্ষু দুটি,
            সেই শয্যা-'পরে একা সুপ্ত মহারাজ।
            হায় মা, নারীর প্রাণ এত কি কঠিন।
            দক্ষযজ্ঞে তুই ঘরে গিয়েছিলি সতী,
            প্রতিপদে আপন হৃদয়খানি তোর
            আপন চরণ দুটি জড়ায়ে কাতরে
            বলে নি কি ফিরে যেতে পতিগৃহপানে।
            সেই কৈলাসের পথে আর ফিরিল না
            ও রাঙা চরণ। মা গো, সেদিনের কথা
            দেখ্‌ মনে করে। জননী, এসেছি আমি
            রমণী-হৃদয় বলি দিতে, রমণীর
            ভালোবাসা, ছিন্ন শতদল সম, দিতে
            পদতলে। নারী তুমি, নারীর হৃদয়
            জান তুমি, বল দাও জননী আমারে।
            থেকে থেকে ওই শুনি রাজগৃহ হতে
            "ফিরে এস, ফিরে এস রানী"
প্রেমপূর্ণ
            পুরাতন সেই কণ্ঠস্বর। খড়্‌গ নিয়ে
            তুমি এস, দাঁড়াও রুধিয়া পথ, বলো,
            "তুমি যাও, রাজধর্ম উঠুক জাগিয়া

            ধন্য হোক রাজা, প্রজা হোক সুখী, রাজ্যে
            ফিরে আসুক কল্যাণ
দূর হোক যত
            অত্যাচার
ভূপতির যশোরশ্মি হতে
            ঘুচে যাক কলঙ্ককালিমা। তুমি নারী
            ধরাপ্রান্তে যেথা স্থান পাও, একাকিনী
            বসে বসে নিজ দুঃখে মরো বুক ফেটে।"
            পিতৃসত্য পালনের তরে রামচন্দ্র
            গিয়াছেন বনে, পতিসত্য পালনের
            লাগি আমি যাব। যে সত্যে আছেন বাঁধা
            মহারাজ রাজলক্ষ্ণী কাছে, কভু তাহা
            সামান্য নারীর তরে ব্যর্থ হইবে না।

                বাহিরের একজন পুরুষ ও স্ত্রীর প্রবেশ

    অনুচর।  কে তোরা। দাঁড়া এইখানে।
    পুরুষ। কেন বাবা। এখানেও কি স্থান নেই।
    স্ত্রী। মা গো। এখানেও সেই সিপাই।

            সুমিত্রার বাহিরে আগমন

    সুমিত্রা। তোমরা কে গো।
    পুরুষ। মিহিরগুপ্ত আমাদের ছেলেটিকে ধরে রেখে আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের চাল নেই, চুলো নেই, মরবার জায়গাটুকু নেই
তাই আমরা মন্দিরে এসেছি। মার কাছে হত্যা দিয়ে পড়ব, দেখি তিনি আমাদের কী গতি করেন।
    স্ত্রী। তা হাঁ গা, এখেনেও তোমরা সিপাই রেখেছ? রাজার দরজা বন্ধ, আবার মায়ের দরজাও আগলে দাঁড়িয়েছ?
    সুমিত্রা। না বাছা, এস তোমরা। এখানে তোমাদের কোনো ভয় নেই। কে তোমাদের উপর দৌরাত্ম্য করেছে।
    পুরুষ। এই জয়সেন। আমরা রাজার কাছে দুঃখু জানাতে গিয়েছিলেম, রাজদর্শন পেলেম না। ফিরে এসে দেখি আমাদের ঘরদোর জ্বালিয়ে দিয়েছে, আমাদের ছেলেটিকে বেঁধে রেখেছে।
    সুমিত্রা। (স্ত্রীলোকের প্রতি) হাঁ গা, তা তুমি রানীকে গিয়ে জানালে না কেন।
    স্ত্রী। ওগো, রানীই তো রাজাকে জাদু করে রেখেছে। আমাদের রাজা ভালো, রাজার দোষ নেই
ওই বিদেশ থেকে এক রানী এসেছে, সে আপন কুটুম্বদের রাজ্য জুড়ে বসিয়েছে। প্রজার বুকের রক্ত শুষে খাচ্ছে গো।
    পুরুষ। চুপ কর্‌ মাগী। তুই রানীর কী জানিস? যে-কথা জানিস নে, তা মুখে আনিস নে।
    স্ত্রী। জানি গো জানি। ওই রানীই তো বসে বসে রাজার কাছে আমাদের নামে যত কথা লাগায়।
    সুমিত্রা। ঠিক বলেছ বাছা। ওই রানী সর্বনাশীই তো যত নষ্টের মূল। তা সে আর বেশি দিন থাকবে না, তার পাপের ভরা পূর্ণ হয়েছে। এই নাও, আমার সাধ্যমত কিছু দিলাম, সব দুঃখ দূর করতে পারি নে।
    পুরুষ। আহা তুমি কোনো রাজার ছেলে হবে, তোমার জয় হোক।
    সুমিত্রা। আর বিলম্ব নয়, এখনি যাব।
                                    [ প্রস্থান
                 ত্রিবেদীর প্রবেশ
    ত্রিবেদী। হে হরি কী দেখলুম। পুরুষমূর্তি ধরে রানী সুমিত্রা ঘোড়ায় চড়ে চলেছেন। মন্দিরে দেবপূজোর ছলে এসে রাজ্য ছেড়ে পালিয়েছেন। আমাকে দেখে বড়ো খুশি। মধুসূদন। ভাবলে ব্রাহ্মণ বড়ো সরল-হৃদয়, মাথার তেলোয় যেমন একগাছি চুল দেখা যায় না, তলায় তেমনি বুদ্ধির লেশমাত্র নেই। একে দিয়ে একটা কাজ করিয়ে নেওয়া যাক। এর মুখ দিয়ে রাজাকে দুটো মিষ্টি কথা পাঠিয়ে দেওয়া যাক। বাবা তোমরা বেঁচে থাকো। যখনি তোমাদের কিছু দরকার পড়বে বুড়ো ত্রিবেদীকে ডেকো, আর দান-দক্ষিণের বেলায় দেবদত্ত আছেন। দয়াময়। তা বলব। খুব মিষ্টি মিষ্টি করেই বলব। আমার মুখে মিষ্টি কথা আরো বেশি মিষ্টি হয়ে ওঠে। কমললোচন। রাজা কী খুশিই হবে। কথাগুলো যত বড়ো বড়ো করে বলব রাজার মুখের হাঁ তত বেড়ে যাবে। দেখেছি, আমার মুখে বড়ো কথাগুলো শোনায় ভালো। লোকের বিশেষ আমোদ বোধ হয়। বলে, ব্রাক্ষণ বড়ো সরল। পতিতপাবন। এবারে কতটা আমোদ হবে বলতে পারি নে। কিন্তু শব্দশান্ত্র একেবারে উলটপালট করে দেব। আঃ কী দুর্যোগ। আজ সমস্ত দিন দেবপুজো হয় নি, এইবার একটু পুজো-অর্চনায় মন দেওয়া যাক। দীনবন্ধু ভক্তবৎসল।        [প্রস্থান