ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


রাজা ও রানী

তৃতীয় অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য

কাশ্মীর
প্রাসাদ-সম্মুখে রাজপথ
দ্বারে শংকর

    শংকর। এতটুকু ছিল, আমার কোলে খেলা করত। যখন কেবল চারটি দাঁত উঠেছে তখন সে আমাকে সংকল দাদা বলত। এখন বড়ো হয়ে উঠেছে, এখন সংকল দাদার কোলে আর ধরে না, এখন সিংহাসন চাই। স্বর্গীয় মহারাজ মরবার সময় তোদের দুটি ভাইবোনকে আমার কোলে দিয়ে গিয়েছিল। বোনটি তো দুদিন বাদে স্বামীর কোলে গেল। মনে করেছিলুম কুমারসেনকে আমার কোল থেকে একেবারে সিংহাসনে উঠিয়ে দেব। কিন্তু খুড়ো-মহারাজ আর সিংহাসন থেকে নাবেন না। শুভলগ্ন কতবার হল, কিন্তু আজ কাল করে আর সময় হল না। কত ওজর কত আপত্তি। আরে ভাই সংকলের কোল এক, আর সিংহাসন এক। বুড়ো হয়ে গেলুম তোকে কি আর রাজাসনে দেখে যেতে পারব।

                        দুইজন সৈনিকের প্রবেশ

    প্রথম সৈনিক। আমাদের যুবরাজ কবে রাজা হবে রে ভাই? সেদিন আমি তোদের সকলকে মহুয়া খাওয়াব।
    দ্বিতীয় সৈনিক। আরে, তুই তো মহুয়া খাওয়াবি
আমি জান্‌ দেব, আমি লড়াই করে করে বেড়াব, আমি পাঁচটা গাঁ লুট করে আনব। আমি আমার মহাজন বেটার মাথা ভেঙে দেব। বলিস তো, আমি খুশি হয়ে যুবরাজের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অম্‌নি মরে পড়ে যাব।
    প্রথম সৈনিক। তা কি আমি পারি নে। মরবার কথা কী বলিস। আমার যদি সওয়া-শ বরষ পরমায়ু থাকে আমি যুবরাজের জন্যে রোজ নিয়মিত দু-সন্ধ্যে দু-বার করে মরতে পারি। তা ছাড়া উপরি আছে।
    দ্বিতীয় সৈনিক। ওরে যুবরাজ তো আমাদেরই। স্বর্গীয় মহারাজ তাকে আমাদেরই হাতে দিয়ে গেছেন। আমরা তাকে কাঁধে করে ঢাক বাজিয়ে রাজা করে দেব। তা কাউকে ভয় করব না

    প্রথম সৈনিক। খুড়ো-মহারাজকে গিয়ে বলব, তুমি নেমে এস; আমরা রাজপুত্তুরকে সিংহাসনে চড়িয়ে আনন্দ করতে চাই।
    দ্বিতীয় সৈনিক। শুনেছিস, পূর্ণিমা তিথিতে যুবরাজের বিয়ে।
    প্রথম সৈনিক। সে তো পাঁচ বৎসর ধরে শুনে এসেছি।
    দ্বিতীয় সৈনিক। এইবার পাঁচ বৎসর পূর্ণ হয়ে গেছে। ত্রিচূড়ের রাজবংশে নিয়ম চলে আসছে যে, পাঁচ বৎসর রাজকন্যার অধীন হয়ে থাকতে হবে। তার পর তার হুকুম হলে বিয়ে হবে।
    প্রথম সৈনিক। বাবা, এ আবার কী নিয়ম। আমরা ক্ষত্রিয়, আমাদের চিরকাল চলে আসছে শ্বশুরের গালে চড় মেরে মেয়েটার ঝুঁটি ধরে টেনে নিয়ে আসি
ঘণ্টা দুয়ের মধ্যে সমস্ত পরিষ্কার হয়ে যায়। তার পরে দশটা বিয়ে করবার ফুরসৎ পাওয়া যায়।
    দ্বিতীয় সৈনিক। যোধমল, সেদিন কী করবি বল্‌ দেখি?
    প্রথম সৈনিক। সেদিন আমিও আরেকটা বিয়ে করে ফেলব।
    দ্বিতীয় সৈনিক। শাবাশ বলেছিস রে ভাই।
    প্রথম সৈনিক। মহিচাঁদের মেয়ে! খাসা দেখতে ভাই। কী চোখ রে। সে দিন বিতস্তায় জল আনতে যাচ্ছিল, দুটো কথা বলতে গেলুম, কঙ্কণ তুলে মারতে এল। দেখলুম চোখের চেয়ে তার কঙ্কণ ভয়ানক। চটপট সরে পড়তে হল।

                                গান
                        ঐ আঁখি রে।
        ফিরে ফিরে চেয়ো না চেয়ো না, ফিরে যাও
                    কী আর রেখেছ বাকি রে।
        মরমে কেটেছ সিঁধ, নয়নের কেড়েছ নিদ
                    কী সুখে পরান আর রাখি রে।

    দ্বিতীয় সৈনিক। শাবাশ ভাই।
    প্রথম সৈনিক। ওই দেখ্‌ শংকরদাদা। যুবরাজ এখানে নেই
তবু বুড়ো সাজসজ্জা করে সেই দুয়োরে বসে আছে। পৃথিবী যদি উলটপালট হয়ে যায় তবু বুড়োর নিয়মের ত্রুটি হবে না।
    দ্বিতীয় সৈনিক। আয় ভাই ওকে যুবরাজের দুটো কথা জিজ্ঞাসা করা যাক।
    প্রথম সৈনিক। জিজ্ঞাসা করলে ও কি উত্তর দেবে? ও তেমন বুড়ো নয়। যেন ভরতের রাজত্বে রামচন্দ্রের জুতোজোড়াটার মতো পড়ে আছে, মুখে কথাটি নেই।
    দ্বিতীয় সৈনিক। (শংকরের নিকটে গিয়া) হাঁ দাদা, বলো না দাদা, যুবরাজ রাজা হবে কবে?
    শংকর। তোদের সে খবরে কাজ কী।
    প্রথম সৈনিক। না না, বলছি আমাদের যুবরাজের বয়স হয়েছে, এখন খুড়ো-রাজা নাবছে না কেন?
    শংকর। তাতে দোষ হয়েছে কী। হাজার হোক, খুড়ো তো বটে।
    দ্বিতীয় সৈনিক। তা তো বটেই। কিন্তু যে-দেশের যেমন নিয়ম
আমাদের নিয়ম আছে যে
    শংকর। নিয়ম তোরা মানবি, আমরা মানব, বড়োলোকের আবার নিয়ম কী। সবাই যদি নিয়ম মানবে তবে নিয়ম গড়বে কে।
    প্রথম সৈনিক। আচ্ছা, দাদা, তা যেন হল
কিন্তু এই পাঁচ বছর ধরে বিয়ে করা এ কেমন নিয়ম দাদা। আমি তো বলি, বিয়ে করা বাণ খাওয়ার মতো চট করে লাগল তীর, তার পরে ইহজন্মের মতো বিঁধে রইল। আর ভাবনা রইল না। কিন্তু দাদা, পাঁচ বৎসর ধরে এ কী রকম কারখানা।
    শংকর। তোদের আশ্চর্য ঠেকবে বলে কি যে-দেশের যা নিয়ম তা উলটে যাবে? নিয়ম তো কারো ছাড়বার জো নেই। এ সংসার নিয়মেই চলছে। যা যা আর বকিস নে যা। এ সকল কথা তোদের মুখে ভালো শোনায় না।
    প্রথম সৈনিক। তা চললুম। আজকাল আমাদের দাদার মেজাজ ভালো নেই। একেবারে শুকিয়ে যেন খড়খড় করছে।

                                [ সৈনিকদ্বয়ের প্রস্থান
                            পুরুষবেশী সুমিত্রার প্রবেশ

সুমিত্রা।     তুমি কি শংকরদাদা?
শংকর।                                 কে তুমি ডাকিলে
                পুরাতন পরিচিত স্নেহভরা সুরে।
                কে তুমি পথিক।
সুমিত্রা।                             এসেছি বিদেশ হতে।
শংকর।       এ কি স্বপ্ন দেখি আমি? কী মন্ত্র-কুহকে
                কুমার আবার এল বালক হইয়া
                শংকরের কাছে। যেন সেই সন্ধ্যাবেলা
                খেলাশ্রান্ত সুকুমার বাল্যতনুখানি
                চরণকমল ক্লিষ্ট, বিবর্ণ কপোল,
                ক্লান্ত শিশু হিয়া, বৃদ্ধ শংকরের বুকে
                বিশ্রাম মাগিছে।
সুমিত্রা।                             জালন্ধর হতে আমি
                এসেছি সংবাদ লয়ে কুমারের কাছে।
শংকর।       কুমারের বাল্যকাল এসেছে আপনি
                কুমারের কাছে। শৈশবের খেলাধুলা
                মনে করে দিতে, ছোটো বোন পাঠায়েছে
                তারে। দূত তুমি এ মূর্তি কোথায় পেলে।
                মিছে বকিতেছি কত। ক্ষমা করো মোরে।
                বলো বলো কী সংবাদ। রানী দিদি মোর
                ভালো আছে, সুখে আছে, পতির সোহাগে,
                মহিষী-গৌরবে? সুখে প্রজাগণ তারে
                মা বলিয়া করে আশীর্বাদ? রাজলক্ষ্মী
                অন্নপূর্ণা বিতরিছে রাজ্যের কল্যাণ?
                ধিক মোরে, শ্রান্ত তুমি পথশ্রমে, চলো
                গৃহে চলো। বিশ্রামের পরে একে একে
                ব'লো তুমি সকল সংবাদ। গৃহে চলো।
সুমিত্রা।       শংকর, মনে কি আছে এখনো রানীরে।
শংকর।       সেই কণ্ঠস্বর। সেই গভীর গম্ভীর
                দৃষ্টি স্নেহভারনত। এ কি মরীচিকা?
                এনেছ কি চুরি করে মোর সুমিত্রার
                ছায়াখানি? মনে নাই তারে? তুমি বুঝি
                তাহারি অতীত স্মৃতি বাহিরিয়া এলে
                আমারি হৃদয় হতে আমারে ছলিতে?
                বার্ধক্যের মুখরতা ক্ষমা করো যুবা।
                বহুদিন মৌন ছিনু
আজ কত কথা
                আসে মুখে, চোখে আসে জল। নাহি জানি
                কেন এত স্নেহ আসে মনে, তোমা 'পরে।
                যেন তুমি চিরপরিচিত। যেন তুমি
                চিরজীবনের মোর আদরের ধন।
                                                        [ প্রস্থান