ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


রাজা ও রানী
পঞ্চম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য

কাশ্মীর। প্রাসাদ
রেবতী ও চন্দ্রসেন

রেবতী।      যুদ্ধসজ্জা? কেন যুদ্ধসজ্জা। শত্রু কোথা।
                মিত্র আসিতেছে। সমাদরে ডেকে আনো
                তারে। করুক সে অধিকার কাশ্মীরের
                সিংহাসন। রাজ্যরক্ষা-তরে তুমি এত
                ব্যস্ত কেন। এ কি তব আপনার ধন।
                আগে তারে নিতে দাও, তার পরে ফিরে
                নিয়ো বন্ধুভাবে। তখন এ পররাজ্য
                হবে আপনার।
চন্দ্রসেন।                         চুপ করো, চুপ করো,
                ব'লো না অমন করে। কর্তব্য আমার
                করিব পালন; তার পরে দেখা যাবে
                অদৃষ্ট কী করে।
রেবতী।                            তুমি কী করিতে চাও
                আমি জানি তাহা। যুদ্ধের ছলনা করে
                পরাজয় মানিবারে চাও। তার পর
                চারিদিক রক্ষা করে সুবিধা বুঝিয়া
                কৌশলে করিতে চাও উদ্দেশ্য সাধন।
চন্দ্রসেন।     ছি ছি রানী, এ-সকল কথা শুনি যবে
                তব মুখে, ঘৃণা হয় আপনার 'পরে।
                মনে হয় সত্য বুঝি এমনি পাষণ্ড
                আমি; আপনারে ছদ্মবেশী চোর বলে
                সন্দেহ জনমে। কর্তব্যের পথ হতে
                ফিরায়ো না মোরে।
রেবতী।                                 আমিও পালিব তবে
                কর্তব্য আপন। নিশ্বাস করিয়া রোধ
                বধিব আপন হস্তে সন্তান আপন।
                রাজা যদি না করিবে তারে, কেন তবে
                রোপিলে সংসারে পরাধীন ভিক্ষুকের
                বংশ। অরণ্যে গমন ভালো, মৃত্যু ভালো,
                রিক্তহস্তে পরের সম্পদছায়ে ফেরা
                ধিক্‌ বিড়ম্বনা। জেনো তুমি, রাজভ্রাতা,
                আমার গর্ভের ছেলে সহিবে না কভু
                পরের শাসনপাশ; সমস্ত জীবন
                পরদত্ত সাজ পরে রহিবে না বসে,
                রাজসভা-পুত্তলিকা হয়ে। আমি তারে
                দিয়েছি জনম, আমি তারে সিংহাসন
                দিব,− নহে আমি নিজ হস্তে মৃত্যু দিব
                তারে। নতুবা সে কুমাতা বলিয়া মোরে
                দিবে অভিশাপ।

                        কঞ্চুকীর প্রবেশ
কঞ্চুকী।                             যুবরাজ এসেছেন
                রাজধানীমাঝে। আসিছেন অবিলম্বে
                রাজসাক্ষাতের তরে।
রেবতী।                                 অন্তরালে রব
                আমি। তুমি তারে ব'লো, অস্ত্রশস্ত্র ছাড়ি
                জালন্ধর-রাজপদে অপরাধিভাবে
                করিতে হইবে তারে আত্মসমর্পণ।
চন্দ্রসেন।     যেয়ো না চলিয়া।
রেবতী।                             পারি নে লুকাতে আমি
                হৃদয়ের ভাব। স্নেহের ছলনা করা
                অসাধ্য আমার। তার চেয়ে অন্তরালে
                গুপ্ত থেকে শুনি বসে তোমাদের কথা।
                                                  [ প্রস্থান

                        কুমারসেন ও সুমিত্রার প্রবেশ
কুমারসেন।  প্রণাম।
সুমিত্রা।             প্রণাম তাত।
চন্দ্রসেন।                             দীর্ঘজীবী হও।
কুমারসেন।  বহু পূর্বে পাঠায়েছি সংবাদ, রাজন্‌,
                শত্রুসৈন্য আসিছে পশ্চাতে, আক্রমণ
                করিতে কাশ্মীর। কই রণসজ্জা কই।
                কোথা সৈন্যবল।
চন্দ্রসেন।                         শত্রুপক্ষ কারে বল'।
                বিক্রম কি শত্রু হল? জননী সুমিত্রা,
                বিক্রম কি নহে বৎসে কাশ্মীর-জামাতা?
                সে যদি আসিল গৃহে এতকাল পরে,
                অসি দিয়ে তারে কি করিব সম্ভাষণ?
সুমিত্রা।       হায় তাত, মোরে কিছু ক'রো না জিজ্ঞাসা।
                আমি দুর্ভাগিনী নারী কেন আসিলাম
                অন্তঃপুর ছাড়ি। কোথা লুকাইয়া ছিল
                এত অকল্যাণ। অবলা নারীর ক্ষীণ
                ক্ষুদ্র পদক্ষেপে সহসা উঠিল রুষি
                সর্প শতফণা। মোরে কিছু শুধায়ো না।
                বুদ্ধিহীনা আমি। তুমি সব জান ভাই।
                তুমি জ্ঞানী, তুমি বীর, আমি পদপ্রান্তে
                মৌন ছায়া। তুমি জান সংসারের গতি,
                আমি শুধু তোমারেই জানি।
কুমারসেন।                                     মহারাজ,
                আমাদের শত্রু নহে জালন্ধরপতি,
                নিতান্তই আপনার জন। কাশ্মীরের
                শত্রু তিনি, আসিছেন শত্রুভাব ধরি।
                অকাতরে সহিয়াছি নিজ অপমান,
                কেমনে উপেক্ষা করি রাজ্যের বিপদ।
চন্দ্রসেন।     সেজন্য ভেবো না বৎস, যথেষ্ট রয়েছে
                বল। কাশ্মীরের তরে আশঙ্কা কিছুই
                নাই।
কুমারসেন।        মোর হাতে দাও সৈন্যভার।
চন্দ্রসেন।                                         দেখা
                যাবে পরে। আগে হতে প্রস্তুত হইলে
                অকারণে জেগে ওঠে যুদ্ধের কারণ।
                আবশ্যক কালে তুমি পাবে সৈন্যভার।

                        রেবতীর প্রবেশ
রেবতী।  কে চাহিছে সৈন্যভার?
সুমিত্রা ও কুমারসেন।              প্রণাম জননী।
রেবতী।      যুদ্ধে ভঙ্গ দিয়ে তুমি এসেছ পলায়ে,
                নিতে চাও অবশেষে ঘরে ফিরে এসে
                সৈন্যভার? তুমি রাজপুত্র? তুমি চাও
                কাশ্মীরের সিংহাসন? ছি ছি লজ্জাহীন।
                বনে গিয়ে থাকো লুকাইয়া। সিংহাসনে
                বসো যদি, বিশ্বসুদ্ধ সকলে দেখিবে
                কনককিরীটচূড়া কলঙ্কে অঙ্কিত।
কুমারসেন।  জননী, কী অপরাধ করেছি চরণে?
                কী কঠিন বচন তোমার। এ কি মাতা
                স্নেহের ভর্ৎসনা। বহুদিন হতে তুমি
                অপ্রসন্ন অভাগার 'পরে। রোষদীপ্ত
                দৃষ্টি তব বিঁধে মোর মর্মস্থলে সদা;
                কাছে গেলে চলে যাও কথা না কহিয়া
                অন্য ঘরে; অকারণে কহ তীব্র বাণী
                বলো মাতা, কী করিলে আমারে তোমার
                আপন সন্তান বলে হইবে বিশ্বাস।
রেবতী।       বলি তবে

চন্দ্রসেন।                   ছি ছি, চুপ করো রাণী।
কুমারসেন।                                             মাতঃ,
                অধিক কহিতে কথা নাহিক সময়।
                দ্বারে এল শত্রুদল আমারে করিতে
                আক্রমণ। তাই আমি সৈন্য ভিক্ষা মাগি।
রেবতী।      তোমারে করিয়া বন্দী অপরাধিভাবে
                জালন্ধর-রাজকরে করিব অর্পণ।
                মার্জনা করেন ভালো, নতুবা যেমন
                বিধান করেন শাস্তি নিয়ো নতশিরে।
সুমিত্রা।     ধিক পাপ। চুপ করো মাতা। নারী হয়ে
                রাজকার্যে দিয়ো না দিয়ো না হাত। ঘোর
                অমঙ্গলপাশে সবারে আনিবে টানি,
                আপনি পড়িবে। হেথা হতে চলো ফিরে
                দয়ামায়াহীন ওই সদা ঘূর্ণমান
                কর্মচক্র ছাড়ি। তুমি শুধু ভালোবাসো,
                শুধু স্নেহ করো, দয়া করো, সেবা করো,−
                জননী হইয়া থাকো প্রাসাদ-মাঝারে।
                যুদ্ধ দ্বন্দ্ব রাজ্যরক্ষা আমাদের কার্য
                নহে।
কুমারসেন।  কাল যায়, মহারাজ, কী আদেশ।
চন্দ্রসেন।     বৎস তুমি অনভিজ্ঞ, মনে কর তাই
                শুধু ইচ্ছামাত্রে সব কার্য সিদ্ধ হয়
                চক্ষের নিমেষে। রাজকার্য মনে রেখো
                সুকঠিন অতি। সহস্রের শুভাশুভ
                কেমনে করিব স্থির মুহূর্তের মাঝে।
কুমারসেন।   নির্দয় বিলম্ব তব পিতঃ। বিপদের
                মুখে মোরে ফেলি অনায়াসে, স্থিরভাবে
                বিচার-মন্ত্রণা? প্রণাম, বিদায় হই।
   
                                  [ সুমিত্রাকে লইয়া প্রস্থান
চন্দ্রসেন।     তোমার নিষ্ঠুর বাক্য শুনে দয়া হয়
                কুমারের 'পরে; প্রাণে বাজে, ইচ্ছা করে
                ডেকে নিয়ে বেঁধে তারে রাখি বক্ষ-মাঝে,
                স্নেহ দিয়ে দূর করি আঘাত-বেদনা।
রেবতী।     শিশু তুমি! মনে কর আঘাত না করে
                আপনি ভাঙিবে বাধা? পুরুষের মতো
                যদি তুমি কার্যে দিতে হাত, আমি তবে
                দয়ামায়া করিতাম ঘরে বসে বসে
                অবসর বুঝে। এখন সময় নাই।
                                                            [ প্রস্থান
চন্দ্রসেন।     অতি-ইচ্ছা চলে অতি-বেগে। দেখিতে না
                পায় পথ, আপনারে করে সে নিষ্ফল।
                বায়ুবেগে ছুটে গিয়ে মত্ত অশ্ব যথা
                চূর্ণ করে ফেলে রথ পাষাণ-প্রাচীরে।