ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


রাজা ও রানী

চতুর্থ অঙ্ক
তৃতীয় দৃশ্য

জালন্ধর
কুমারসেনের শিবির
কুমারসেন ও সুমিত্রা

সুমিত্রা।      ভাই, রাজাকে মার্জনা করো; করো রোষ
                আমার উপরে। আমি মাঝে না থাকিলে
                যুদ্ধ করে বীর নাম করিতে উদ্ধার।
                যুদ্ধের আহ্বান শুনে অটল রহিলে
                তবু তুমি; জানি না কি অসম্মান-শেল
                চিরজীবী মৃত্যু-সম মানীর হৃদয়ে?
                আপন ভায়ের হৃদে দুর্ভাগিনী আমি
                হানিতে দিলাম হেন অপমান-শর
                যেন আপনারি হস্তে। মৃত্যু ভালো ছিল,
                ভাই, মৃত্যু ভালো ছিল।
কুমারসেন।                                 জানিস তো বোন
                যুদ্ধ বীরধর্ম বটে, ক্ষমা তার চেয়ে
                বীরত্ব অধিক। অপমান অবহেলা
                কে পারে করিতে মানী ছাড়া?
সুমিত্রা।                                             ধন্য, ভাই,
                ধন্য তুমি। সঁপিলাম এ জীবন মোর
                তোমার লাগিয়া। তোমার এ স্নেহঋণ
                প্রাণ দিয়ে কেমনে করিব পরিশোধ?
                বীর তুমি, মহাপ্রাণ, তুমি নরপতি
                এ নরসমাজ-মাঝে−
কুমারসেন।                             আমি ভাই তোর।
                চল্‌ বোন, আমাদের সেই শৈলগৃহে
                তুষারশিখরঘেরা শুভ্র সুশীতল
                আনন্দ-কাননে। দুটি নির্ঝরের মতো
                একত্রে করেছি খেলা দুই ভাইবোনে,
                এখন আর কি ফিরে যেতে পারিবি নে
                সেই উচ্চ, সেই শুভ্র শৈশব-শিখরে?
সুমিত্রা। ‌    চলো ভাই, চলো। যে ঘরেতে ভাইবোনে
                করিতাম খেলা সেই ঘরে নিয়ে এসো
                প্রেয়সী নারীরে,− সন্ধ্যাবেলা বসে তারে
                তোমার মনের মতো সাজাব যতনে।
                শিখাইয়া দিব তারে তুমি ভালোবাস
                কোন্‌ ফুল, কোন্‌ গান, কোন্‌ কাব্যরস।
                শুনাব বাল্যের কথা; শৈশব-মহত্ত্ব
                তব শিশু হৃদয়ের।
কুমারসেন।                         মনে পড়ে মোর,
                দোঁহে শিখিতাম বীণা। আমি ধৈর্যহীন
                যেতেম পালায়ে। তুই শয্যাপ্রান্তে বসে
                কেশবেশ ভুলে গিয়ে সারা সন্ধ্যাবেলা
                বাজাতিস, গম্ভীর অনন্দমুখখানি।
                সংগীতেরে করে তুলেছিলি তোর সেই
                ছোটো ছোটো অঙ্গুলির বশ।
সুমিত্রা।                                         মনে আছে,
                খেলা হতে ফিরে এসে শোনাতে আমারে
                অদ্ভুত কল্পনা-কথা; কোথা দেখেছিলে
                অজ্ঞাত নদীর ধারে স্বর্ণস্বর্গপুর,
                অলৌকিক কল্পকুঞ্জে কোথায় ফলিত
                অমৃতমধুর ফল; ব্যথিত হৃদয়ে
                সবিস্ময়ে শুনিতাম; স্বপ্নে দেখিতাম
                সেই কিন্নর কানন।
কুমারসেন।                             বলিতে বলিতে
                নিজের কল্পনা শেষে নিজেরে ছলিত।
                সত্য মিথ্যা হত একাকার মেঘ আর
                গিরির মতন; দেখিতে পেতেম যেন
                দূর শৈল-পরপারে রহস্য-নগরী।
                শংকর আসিছে ওই ফিরে। শোনা যাক
                কী সংবাদ।

                        শংকরের প্রবেশ
শংকর।                     প্রভু তুমি, তুমি মোর রাজা,
                ক্ষমা করো বৃদ্ধ এ শংকরে। ক্ষমা করো
                রানী, দিদি মোর। মোরে কেন পাঠাইলে
                দূত করে রাজার শিবিরে। আমি বৃদ্ধ,
                নহি পটু সাবধান বচন-বিন্যাসে,
                আমি কি সহিতে পারি তব অপমান?
                শান্তির প্রস্তাব শুনে যখন হাসিল
                ক্ষুদ্র জয়সেন, হাসিমুখে ভৃত্য যুধাজিৎ
                করিল সুতীব্র উপহাস, সভ্রূভঙ্গে
    ‌            কহিলা বিক্রমদেব জালন্ধররাজ
                তোমারে বালক, ভীরু; মনে হল যেন
                চারিদিকে হাসিতেছে সভাসদ যত
                পরস্পর মুখ চেয়ে, হাসিতেছে দূরে
                দ্বারের প্রহরী− পশ্চাতে আছিল যারা
                তাদের নীরব হাসি ভুজঙ্গের মতো
                যেন পৃষ্ঠে আসি মোর দংশিতে লাগিল।
                তখন ভুলিয়া গেনু শিখেছিনু যত
                শান্তিপূর্ণ মৃদুবাক্য। কহিলাম রোষে−
                "কলহেরে জান তুমি বীরত্ব বলিয়া,
                নারী তুমি, নহ ক্ষত্রবীর। সেই খেদে
                মোর রাজা কোষে লয়ে কোষরুদ্ধ অসি
                ফিরে যেতেছেন দেশে, জানাইনু সবে।"
                শুনিয়া কম্পিততনু জালন্ধরপতি।
                প্রস্তুত হতেছে সৈন্য।
সুমিত্রা।                                   ক্ষমা করো ভাই।
শংকর।       এই কি উচিত তব, কাশ্মীর-তনয়া
                তুমি, ভারতে রটায়ে যাবে কাশ্মীরের
                অপমান-কথা? বীরের স্বধর্ম হতে
                বিরত ক'রো না তুমি আপন ভ্রাতারে,
                রাখো এ মিনতি।
সুমিত্রা।                         ব'লো না, ব'লো না আর
শংকর।       মার্জনা করো ভাই। পদতলে
                পড়িলাম। ওই তব রুদ্ধ কম্পমান
                রোষানল নির্বাণ করিতে চাও? আছে
                মোর হৃদয়-শোণিত। মৌন কেন ভাই।
                বাল্যকাল হতে আমি ভালোবাসা তব
                পেয়েছি না চেয়ে, আজ আমি ভিক্ষা মাগি
                ওই রোষ তব, দাও তাহা।
শংকর।                                         শোনো প্রভু।
কুমারসেন।  চুপ করো বৃদ্ধ। যাও তুমি, সৈন্যদের
                জানাও আদেশ− এখনি ফিরিতে হবে
                কাশ্মীরের পথে।
শংকর।                              হায় এ কী অপমান,
                পলাতক ভীরু বলে রটিবে অখ্যাতি।
সুমিত্রা।      শংকর, বারেক তুই মনে করে দেখ্‌
                সেই ছেলেবেলা। দুটি ছোটো ভাইবোনে
                কোলে বেঁধে রেখেছিলি এক স্নেহপাশে।
                তার চেয়ে বেশি হল খ্যাতি ও অখ্যাতি?
                প্রাণের সম্পর্ক এ যে চিরজীবনের−
                পিতা-মাতা-বিধাতার আশীর্বাদে ঘেরা
                পুণ্য স্নেহতীর্থখানি। বাহির হইতে
                হিংসানলশিখা আনি এ কল্যাণ-ভূমি,
                শংকর, করিতে চাস অঙ্গার-মলিন?
শংকর।       চল্‌ দিদি, চল্‌ ভাই ফিরে চলে যাই
                সেই শান্তিসুধাস্নিগ্ধ বাল্যকাল-মাঝে।