ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
জয়সেন।
কোথায় সে পালাবে রাজন্! ধরে এনে
দিব তারে রাজপদে। বিবর-দুয়ারে
অগ্নি দিলে বাহিরিয়া আসে ভুজঙ্গম
উত্তাপকাতর। সমস্ত কাশ্মীর ঘিরি
লাগাব আগুন; আপনি সে ধরা দিবে।
বিক্রমদেব।
এতদূর এনু পিছে পিছে,− কত বন,
কত নদী, কত তুঙ্গ গিরিশৃঙ্গ ভাঙি;
আজ সে পালাবে হাত ছেড়ে? চাহি তারে,
চাহি তারে আমি। সে না হলে সুখ নাই,
নিদ্রা নাই মোর। শীঘ্র না পাইলে তারে,
সমস্ত কাশ্মীর আমি খণ্ড দীর্ণ করি
দেখিব কোথা সে আছে।
যুধাজিৎ।
ধরিবারে তারে
পুরস্কার করেছি ঘোষণা।
বিক্রমদেব।
তারে পেলে
অন্য কার্যে দিতে পারি হাত। রাজ্য মোর
রয়েছে পড়িয়া; শূন্যপ্রায় রাজকোষ;
দুর্ভিক্ষ হয়েছে রাজা অরাজক দেশে;
ফিরিতে পারি নে তবু। এ কী দৃঢ়পাশে
আমারে করেছে বন্দী শত্রু পলাতক।
সচকিতে সদা মনে হয়, এই এল,
এই এল, ওই দেখা যায়, ওই বুঝি
উড়ে ধুলা, আর দেরি নাই, এইবার
বুঝি পাব তারে ধাবমান ঘনশ্বাস
ত্রস্ত-আঁখি মৃগ-সম। শীঘ্র আনো তারে
জীবিত কি মৃত। ছিন্নভিন্ন হয়ে যাক
মায়াপাশ। নতুবা যা কিছু আছে মোর
সব যাবে অধঃপাতে।
প্রহরীর প্রবেশ
প্রহরী।
রাজা চন্দ্রসেন,
মহিষী রেবতী, এসেছেন ভেটিবার
তরে।
বিক্রমদেব।
তোমরা সরিয়া যাও।
( প্রহরীকে )
নিয়ে এস
তাঁহাদের প্রণাম জানায়ে।
[ অন্য সকলের প্রস্থান
কী বিপদ।
আসিছেন শাশুড়ী আমার। কী বলিব
শুধাইলে কুমারের কথা। কী বলিব
মার্জনা চাহেন যদি যুবরাজ-তরে,
সহিতে পারি নে আমি অশ্রু রমণীর।
চন্দ্রসেন ও রেবতীর প্রবেশ
প্রণাম। প্রণাম আর্যা।
চন্দ্রসেন।
চিরজীবী হও।
রেবতী।
জয়ী হও, পূর্ণ হোক মনস্কাম তব।
চন্দ্রসেন।
শুনেছি তোমার কাছে কুমার হয়েছে
অপরাধী।
বিক্রমদেব।
অপমান করেছে আমারে।
চন্দ্রসেন।
বিচারে কী শাস্তি তার করেছ বিধান।
বিক্রমদেব।
বন্দিভাবে অপমান করিলে স্বীকার,
করিব মার্জনা।
রেবতী।
এই শুধু? আর কিছু
নয়? অবশেষে মার্জনা করিবে যদি
তবে কেন এত ক্লেশে এত সৈন্য লয়ে
এত দূরে আসা।
বিক্রমদেব।
ভর্ৎসনা ক'রো না মোরে।
রাজার প্রধান কাজ আপনার মান
রক্ষা করা। যে মস্তক মুকুট বহিছে
অপমান পারে না বহিতে। মিছে কাজে
আসি নি হেথায়।
চন্দ্রসেন।
ক্ষমা তারে করো, বৎস,
বালক সে অল্পবুদ্ধি। ইচ্ছা কর যদি
রাজ্য হতে করিয়ো বঞ্চিত− কেড়ে নিয়ো
সিংহাসন-অধিকার। নির্বাসন সেও
ভালো, প্রাণে বধিয়ো না।
বিক্রমদেব।
চাহি না বধিতে।
রেবতী।
তবে কেন এত অস্ত্র এনেছ বহিয়া।
এত অসি শর? নির্দোষী সৈনিকদের
বধ করে যাবে, যথার্থ যে জন দোষী
ক্ষমিবে তাহারে?
বিক্রমদেব।
বুঝিতে পারি নে দেবী,
কী বলিছ তুমি।
চন্দ্রসেন।
কিছু নয়, কিছু নয়।
আমি তবে বলি বুঝাইয়া। সৈন্য যবে
মোর কাছে মাগিল কুমার আমি তারে
কহিলাম, বিক্রম স্নেহের পাত্র মোর,
তার সনে যুদ্ধ নাহি সাজে। সেই ক্ষোভে
ক্রুদ্ধ যুবা প্রজাদের ঘরে ঘরে গিয়া
বিদ্রোহে করিল উত্তেজিত। অসন্তুষ্ট
মহারানী তাই; রাজবিদ্রোহীর শাস্তি
করিছে প্রার্থনা তোমা-কাছে। গুরুদণ্ড
দিয়ো না তাহারে, সে যে অবোধ বালক।
বিক্রমদেব।
আগে তারে বন্দী করে আনি। তার পরে
যথাযোগ্য করিব বিচার।
রেবতী।
প্রজাগণ
লুকায়ে রেখেছে তারে। আগুন জ্বালাও
ঘরে ঘরে তাহাদের। শস্যক্ষেত্র করো
ছারখার। ক্ষুধা-রাক্ষসীর হাতে সঁপি
দাও দেশ, তবে তারে করিবে বাহির।
চন্দ্রসেন।
চুপ করো চুপ করো রানী। চলো বৎস,
শিবির ছাড়িয়া চলো কাশ্মীর-প্রাসাদে।
বিক্রমদেব।
পরে যাব, অগ্রসর হও মহারাজ।
[ চন্দ্রসেন ও রেবতীর প্রস্থান
ওরে হিংস্র নারী! ওরে নরকাগ্নিশিখা!
বন্ধুত্ব আমার সনে! এতদিন পরে
আপনার হৃদয়ের প্রতিমূর্তিখানা
দেখিতে পেলেম ওই রমণীর মুখে।
অমনি শাণিত ক্রুর বক্র জ্বালারেখা
আছে কি ললাটে মোর। রুদ্ধ হিংসাভারে
অধরের দুই প্রান্ত পড়েছে কি নুয়ে।
অমনি কি তীক্ষ্ণ মোর উষ্ণ তিক্ত বাণী
খুনীর ছুরির মতো বাঁকা বিষমাখা।
নহে নহে কভু নহে। এ হিংসা আমার
চোর নহে, ক্রুর নহে, নহে ছদ্মবেশী।
প্রচণ্ড প্রেমের মতো প্রবল এ জ্বালা
অভ্রভেদী সর্বগ্রাসী উদ্দাম উন্মাদ
দুর্নিবার। নহি আমি তোদের আত্মীয়।
হে বিক্রম, ক্ষান্ত করো এ সংহার-খেলা।
এ শ্মশান-নৃত্য তব থামাও থামাও,
নিবাও এ চিতা। পিশাচ-পিশাচী যত
অতৃপ্ত হৃদয়ে লয়ে দীপ্ত হিংসাতৃষা
ফিরে যাক রুদ্ধ রোষে, লালায়িত লোভে।
এক দিন দিব বুঝাইয়া, নহি আমি
তোমাদের কেহ। নিরাশ করিব এই
গুপ্ত লোভ, বক্র রোষ, দীপ্ত হিংসাতৃষা।
দেখিব কেমন করে আপনার বিষে
আপনি জ্বলিয়া মরে নর-বিষধর।
রমণীর হিংস্র মুখ সূচিময় যেন−
কী ভীষণ, কী নিষ্ঠুর, একান্ত কুৎসিত।
চরের প্রবেশ
চর।
ত্রিচূড়ের অভিমুখে গেছেন কুমার।
বিক্রমদেব।
এ সংবাদ রাখিয়ো গোপনে। একা আমি
যাব সেথা মৃগয়ার ছলে।
চর।
যে আদেশ।