ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
অমরুরাজ।
তোমারে করিনু সমর্পণ যাহা আছে
মোর। তুমি বীর, তুমি রাজ-অধিরাজ।
তব যোগ্য কন্যা মোর, তারে লহো তুমি।
সহকার মাধবিকা-লতার আশ্রয়।
ক্ষণেক বিলম্ব করো, মহারাজ, তারে
দিই পাঠাইয়া।
[ প্রস্থান
বিক্রমদেব।
কী মধুর শান্তি হেথা।
চিরন্তন অরণ্য-আবাস, সুখসুপ্ত
ঘনচ্ছায়া, নির্ঝরিণী নিরন্তর-ধ্বনি।
শান্তি যে শীতল এত, এমন গম্ভীর,
এমন নিস্তব্ধ তবু এমন প্রবল
উদার সমুদ্র-সম, বহুদিন ভুলে
ছিনু যেন। মনে হয়, আমার প্রাণের
অনন্ত অনল-দাহ সেও যেন হেথা
হারাইয়া ডুবে যায়, না থাকে নির্দেশ−
এত ছায়া, এত স্থান, এত গভীরতা।
এমনি নিভৃত সুখ ছিল আমাদের,
গেল কার অপরাধে? আমার, কি তার?
যারি হোক− এ জনমে আর কি পাব না?
যাও তবে একেবারে চলে যাও দুরে।
জীবনে থেকো না জেগে অনুতাপ-রূপে,
দেখা যাক যদি এইখানে− সংসারের
নির্জন নেপথ্যদেশে পাই নব প্রেম,
তেমনি অতলস্পর্শ, তেমনি মধুর।
সখীর সহিত ইলার প্রবেশ
এ কী অপরূপ মূর্তি! চরিতার্থ আমি।
আসন গ্রহণ করো দেবী। কেন মৌন,
নতশির, কেন ম্লানমুখ, দেহলতা
কম্পিত কাতর? কিসের বেদনা তব?
নতজানু
ইলা। শুনিয়াছি মহারাজ-অধিরাজ তুমি
সসাগরা ধরণীর পতি। ভিক্ষা আছে
তোমার চরণে।
বিক্রমদেব।
উঠ উঠ হে সুন্দরী।
তব পদস্পর্শযোগ্য নহে এ ধরণী,
তুমি কেন ধুলায় পতিত? চরাচরে
কিবা আছে অদেয় তোমারে?
ইলা।
মহারাজ,
পিতা মোরে দিয়াছেন শঁপি তব হাতে;
আপনারে ভিক্ষা চাহি আমি। ফিরাইয়া
দাও মোরে। কত ধন রত্ন রাজ্য দেশ
আছে তব, ফেলে রেখে যাও মোরে এই
ভূমিতলে। তোমার অভাব কিছু নাই।
বিক্রমদেব।
আমার অভাব নাই? কেমনে দেখাব
গোপন হৃদয়? কোথা সেথা ধনরত্ন?
কোথা সসাগরা ধরা? সব শূন্যময়।
রাজ্যধন না থাকিত যদি,− শুধু তুমি
থাকিতে আমার −
উঠিয়া
ইলা। লহো তবে এ জীবন।
তোমরা যেমন ক'রে বনের হরিণী
নিয়ে যাও, বুকে তার তীক্ষ্ণ তীর বিঁধে,
তেমনি হৃদয় মোর বিদীর্ণ করিয়া
জীবন কাড়িয়া আগে, তার পরে মোরে
নিয়ে যাও।
বিক্রমদেব।
কেন দেবী, মোর 'পরে এত
অবহেলা? আমি কি নিতান্ত তব যোগ্য
নহি? এত রাজ্য দেশ করিলাম জয়,
প্রার্থনা করেও আমি পাব না কি তবু
হৃদয় তোমার?
ইলা।
সে কি আর আছে মোর?
সমস্ত সঁপেছি যারে, বিদায়ের কালে,
হৃদয় সে নিয়ে চলে গেছে, বলে গেছে−
ফিরে এসে দেখা দেবে এই উপবনে।
কতদিন হল; বনপ্রান্তে দিন আর
কাটে নাকো। পথ চেয়ে সদা পড়ে আছি;
যদি এসে দেখিতে না পায়, ফিরে যায়,
আর যদি ফিরিয়া না আসে! মহারাজ,
কোথা নিয়ে যাবে? রেখে যাও তার তরে
যে আমারে ফেলে রেখে গেছে।
বিক্রমদেব।
না জানি সে
কোন্ ভাগ্যবান! সাবধান, অতিপ্রেম
সহে না বিধির। শুন তবে মোর কথা।
এক কালে চরাচর তুচ্ছ করি আমি
শুধু ভালোবাসিতাম; সে প্রেমের 'পরে
পড়িল বিধির হিংসা, জেগে দেখিলাম
চরাচর পড়ে আছে, প্রেম গেছে ভেঙে।
বসে আছ যার তরে কী নাম তাহার?
ইলা।
কাশ্মীরের যুবরাজ− কুমার তাহার
নাম।
বিক্রমদেব।
কুমার?
ইলা।
তারে জান তুমি! কেই বা
না জানে। সমস্ত কাশ্মীর তারে দিয়েছে
হৃদয়।
বিক্রমদেব।
কুমার? কাশ্মীরের যুবরাজ?
ইলা।
সেই বটে মহারাজ। তার নাম সদা
ধ্বনিছে চৌদিকে। তোমারি সে বন্ধু বুঝি!
মহৎ সে, ধরণীর যোগ্য অধিপতি।
বিক্রমদেব।
তাহার সৌভাগ্য-রবি গেছে অস্তাচলে,
ছাড়ো তার আশা। শিকারের মৃগ-সম
সে আজ তাড়িত, ভীত, আশ্রয়বিহীন,
গোপন অরণ্যছায়ে রয়েছে লুকায়ে।
কাশ্মীরের দীনতম ভিক্ষাজীবী আজ
সুখী তার চেয়ে।
ইলা।
কী বলিলে মহারাজ?
বিক্রমদেব।
তোমরা বসিয়া থাক ধরাপ্রান্ত-ভাগে,
শুধু ভালোবাস। জান না বাহিরে বিশ্বে
গরজে সংসার, কর্মস্রোতে কে কোথায়
ভেসে যায়, ছল ছল বিশাল নয়নে
তোমরা চাহিয়া থাক। বৃথা তার আশা।
ইলা।
সত্য বলো মহারাজ, ছলনা ক'রো না।
জেনো এই অতি ক্ষুদ্র রমণীর প্রাণ
শুধু আছে তারি তরে, তারি পথ চেয়ে।
কোন্ গৃহহীন পথে কোন্ বনমাঝে
কোথা ফিরে কুমার আমার? আমি যাব
বলে দাও− গৃহ ছেড়ে কখনো যাই নি,
কোথা যেতে হবে? কোন্ দিকে, কোন্ পাথে?
বিক্রমদেব।
বিদ্রোহী সে, রাজসৈন্য ফিরিতেছে সদা
সন্ধানে তাহার।
ইলা।
তোমরা কি বন্ধু নহ
তার? তোমরা কি রক্ষা করিবে না তারে?
রাজপুত্র ফিরিতেছে বনে, তোমরা কি
রাজা হয়ে দেখিবে চাহিয়া? এতটুকু
দয়া নেই কারো? প্রিয়তম, প্রিয়তম,
আমি তো জানি নে, নাথ, সংকটে পড়েছ−
আমি হেথা বসে আছি তোমার লাগিয়া।
অনেক বিলম্ব দেখে মাঝে মাঝে মনে
চকিত বিদ্যুৎ-সম বেজেছে সংশয়।
শুনেছিনু এত লোক ভালোবাসে তারে
কোথা তারা বিপদের দিনে? তুমি নাকি
পৃথিবীর রাজা। বিপন্নের কেহ নহ?
এত সৈন্য, এত যশ, এত বল নিয়ে
দূরে বসে রবে? তবে পথ বলে দাও।
জীবন সঁপিব একা অবলা রমণী।
বিক্রমদেব।
কী প্রবল প্রেম! ভালোবাসো ভালোবাসো
এমনি সবেগে চিরদিন। যে তোমার
হৃদয়ের রাজা, শুধু তারে ভালোবাসো।
প্রেমস্বর্গচ্যুত আমি, তোমাদের দেখে
ধন্য হই। দেবী, চাহি নে তোমার প্রেম।
শুষ্ক শাখে ঝরে ফুল, অন্য তরু হতে
ফুল ছিঁড়ে নিয়ে তারে কেমনে সাজাব?
আমারে বিশ্বাস করো− আমি বন্ধু তব।
চলো মোর সাথে, আমি তারে এনে দেব।
সিংহাসনে বসায়ে কুমারে, তার হাতে
সঁপি দিব তোমারে কুমারী।
ইলা।
মহারাজ,
প্রাণ দিলে মোরে। যেথা যেতে বল, যাব।
বিক্রমদেব।
এস তবে প্রস্তুত হইয়া। যেতে হবে
কাশ্মীরের রাজধানী-মাঝে।
[ ইলা ও সখীর প্রস্থান
যুদ্ধ নাহি
ভালো লাগে। শান্তি আরো অসহ্য দ্বিগুণ।
গৃহহীন পলাতক, তুমি সুখী মোর
চেয়ে। এ সংসারে যেথা যাও, সাথে থাকে
রমণীর অনিমেষ প্রেম, দেবতার
ধ্রুবদৃষ্টি-সম; পবিত্র কিরণে তারি
দীপ্তি পায় বিপদের মেঘ, স্বর্ণময়
সম্পদের মতো। আমি কোন্ সুখে ফিরি
দেশ-দেশান্তরে, স্কন্ধে বহে জয়ধ্বজা,
অন্তরেতে অভিশপ্ত হিংসাতপ্ত প্রাণ।
কোথা আছে কোন্ স্নিগ্ধ হৃদয়ের মাঝে
প্রস্ফুটিত শুভ্র প্রেম শিশিরশীতল।
ধুয়ে দাও, প্রেমময়ী, পুণ্য অশ্রুজলে
এ মলিন হস্ত মোর রক্তকলুষিত।
প্রহরীর প্রবেশ
প্রহরী।
ব্রাহ্মণ এসেছে মহারাজ, তব সাথে
সাক্ষাতের তরে।
বিক্রমদেব।
নিয়ে এস; দেখা যাক।
দেবদত্তের প্রবেশ
দেবদত্ত।
রাজার দোহাই, ব্রাহ্মণেরে রক্ষা করো।
বিক্রমদেব।
এ কী! তুমি কোথা হতে এলে? অনুকূল
দৈব মোর 'পরে। তুমি বন্ধুরত্ন মোর।
দেবদত্ত।
তাই বটে মহারাজ, রত্ন বটে আমি।
অতি যত্নে বন্ধ করে রেখেছিলে তাই।
ভাগ্যবলে পলায়েছি খোলা পেয়ে দ্বার।
আবার দিয়ো না সঁপি প্রহরীর হাতে
রত্নভ্রমে। আমি শুধু বন্ধুরত্ন নহি,
ব্রাহ্মণীর স্বামীরত্ন আমি। সে কি হায়
এতদিন বেঁচে আছে আর?
বিক্রমদেব।
এ কী কথা!
আমি তো জানি নে কিছু, এতদিন রুদ্ধ
আছ তুমি!
দেবদত্ত।
তুমি কী জানিবে মহারাজ।
তোমার প্রহরী দুটো জানে। কত শাস্ত্র
বলি তাহাদের, কত কাব্যকথা, শুনে
মূর্খ দুটো হাসে। একদিন বর্ষা দেখে
বিরহ-ব্যথায় মেঘদূত কাব্যখানা
শুনালেম দোঁহে ডেকে; গ্রাম্য মূর্খ দুটো
পড়িল কাতর হয়ে নিদ্রার আবেশে।
তখনি ধিক্কার-ভরে কারাগার ছাড়ি
আসিনু চলিয়া। বেছে বেছে ভালো লোক
দিয়েছিলে বিরহী এ ব্রাহ্মণের 'পরে!
এত লোক আছে সখা অধীনে তোমার
শাস্ত্র বোঝে এমন কি ছিল না দু-জন?
বিক্রমদেব।
বন্ধুবর, বড়ো কষ্ট দিয়েছে তোমারে।
সমুচিত শাস্তি দিব তারে, যে পাষণ্ড
রেখেছিল রুধিয়া তোমায়। নিশ্চয় সে
ক্রুরমতি জয়সেন।
দেবদত্ত।
শাস্তি পরে হবে।
আপাতত যুদ্ধ রেখে অবিলম্বে দেশে
ফিরে চলো। সত্য কথা বলি মহারাজ,
বিরহ সামান্য ব্যথা নয়, এবার তা
পেরেছি বুঝিতে। আগে আমি ভাবিতাম
শুধু বড়ো বড়ো লোক বিরহেতে মরে।
এবার দেখেছি, সামান্য এ ব্রাহ্মণের
ছেলে, এরেও ছাড়ে না পঞ্চবাণ; ছোটো
বড়ো করে না বিচার।
বিক্রমদেব।
যম আর প্রেম
উভয়েরি সমদৃষ্টি সর্বভূতে। বন্ধু,
ফিরে চলো দেশে। কেবল যাবার আগে
এক কাজ বাকি আছে। তুমি লহো ভার।
অরণ্যে কুমারসেন আছে লুকাইয়া,
ত্রিচূড়রাজের কাছে সন্ধান পাইবে
সখে, তার কাছে যেতে হবে। ব'লো তারে,
আর আমি শত্রু নহি। অস্ত্র ফেলে দিয়ে
বসে আছি প্রেমে বন্দী করিবারে তারে।
আর সখা− আর কেহ যদি থাকে সেথা−
যদি দেখা পাও আর কারো−
দেবদত্ত।
জানি, জানি−
তাঁর কথা জাগিতেছে হৃদয়ে সতত।
এতক্ষণ বলি নাই কিছু। মুখে যেন
সরে না বচন। এখন তাঁহার কথা
বচনের অতীত হয়েছে। সাধ্বী তিনি,
তাই এত দুঃখ তাঁর। তাঁরে মনে ক'রে
মনে পড়ে পুণ্যবতী জানকীর কথা।
চলিলাম তবে।
বিক্রমদেব।
বসন্ত না আসিতেই
আগে আসে দক্ষিণপবন, তার পরে
পল্লবে কুসুমে বনশ্রী প্রফুল্ল হয়ে
ওঠে। তোমারে হেরিয়া আশা হয় মনে,
আবার আসিবে ফিরে সেই পুরাতন
দিন মোর, নিয়ে তার সব সুখ-ভার।