ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


রাজা ও রানী

তৃতীয় অঙ্ক
পঞ্চম দৃশ্য

ত্রিচূড়
ক্রীড়া-কানন
ইলার সখীগণ

    প্রথম সখী। আলো কোথায় কোথায় দেবে ভাই?
    দ্বিতীয় সখী। আলোর জন্যে ভাবি নে। আলো তো কেবল এক রাত্রি জ্বলবে। কিন্তু বাঁশি এখনো এল না কেন? বাঁশি না বাজলে আমোদ নেই ভাই।
    তৃতীয় সখী। বাঁশি কাশ্মীর থেকে আনতে গেছে, এতক্ষণ এল বোধ হয়। কখন বাজবে ভাই?
    প্রথম সখী। বাজবে লো বাজবে। তোর অদৃষ্টেও একদিন বাজবে।
    তৃতীয় সখী। পোড়াকপাল আর কি! আমি সেইজন্যেই ভেবে মরছি।

                                প্রথম সখীর গান
                        বাজিবে, সখী, বাঁশি বাজিবে

                        হৃদয়রাজ হৃদে রাজিবে।
              বচন রাশি রাশি,         কোথা যে যাবে ভাসি,
                        অধরে লাজ-হাসি সাজিবে।
              নয়নে আঁখিজল         করিবে ছল ছল,
                        সুখবেদনা মনে বাজিবে।
             মরমে মুরছিয়া           মিলাতে চাবে হিয়া
                        সেই চরণযুগ-রাজীবে।

    দ্বিতীয় সখী। তোর গান রেখে দে। এক এক বার মন কেমন হু হু করে উঠেছে। মনে পড়ছে কেবল একটি রাত আলো হাসি বাঁশি আর গান। তার পরদিন থেকে সমস্ত অন্ধকার।
    প্রথম সখী। কাঁদবার সময় ঢের আছে বোন। এই দুটো দিন একটু হেসে আমোদ করে নে। ফুল যদি না শুকোত তাহলে আমি আজ থেকেই মালা গাঁথতে বসতুম।
    দ্বিতীয় সখী। আমি বাসরঘর সাজাব।
    প্রথম সখী। আমি সখীকে সাজিয়ে দেব।
    তৃতীয় সখী। আর আমি কী করব?
    প্রথম সখী। ওলো, তুই আপনি সাজিস। দেখিস যদি যুবরাজের মন ভোলাতে পারিস।
    তৃতীয় সখী। তুই তো ভাই চেষ্টা করতে ছাড়িস নি। তা তুই যখন পারলি নে তখন কি আর আমি পারব। ওলো, আমাদের সখীকে যে একবার দেখেছে তার মন কি আর অমনি পথেঘাটে চুরি যায়। ওই বাঁশি এসেছে। ওই শোন্‌ বেজে উঠেছে।

                        প্রথম সখীর গান

                    ঐ বুঝি বাঁশি বাজে।
                    বনমাঝে, কি মনমাঝে?
        বসন্ত-বায় বহিছে কোথায়, কোথায় ফুটেছে ফুল!
        বল গো সজনী, এ সুখরজনী কোন্‌খানে উদিয়াছে,
                    বনমাঝে, কি মনমাঝে?
        যাব কি যাব না মিছে এ ভাবনা মিছে মরি লোকলাজে।
        কে জানে কোথা সে বিরহ-হুতাশে ফিরে অভিসার-সাজে,
                    বনমাঝে, কি মনমাঝে?

    দ্বিতীয় সখী। ওলো থাম্‌− ওই দেখ্‌ যুবরাজ কুমারসেন এসেছেন।
    তৃতীয় সখী। চল্‌ চল্‌ ভাই, আমরা একটু আড়ালে দাঁড়াই গে। তোরা পারিস, কিন্তু কে জানে ভাই, যুবরাজের সামনে যেতে আমার কেমন করে।
    দ্বিতীয় সখী। কিন্তু কুমার আজ হঠাৎ অসময়ে এলেন কেন।
    প্রথম সখী। ওলো এর কি আর সময়-অসময় আছে। রাজার ছেলে বলে কি পঞ্চশর ওকে ছেড়ে কথা কয়। থাকতে পারবে কেন।
    তৃতীয় সখী। চল্‌ ভাই আড়ালে চল্‌।
                                [ অন্তরালে গমন

                কুমারসেন ও ইলার প্রবেশ

ইলা।         থাক্‌ নাথ, আর বেশি ব'লো না আমারে।
                কাজ আছে, যেতে হবে রাজ্য ছেড়ে, তাই
                বিবাহ স্থগিত রবে কিছুকাল, এর
                বেশি কী আর শুনিব।
কুমারসেন।                             এমনি বিশ্বাস
                মোর 'পরে রেখো চিরদিন। মন দিয়ে
                মন বোঝা যায়; গভীর বিশ্বাস শুধু
                নীরব প্রাণের কথা টেনে নিয়ে আসে।
                প্রবাসীরে মনে ক'রো এই উপবনে,
                এই নির্ঝরিণী-তীরে, এই লতাগৃহে,
                এই সন্ধ্যালোকে, পশ্চিম-গগন-প্রান্তে
                ওই সন্ধ্যাতারা-পানে চেয়ে। মনে ক'রো,
                আমিও প্রদোষে, প্রবাসে তরুর তলে
                একেলা বসিয়া ওই তারকার 'পরে
                তোমারি আঁখির তারা পেতেছি দেখিতে।
                মনে ক'রো মিশিতেছে এই নীলাকাশে
                পুষ্পের সৌরভ-সম তোমার আমার
                প্রেম। এক চন্দ্র উঠিয়াছে উভয়ের
                বিরহরজনী 'পরে।
ইলা।         জানি, জানি, নাথ,
                                        জানি আমি তোমার হৃদয়।
কুমারসেন।  যাই তবে,
                                    অয়ি তুমি অন্তরের ধন, জীবনের
                মর্মস্বরূপিণী, অয়ি সবার অধিক।
                                            [ প্রস্থান

                    সখীগণের প্রবেশ

দ্বিতীয় সখী।     হায় এ কী শুনি।
তৃতীয় সখী।                          সখী, কেন যেতে দিলে।
প্রথম সখী।      ভালোই করেছ। স্বেচ্ছায় না দিলে ছাড়ি
                    বাঁধন ছিঁড়িয়া যায় চিরদিন-তরে!
                    হায় সখী, হায় শেষে নিবাতে হল কি
                    উৎসবের দীপ?
ইলা।                                 সখী, তোরা চুপ কর্‌,
                    টুটিছে হৃদয়। ভেঙে দে ভেঙে দে ওই
                    দীপমালা। বল্‌ সখী, কে দিবে নিবায়ে
                    লজ্জাহীনা পূর্ণিমার আলো? কেন আজ
                    মনে হয়, আমার এ জীবনের সুখ
                    আজি দিবসের সাথে ডুবিল পশ্চিমে।
                    অমনি ইলারে কেন অস্তপথ-পানে
                    সঙ্গে নাহি নিয়ে গেল ছায়ার মতন।