ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


রাজা ও রানী
পঞ্চম অঙ্ক
দ্বিতীয় দৃশ্য

কাশ্মীর। হাট
লোকসমাগম

    প্রথম। কেমন হে খুড়ো, গোলা ভরে ভরে যে গম জমিয়ে রেখেছিলে, আজ বেচবার জন্যে এত তাড়াতাড়ি কেন।
    দ্বিতীয়। না বেচলে কি আর রক্ষে আছে। এদিকে জালন্ধরের সৈন্য এল বলে। সমস্ত লুটে নেবে। আমাদের এই মহাজনদের বড়ো বড়ো গোলা আর মোটা মোটা পেট বেবাক ফাঁসিয়ে দেবে। গম আর রুটি দুয়েরই জায়গা থাকবে না।
    মহাজন। আচ্ছা ভাই, আমোদ করে নে। কিন্তু শিগগির তোদের ওই দাঁতের পাটি ঢাকতে হবে। গুঁতো সকলেরই উপর পড়বে।
    প্রথম। সেই সুখেই তো হাসছি বাবা। এবারে তোমায় আমায় একসঙ্গে মরব। তুমি রাখতে গম জমিয়ে, আর আমি মরতুম পেটের জ্বালায়। সেইটে হবে না। এবার তোমাকেও জ্বালা ধরবে। সেই শুকনো মুখখানি দেখে যেন মরতে পারি।
    দ্বিতীয়। আমাদের ভাবনা কী ভাই। আমাদের আছে কী। প্রাণখানা এমনেও বেশিদিন টিকবে না, অমনেও বেশিদিন টিকবে না। এ কটা দিন কষে মজা করে নে ভাই।
    প্রথম। ও জনার্দন, এতগুলি থলে এনেছ কেন। কিছু কিনবে নাকি।
    জনার্দন। একেবারে বছরখানেকের মতো গম কিনে রাখব।
    দ্বিতীয়। কিনলে যেন, রাখবে কোথায়।
    জনার্দন। আজ রাত্তিরেই মামার বাড়ি পালাচ্ছি।
    প্রথম। মামার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছলে তো! পথে অনেক মামা বসে আছে, আদর করে ডেকে নেবে।

                কোলাহল করিতে করিতে এক দল লোকের প্রবেশ
    পঞ্চম। ওরে, কে তোরা লড়াই করতে চাস, আয়।
    প্রথম। রাজি আছি; কার সঙ্গে লড়তে হবে বলে দে।
    পঞ্চম। খুড়ো-রাজা জালন্ধরের সঙ্গে ষড় করে যুবরাজকে ধরিয়ে দিতে চায়।
    দ্বিতীয়। বটে। খুড়ো-রাজার দাড়িতে আমরা মশাল ধরিয়ে দেব!
    অনেকে। আমাদের যুবরাজকে আমরা রক্ষা করব।
    পঞ্চম। খুড়ো-রাজা গোপনে যুবরাজকে বন্দী করতে চেষ্টা করেছিল, তাই আমরা যুবরাজকে লুকিয়ে রেখেছি।
    প্রথম। চল্‌ ভাই, খুড়ো-রাজাকে গুঁড়ো করে দিয়ে আসি গে।
    দ্বিতীয়। চল্‌ ভাই, তার মুণ্ডুখানা খসিয়ে তাকে মুড়ো করে দিই গে।
    পঞ্চম। সে-সব পরে হবে রে। আপাতত লড়তে হবে।
    প্রথম। তা লড়ব। এই হাট থেকেই লড়াই শুরু করে দেওয়া যাক না। প্রথমে ওই মহাজনদের গমের বস্তাগুলো লুটে নেওয়া যাক। তার পরে ঘি আছে, চামড়া আছে, কাপড় আছে।

                    ষষ্ঠের প্রবেশ
    ষষ্ঠ। শুনেছিস, যুবরাজ লুকিয়েছেন শুনে জালন্ধরের রাজা রটিয়েছে, যে তার সন্ধান বলে দেবে তাকে পুরস্কার দেবে।
    পঞ্চম। তোর এ-সব খবরে কাজ কী?
    দ্বিতীয়। তুই পুরস্কার নিবি নাকি?
    প্রথম। আয় না ভাই, ওকে সবাই মিলে পুরস্কার দিই। যা হয় একটা কাজ আরম্ভ করে দেওয়া যাক। চুপ করে বসে থাকতে পারি নে।
    ষষ্ঠ। আমাকে মারিস নে ভাই, দোহাই বাপসকল। আমি তোদের সাবধান করে দিতে এসেছি।
    দ্বিতীয়। বেটা তুই আপনি সাবধান হ।
    পঞ্চম। এ খবর যদি তুই রটাবি তাহলে তোর জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব।

                দূরে কোলাহল

    অনেকে মিলিয়া। এসেছে− এসেছে।
    সকলে। ওরে এসেছে রে, জালন্ধরের সৈন্য এসে পৌঁচেছে।
    প্রথম। তবে আর কী। এবারে লুঠ করতে চললুম। ওই জনার্দন থলে ভরে গোরুর পিঠে বোঝাই করছে। এই বেলা চল্‌। ওই জনার্দনটাকে বাদ দিয়ে বাকি কটা গোরু বোঝাই-সুদ্ধ তাড়া করা যাক।
    দ্বিতীয়। তোরা যা ভাই। আমি তামাশা দেখে আসি। সার বেঁধে খোলা তলোয়ার হাতে যখন সৈন্য আসে আমার দেখতে বড়ো মজা লাগে।

                        গান

        যমের দুয়োর খোলা পেয়ে
            ছুটেছে সব ছেলেমেয়ে।
                    হরিবোল হরিবোল।
        রাজ্য জুড়ে মস্ত খেলা
            মরণ-বাঁচন অবহেলা

       
ও ভাই, সবাই মিলে প্রাণটা দিলে
            সুখ আছে কি মরার চেয়ে।
                    হরিবোল হরিবোল।
        বেজেছে ঢোল, বেজেছে ঢাক,
            ঘরে ঘরে পড়েছে ডাক,
        এখন কাজকর্ম চুলোতে যাক−
            কেজো লোক সব আয় রে ধেয়ে।
                    হরিবোল হরিবোল।
            রাজা প্রজা হবে জড়ো,
                    থাকবে না আর ছোটো বড়ো,
        একই স্রোতের মুখে ভাসবে সুখে
                বৈতরণীর নদী বেয়ে।
                    হরিবোল হরিবোল।