ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
কুমারসেন।
কত রাত্রি?
সুমিত্রা।
রাত্রি আর নাই ভাই। রাঙা
হয়ে উঠেছে আকাশ। শুধু বনচ্ছায়া
অন্ধকার রাখিয়াছে বেঁধে।
কুমারসেন।
সারা রাত্রি
জেগে বসে আছ, বোন, ঘুম নেই চোখে?
সুমিত্রা।
জাগিয়াছি দুঃস্বপন দেখে। সারা রাত
মনে হয় শুনি যেন পদশব্দ কার
শুষ্ক পল্লবের 'পরে। তরু-অন্তরালে
শুনি যেন কাহাদের চুপি চুপি কথা,
বিজন মন্ত্রণা। শ্রান্ত আঁখি যদি কভু
মুদে আসে, দারুণ দুঃস্বপ্ন দেখে কেঁদে
জেগে উঠি। সুখসুপ্ত মুখখানি তব
দেখে পুন প্রাণ পাই প্রাণে।
কুমারসেন।
দুর্ভাবনা
দুঃস্বপ্ন-জননী। ভেবো না আমার তরে
বোন। সুখে আছি। মগ্ন হয়ে জীবনের
মাঝখানে, কে জেনেছে জীবনের সুখ?
মরণের তটপ্রান্তে বসে, এ যেন গো
প্রাণপণে জীবনের একান্ত সম্ভোগ।
এ সংসারে যত সুখ, যত শোভা, যত
প্রেম আছে, সকলি প্রগাঢ় হয়ে যেন
আমারে করিছে আলিঙ্গন। জীবনের
প্রতি বিন্দুটিতে যত মিষ্ট আছে, সব
আমি পেতেছি আস্বাদ। ঘন বন,
তুঙ্গ শৃঙ্গ, উদার আকাশ, উচ্ছ্বসিত
নির্ঝরিণী−
আশ্চর্য এ শোভা। অযাচিত
ভালোবাসা অরণ্যের পুষ্পবৃষ্টি-সম
অবিশ্রাম হতেছে বর্ষণ। চারিদিকে
ভক্ত প্রজাগণ। তুমি আছ প্রীতিময়ী
শিয়রে বসিয়া। উড়িবার আগে বুঝি
জীবন-বিহঙ্গ বিচিত্র-বরন পাখা
করিছে বিস্তার।−
ওই শোনো কাঠুরিয়া
গান গায়−
শোনা যাবে রাজ্যের সংবাদ।
কাঠুরিয়ার প্রবেশ ও গান
বঁধু, তোমায় করব রাজা তরুতলে।
বনফুলের বিনোদ-মালা দেব গলে।
সিংহাসনে বসাইতে
হৃদয়খানি দেব পেতে−
অভিষেক করব তোমায় আঁখিজলে।
অগ্রসর হইয়া
কুমারসেন। বন্ধু, আজি কী সংবাদ?
কাঠুরিয়া।
ভালো নয় প্রভু।
জয়সেন কাল রাত্রে জ্বালায়ে দিয়েছে
নন্দীগ্রাম; আজ আসে পাণ্ডুপুর-পানে।
কুমারসেন।
হায়, ভক্ত প্রজা মোর, কেমনে তোদের
রক্ষা করি? ভগবান, নির্দয় কেন গো
নির্দোষ দীনের 'পরে?
সুমিত্রার প্রতি
কাঠুরিয়া। জননী, এনেছি
কাষ্ঠভার, রাখি শ্রীচরণে।
সুমিত্রা।
বেঁচে থাক।
[ কাঠুরিয়ার প্রস্থান
মধুজীবীর প্রবেশ
কুমারসেন।
কী সংবাদ?
মধুজীবী।
সাবধানে থেকো যুবরাজ।
তোমারে যে ধরে দেবে জীবিত কি মৃত
পুরস্কার পাইবে সে, ঘোষণা করেছে
যুধাজিৎ।
বিশ্বাস ক'রো না কারে প্রভু।
কুমারসেন।
বিশ্বাস করিয়া মরা ভালো; অবিশ্বাস
কাহারে করিব? তোরা সব অনুরক্ত
বন্ধু মোর সরল-হৃদয়।
মধুজীবী।
মা-জননী,
এনেছি সঞ্চয় করে কিছু বনমধু
দয়া করে করো মা গ্রহণ।
সুমিত্রা।
ভগবান
মঙ্গল করুন তোর।
[ মধুজীবীর প্রস্থান
শিকারীর প্রবেশ
শিকারী।
জয় হোক প্রভু।
ছাগ-শিকারের তরে যেতে হবে দূর
গিরিদেশে, দুর্গম সে পথ। তব পদে
প্রণাম করিয়া যাব। জয়সেন গৃহ
মোর দিয়াছে জ্বালায়ে।
কুমারসেন।
ধিক সে পিশাচ।
শিকারী।
আমরা শিকারী। যতদিন বন আছে
আমাদের কে পারে করিতে গৃহহীন?
কিছু খাদ্য এনেছি জননী, দরিদ্রের
তুচ্ছ উপহার। আশীর্বাদ করো যেন
ফিরে এসে আমাদের যুবরাজে দেখি
সিংহাসনে।
বাহু বাড়াইয়া
কুমারসেন। এস তুমি, এস আলিঙ্গনে।
[ শিকারীর প্রস্থান
ওই দেখো পল্লব ভেদিয়া পড়িতেছে
রবিকররেখা । যাই নির্ঝরের ধারে,
স্নানসন্ধ্যা করি সমাপন । শিলাতটে
বসে বসে কতক্ষণ দেখি আপনার
ছায়া, আপনারে ছায়া বলে মনে হয়।
নদী হয়ে গেছে চলে এই নির্ঝরিণী
ত্রিচূড়-প্রমোদবন দিয়ে । ইচ্ছা করে
ছায়া মোর ভেসে যায় স্রোতে, যেথা সেই
সন্ধ্যাবেলা বসে থাকে তীরতরুতলে
ইলা−
তার ম্লান ছায়াখানি সঙ্গে নিয়ে
চিরকাল ভেসে যায় সাগরের পানে ।
থাক্ থাক্ কল্পনা-স্বপন । চলো বোন ,
যাই নিত্য কাজে । ওই শোনো চারি দিকে
অরণ্য উঠেছে জেগে বিহঙ্গের গানে ।