ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
চতুর্থ অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
জালন্ধর
রণক্ষেত্র। শিবির
বিক্রমদেব ও সেনাপতি
সেনাপতি।
বন্দীকৃত শিলাদিত্য, উদয়ভাস্কর;
শুধু যুধাজিৎ পলাতক− সঙ্গে লয়ে
সৈন্যদলবল।
বিক্রমদেব।
চলো তবে অবিলম্বে
তাহার পশ্চাতে। উঠাও শিবির তবে।
ভালোবাসি আমি এই ব্যগ্র ঊর্ধ্বশ্বাস
মানব-মৃগয়া; গ্রাম হতে গ্রামান্তরে,
বন গিরি নদীতীরে দিবারাত্রি এই
কৌশলে কৌশলে খেলা। বাকি আছে আর
কে বা বিদ্রোহীদলের?
সেনাপতি।
শুধু জয়সেন।
কর্তা সে'ই বিদ্রোহের। সৈন্যবল তার
সব চেয়ে বেশি।
বিক্রমদেব।
চলো তবে সেনাপতি,
তার কাছে। আমি চাই উদগ্র সংগ্রাম,
বুকে বুকে বাহুতে বাহুতে− অতি তীব্র
প্রেম-আলিঙ্গন-সম। ভালো নাহি লাগে
অস্ত্রে অস্ত্রে মৃদু ঝনঝনি− ক্ষুদ্র যুদ্ধে
ক্ষুদ্র জয়লাভ।
সেনাপতি।
কথা ছিল আসিবে সে
গোপনে সহসা, করিবে পশ্চাৎ হতে
আক্রমণ; বুঝি শেষে জাগিয়াছে মনে
বিপদের ভয়, সন্ধির প্রস্তাব-তরে
হয়েছে উন্মুখ।
বিক্রমদেব।
ধিক্, ভীরু, কাপুরুষ।
সন্ধি নহে− যুদ্ধ চাই আমি। রক্তে রক্তে
মিলনের স্রোত− অস্ত্রে অস্ত্রে সংগীতের
ধ্বনি। চলো সেনাপতি।
সেনাপতি।
যে আদেশ প্রভু।
[ প্রস্থান
বিক্রমদেব।
এ কী মুক্তি। এ কী পরিত্রাণ। কী আনন্দ
হৃদয়-মাঝারে। অবলার ক্ষীণ বাহু
কী প্রচণ্ড সুখ হতে রেখেছিল মোরে
বাঁধিয়া বিবর-মাঝে। উদ্দাম হৃদয়
অপ্রশস্ত অন্ধকার গভীরতা খুঁজে
ক্রমাগত যেতেছিল রসাতলপানে।
মুক্তি, মুক্তি আজি। শৃঙ্খল বন্দীরে
ছেড়ে আপনি পলায়ে গেছে। এতদিন
এ জগতে কত যুদ্ধ, কত সন্ধি, কত
কীর্তি, কত রঙ্গ− কত কী চলিতেছিল
কর্মের প্রবাহ− আমি ছিনু অন্তঃপুরে
পড়ে; রুদ্ধদল চম্পককোরক-মাঝে
সুপ্ত কীট-সম। কোথা ছিল লোকলাজ,
কোথা ছিল বীরপরাক্রম। কোথা ছিল
এ বিপুল বিশ্বতটভূমি। কোথা ছিল
হৃদয়ের তরঙ্গ-তর্জন। কে বলিবে
আজি মোরে দীন কাপুরুষ। কে বলিবে
অন্তঃপুরচারী। মৃদু গন্ধবহ আজি
জাগিয়া উঠিছে বেগে ঝঞ্ঝাবায়ুরূপে।
এ প্রবল হিংসা ভালো ক্ষুদ্র প্রেম চেয়ে,
প্রলয় তো বিধাতার চরম আনন্দ!
হিংসা এই হৃদয়ের বন্ধন-মুক্তির
সুখ। হিংসা জাগরণ। হিংসা স্বাধীনতা।
সেনাপতির প্রবেশ
সেনাপতি।
আসিছে বিদ্রোহী সৈন্য।
বিক্রমদেব।
চলো, তবে চলো।
চরের প্রবেশ
চর।
রাজন, বিপক্ষদল নিকটে এসেছে।
নাই বাদ্য, নাই জয়ধ্বজা, নাই কোনো
যুদ্ধ-আস্ফালন; মার্জনা-প্রার্থনা তরে
আসিতেছে যেন।
বিক্রমদেব।
থাক্, চাহি না শুনিতে
মার্জনার কথা। আগে আমি আপনারে
করিব মার্জনা; অপযশ রক্তস্রোতে
করিব ক্ষালন। যুদ্ধে চলো সেনাপতি।
দ্বিতীয় চরের প্রবেশ
দ্বিতীয় চর।
বিপক্ষশিবির হতে আসিছে শিবিকা
বোধ করি সন্ধিদূত লয়ে।
সেনাপতি।
মহারাজ,
তিলেক অপেক্ষা করো− আগে শোনা যাক
কী বলে বিপক্ষদূত−
বিক্রমদেব।
যুদ্ধ তার পরে।
সৈনিকের প্রবেশ
সৈনিক।
মহারানী এসেছেন বন্দী ক'রে লয়ে
যুধাজিৎ আর জয়সেনে।
বিক্রমদেব।
কে এসেছে?
সৈনিক।
মহারানী।
বিক্রমদেব।
মহারানী! কোন্ মহারানী?
সৈনিক।
আমাদের মহারানী।
বিক্রমদেব।
বাতুল উন্মাদ!
যাও সেনাপতি। দেখে এস কে এসেছে।
[সেনাপতি প্রভৃতির প্রস্থান
মহারানী এসেছেন বন্দী ক'রে লয়ে
যুধাজিৎ-জয়সেনে! এ কি স্বপ্ন নাকি!
এ কি রণক্ষেত্র নয়? এ কি অন্তঃপুর?
এতদিন ছিলাম কি যুদ্ধের স্বপনে
মগ্ন? সহসা জাগিয়া আজ দেখিব কি
সেই ফুলবন, সেই মহারানী, সেই
পুষ্পশয্যা, সেই সুদীর্ঘ অলস দিন,
দীর্ঘনিশি বিজড়িত ঘুমে জাগরণে?
বন্দী? কারে বন্দী? কী শুনিতে কী শুনেছি?
এসেছে কি আমারে করিতে বন্দী? দূত!
সেনাপতি! কে এসেছে? কারে বন্দী লয়ে?
সেনাপতির প্রবেশ
সেনাপতি।
মহারানী এসেছেন লয়ে কাশ্মীরের
সৈন্যদল− সোদর কুমারসেন সাথে।
এসেছেন পথ হতে যুদ্ধে বন্দী করে
পলাতক যুধাজিৎ আর জয়সেনে।
আছেন শিবিরদ্বারে সাক্ষাতের তরে
অভিলাষী।
বিক্রমদেব।
সেনাপতি, পালাও, পালাও।
চলো, চলো সৈন্য লয়ে− আর কি কোথাও
নাই শত্রু, আর কেহ নাই কি বিদ্রোহী।
সাক্ষাৎ? কাহার সাথে? রমণীর সনে
সাক্ষাতের এ নহে সময়।
সেনাপতি।
মহারাজ−
বিক্রমদেব।
চুপ করো সেনাপতি, শোনো যাহা বলি।
রুদ্ধ করো দ্বার− এ শিবিরে শিবিকার
প্রবেশ নিষেধ।
সেনাপতি।
যে আদেশ মহারাজ।