ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
অমরুরাজ।
পালাও, পালাও। এসো না আমার রাজ্যে।
আপনি মজিবে তুমি আমারে মজাবে।
তোমারে আশ্রয় দিয়ে চাহি নে হইতে
অপরাধী জালন্ধর-রাজ-কাছে। হেথা
তব নাহি স্থান।
কুমারসেন।
আশ্রয় চাহি নে আমি।
অনিশ্চিত অদৃষ্টের পারাবার-মাঝে
ভাসাইব জীবন-তরণী,− তার আগে
ইলারে দেখিয়া যাব একবার শুধু
এই ভিক্ষা মাগি।
অমরুরাজ।
ইলারে দেখিয়া যাবে?
কী হইবে দেখে তারে। কী হইবে দেখা
দিয়ে। স্বার্থপর। রয়েছ মৃত্যুর মুখে
অপমান বহি− গৃহহীন, আশাহীন,
কেন আসিয়াছ ইলার হৃদয়-মাঝে
জাগাতে প্রেমের স্মৃতি।
কুমারসেন।
কেন আসিয়াছি?
হায় আর্য, কেমনে তা বোঝাব তোমায়।
অমরুরাজ।
বিপদের খরস্রোতে ভেসে চলিয়াছ,
তুমি কেন চাহিছ ধরিতে ক্ষীণপ্রাণ
কুসুমিত তীর-লতা? যাও, ভেসে যাও।
কুমারসেন।
আমার বিপদ আজ দোঁহার বিপদ,
মোর দুঃখ দু-জনার দুঃখ। প্রেম শুধু
সম্পদের নহে। মহারাজ, একবার
বিদায় লইতে দাও দু দণ্ডের তরে।
অমরুরাজ।
চিরকাল-তরে তুমি লয়েছ বিদায়।
আর নহে। যাও চলে। ভুলে যেতে দাও
তারে অবসর। হাসিমুখখানি তার
দিয়ো না আঁধার করি এ-জন্মের মতো।
কুমারসেন।
ভুলিতে পারিত যদি দিতাম ভুলিতে।
ফিরে এসে দেখা দিব বলে গিয়েছিনু;
জানি সে রয়েছে বসি আমার লাগিয়া
পথপানে চাহি, আমারে বিশ্বাস করি।
সে সরল সে অগাধ বিশ্বাস তাহার
কেমনে ভাঙিতে দিব।
অমরুরাজ।
সে বিশ্বাস ভেঙে
যাক একেবারে। নতুবা নূতন পথে
জীবন তাহার ফিরাতে সে পারিবে না।
চিরকাল দুঃখতাপ চেয়ে কিছুকাল
এ যন্ত্রণা ভালো।
কুমারসেন।
তার সুখদুঃখ তুমি
দিয়েছ আমার হাতে, কিছুতে ফিরায়ে
নিতে পারিবে না আর। তারে তুমি আর
নাহি জান। তারে আর নারিবে বুঝিতে।
তুমি যারে সুখদুঃখ বলে মনে কর
তার সুখদুঃখ তাহা নহে। একবার
দেখে যাই তারে।
অমরুরাজ।
আমি তারে জানায়েছি,
কাশ্মীরে রয়েছ তুমি রাজমর্যাদায়
ক্ষুদ্র বলে আমাদের অবহেলা করে;
বিদেশে সংগ্রাম-যাত্রা মিছে ছল শুধু
বিবাহ ভাঙিতে।
কুমারসেন।
ধিক, ধিক প্রতারণা।
সরল বালিকা সে কি তোমার দুহিতা?
এ নিষ্ঠুর মিথ্যা তারে কহিলে যখন
বিধাতা কি ঘুমাইতেছিল? শিরে তব
বজ্র পড়িল না ভেঙে? এখনো সে বেঁচে
রয়েছে কি? যেতে দাও, যেতে দাও মোরে−
দিবে না কি যেতে? হানো তবে তরবারি−
ব'লো তারে মরে গেছি আমি। প্রতারণা
ক'রো না তাহারে।
শংকরের প্রবেশ
শংকর।
আসিছে সন্ধানে তব
শত্রুচর, পেয়েছি সংবাদ। এইবেলা
চলো যাই।
কুমারসেন।
কোথা যাব। কী হবে লুকায়ে।
এ জীবন পারি নে বহিতে।
শংকর।
বনপ্রান্তে
তোমার অপেক্ষা করি আছেন সুমিত্রা।
কুমারসেন।
চলো, যাই চলো। ইলা, কোথা আছ ইলা?
ফিরে গেনু দুয়ারে আসিয়া। দুর্ভাগ্যের
দিনে জগতের চারিদিকে রুদ্ধ হয়
আনন্দের দ্বার। প্রিয়ে, হতভাগ্য আমি,
তাই বলে নহি অবিশ্বাসী। চলো, যাই।