ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


রাজা ও রানী

চতুর্থ অঙ্ক
দ্বিতীয় দৃশ্য

দেবদত্তের কুটির
দেবদত্ত ও নারায়ণী

    দেবদত্ত। প্রিয়ে, তবে অনুমতি করো− দাস বিদায় হয়।
    নারায়ণী। তা যাও না, আমি তোমাকে বেঁধে রেখেছি না কি?
    দেবদত্ত। ওই তো, ওইজন্যেই তো কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে না− বিদায় নিয়েও সুখ নেই। যা বলি তা করো। ওইখানটায় আছাড় খেয়ে পড়ো। বলো, হা হতোইস্মি, হা ভগবতি ভবিতব্যতে। হা ভগবন্‌ মকরকেতন।
    নারায়ণী। মিছে ব'কো না। মাথা খাও,সত্যি করে বলো, কোথায় যাবে?
    দেবদত্ত। রাজার কাছে।
    নারায়ণী। রাজা তো যুদ্ধু করতে গেছে। তুমি যুদ্ধু করবে নাকি? দ্রোণাচার্য হয়ে উঠেছ?
    দেবদত্ত। তুমি থাকতে আমি যুদ্ধ করব? যা হোক, এবার যাওয়া যাক।
    নারায়ণী। সেই অবধি তো ওই এক কথাই বলছ। তা যাও না। কে তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়ে ধরে রেখেছে?
    দেবদত্ত। হায় মকরকেতন, এখানে তোমার পুষ্পশরের কর্ম নয়− একেবারে আস্ত শক্তিশেল না ছাড়লে মর্মে গিয়ে পৌঁছয় না। বলি ও শিখরদশনা, পক্কবিম্বাধরোষ্ঠী, চোখ দিয়ে জলটল কিছু বেরোবে কি? সেগুলো শীঘ্র শীঘ্র সেরে ফেলো− আমি উঠি।
    নারায়ণী। পোড়া কপাল। চোখের জল ফেলব কী দুঃখে? হাঁ গা, তুমি না গেলে কি রাজার যুদ্ধু চলবে না? তুমি কি মহাবীর ধূম্রলোচন হয়েছ?
    দেবদত্ত। আমি না গেলে রাজার যুদ্ধ থামবে না। মন্ত্রী বার বার লিখে পাঠাচ্ছে রাজ্য ছারখারে যায় কিন্তু মহারাজ কিছুতেই যুদ্ধ ছাড়তে চান না। এদিকে বিদ্রোহ সমস্ত থেমে গেছে।
    নারায়ণী। বিদ্রোহই যদি থেমে গেল তো মহারাজ কার সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাবেন?
    দেবদত্ত। মহারানীর ভাই কুমারসেনের সঙ্গে।
    নারায়ণী। হাঁ গা, সে কী কথা। শ্যালার সঙ্গে যুদ্ধ? বোধ করি রাজায় রাজায় এইরকম করেই ঠাট্টা চলে। আমরা হলে শুধু কান মলে দিতুম। কী বল?
    দেবদত্ত। বড়ো ঠাট্টা নয়। মহারানী কুমারসেনের সাহায্যে জয়সেন ও যুধাজিৎকে যুদ্ধে বন্দী করে মহারাজের কাছে নিয়ে আসেন। মহারাজ তাঁকে শিবিরে প্রবেশ করতে দেন নি।
    নারায়ণী। হাঁ গা, বল কী? তা তুমি এতদিন যাও নি কেন। এ খবর শুনেও বসে আছ? যাও, যাও, এখনি যাও। আমাদের রানীর মতো অমন সতীলক্ষ্ণীকে অপমান করলে? রাজার শরীরে কলি প্রবেশ করেছে।
    দেবদত্ত। বন্দী বিদ্রোহীরা রাজাকে বলেছে− মহারাজ, আমরা তোমারই প্রজা− অপরাধ করে থাকি তুমি শাস্তি দেবে। একজন বিদেশী এসে আমাদের অপমান করবে এতে তোমাকেই অপমান করা হল− যেন তোমার নিজ রাজ্য নিজে শাসন করবার ক্ষমতা নেই। একটা সামান্য যুদ্ধ, এর জন্যে অমনি কাশ্মীর থেকে সৈন্য এল, এর চেয়ে উপহাস আর কী হতে পারে। এই শুনে মহারাজ আগুন হয়ে কুমারসেনকে পাঁচটা ভর্ৎসনা করে এক দূত পাঠিয়ে দেন। কুমারসেন উদ্ধত যুবাপুরুষ, সহ্য করতে পারবে কেন? বোধ করি সেও দূতকে দু-কথা শুনিয়ে দিয়ে থাকবে।
    নারায়ণী। তা বেশ তো− কুমারসেন তো রাজার পর নয়, আপনার লোক, তা কথা চলছিল বেশ তাই চলুক। তুমি কাছে না থাকলে রাজার ঘটে কি দুটো কথাও জোগায় না? কথা বন্ধ করে অস্ত্র চালাবার দরকার কী বাপু। ওই ওতেই তো হার হল।
    দেবদত্ত। আসল কথা একটা যুদ্ধ করবার ছুতো। রাজা এখন কিছুতেই যুদ্ধ ছাড়তে পারছেন না। নানা ছল অন্বেষণ করছেন। রাজাকে সাহস করে দুটো ভালো কথা বলে এমন বন্ধু কেউ নেই। আমি তো আর থাকতে পারছি নে− আমি চললুম।
    নারায়ণী। যেতে ইচ্ছে হয় যাও, আমি কিন্তু একলা তোমার ঘরকন্না করতে পারব না। তা আমি বলে রাখলুম। এই রইল তোমার সমস্ত পড়ে রইল। আমি বিবাগী হয়ে বেরিয়ে যাব।
    দেবদত্ত। রোসো, আগে আমি ফিরে আসি তার পর যেয়ো। বল তো আমি থেকে যাই।
    নারায়ণী। না না তুমি যাও। আমি কি আর তোমাকে সত্যি থাকতে বলছি? ওগো তুমি চলে গেলে আমি একেবারে বুক ফেটে মরব না, সেজন্যে ভেবো না। আমার বেশ চলে যাবে।
    দেবদত্ত। তা কি আর আমি জানি নে? মলয়-সমীরণ তোমার কিছু করতে পারবে না। বিরহ তো সামান্য, বজ্রাঘাতেও তোমার কিছু হয় না!
                                                                    [ প্রস্থানোন্মুখ
    নারায়ণী। হে ঠাকুর, রাজাকে সুবৃদ্ধি দাও ঠাকুর। শীঘ্র শীঘ্র ফিরিয়ে আনো।
    দেবদত্ত। এ-ঘর ছেড়ে কখনো কোথাও যাই নি। হে ভগবান, এদের সকলের উপর তোমার দৃষ্টি রেখো।
                                                                    [ প্রস্থান