ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


রাজা ও রানী
পঞ্চম অঙ্ক
  অষ্টম দৃশ্য

অরণ্য
কুমারের দুই জন অনুচর

    প্রথম। হ্যা, দেখ মাধু, কাল যে স্বপ্নটা দেখলুম তার কোনো মানে ভেবে পাচ্ছি নে। শহরে গিয়ে দৈবিজ্ঞি ঠাকুরের কাছে গুনিয়ে নিয়ে আসতে হবে।
    দ্বিতীয়। কী স্বপ্নটা বল্‌ তো শুনি।
    প্রথম। যেন এক জন মহাপুরুষ ওই জল থেকে উঠে আমাকে তিনটে বড়ো বড়ো বেল দিতে এল। আমি দুটো দু-হাতে নিলুম, আর একটা কোথায় নেব ভাবনা পড়ে গেল।
    দ্বিতীয়। দূর মূর্খ, তিনটেই চাদরে বেঁধে নিতে হয়।
    প্রথম। আরে জেগে থাকলে তো সকলেরই বুদ্ধি জোগায় − সে-সময়ে তুই কোথায় ছিলি? তার পর শোন্‌ না; সেই বাকি বেলটা মাটিতে পড়েই গড়াতে আরম্ভ করলে, আমি তার পিছন পিছন ছুটলুম। হঠাৎ দেখি যুবরাজ অশথতলায় বসে আহ্নিক করছেন। বেলটা ধপ্‌ করে তাঁর কোলের উপর গিয়ে লাফিয়ে উঠল। আমার ঘুম ভেঙে গেল।
    দ্বিতীয়। এটা আর বুঝতে পারলি নে। যুবরাজ শিগ্‌গির রাজা হবে।
    প্রথম। আমিও তাই ঠাউরেছিলুম। কিন্তু আমি যে দুটো বেল পেলুম, আমার কী হবে?
    দ্বিতীয়। তোর আবার হবে কী? তোর খেতে বেগুন বেশি করে ফলবে।
    প্রথম। না ভাই, আমি ঠাউরে রেখেছি আমার দুই পুত্তুর-সন্তান হবে।
    দ্বিতীয়। হ্যা দেখ্‌ ভাই, বললে পিত্তয় যাবি নে, কাল ভারি আশ্চর্য কাণ্ড হয়ে গেছে। ওই জলের ধারে বসে রামচরণে আমাতে চিঁড়ে ভিজিয়ে খাচ্ছিলুম, তা আমি কথায় কথায় বললুম আমাদের দোবেজী গুনে বলেছে যুবরাজের ফাঁড়া প্রায় কেটে এসেছে। আর দেরি নেই। এবার শিগ্‌গির রাজা হবে। হঠাৎ মাথার উপর কে তিন বার বলে উঠল "ঠিক ঠিক ঠিক",− উপরে চেয়ে দেখি ডুমুরের ডালে এতবড়ো একটা টিকটিকি!

                                    রামচরণের প্রবেশ
    প্রথম। কী খবর রামচরণ?
    রামচরণ। ওরে ভাই, আজ একটা ব্রাহ্মণ এই বনের আশেপাশে যুবরাজের সন্ধান নিয়ে ফিরছিল। আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কত কথাই জিজ্ঞেসা করলে। আমি তেমনি বোকা আর কি! আমিও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জবাব দিতে লাগলুম। অনেক খোঁজ করে শেষকালে চলে গেল। তাকে আমি চিত্তলের রাস্তা দেখিয়ে দিলুম। ব্রাহ্মণ না হলে তাকে আজ আর আমি আস্ত রাখতুম না।
    দ্বিতীয়। কিন্তু তাহলে তো এ বন ছাড়তে হচ্ছে। বেটারা সন্ধান পেয়েছে দেখছি।
    প্রথম। এইখানে বসে পড়ো না ভাই রামচরণ − দুটো গল্প করা যাক।
    রামচরণ। যুবরাজের সঙ্গে আমাদের মা-ঠাকরুণ এই দিকে আসছেন। চল্‌ ভাই তফাতে গিয়ে বসি গে।

                                                        [ প্রস্থান

                                               কুমারসেন ও সুমিত্রার প্রবেশ

কুমারসেন।  শংকর পড়েছে ধরা। রাজ্যের সংবাদ
                নিতে গিয়েছিল বৃদ্ধ, গোপনে ধরিয়া
ছদ্মবেশ।     শত্রুচর ধরেছে তাহারে।
                নিয়ে গেছে জয়সেন-কাছে। শুনিয়াছি
                চলিতেছে নিষ্ঠুর পীড়ন তার 'পরে−
                তবু সে অটল। একটি কথাও তারা
                পারে নাই মুখ হতে করিতে বাহির।
সুমিত্রা।      হায় বৃদ্ধ প্রভুবৎসল! প্রাণাধিক
                ভালোবাস যারে সেই কুমারের কাজে
                সঁপি দিলে তোমার কুমারগত প্রাণ।
কুমারসেন।  এ সংসারে সব চেয়ে বন্ধু সে আামার,
                আজন্মের সখা। আপনার প্রাণ দিয়ে
                আড়াল করিয়া চাহে সে রাখিতে মোরে
                নিরাপদে। অতি বৃদ্ধ ক্ষীণ জীর্ণ দেহ,
                কেমনে সে সহিছে যন্ত্রণা? আমি হেথা
                সুখে আছি লুকায়ে বসিয়া।
সুমিত্রা।                                         আমি যাই,
                ভাই! ভিখারিনীবেশে সিংহাসনতলে
                গিয়া শংকরের প্রাণভিক্ষা মেগে আসি।
কুমারসেন।  বাহির হইতে তারা আবার তোমারে
                দিবে ফিরাইয়া। তোমার পিতার রাজ্য
                হবে নতশির। বজ্রসম বাজিবে সে
                মর্মে গিয়ে মোর।

                    চরের প্রবেশ
চর।                                    গত রাত্রে গিধ্‌কূট
                জ্বালায়ে দিয়েছে জয়সেন। গৃহহীন
                গ্রামবাসিগণ আশ্রয় নিয়েছে গিয়ে
                মন্দুর অরণ্য-মাঝে।
                                                [ প্রস্থান
কুমারসেন।                             আর তো সহে না।
                ঘৃণা হয় এ জীবন করিতে বহন
                সহস্রের জীবন করিয়া ক্ষয়।
সুমিত্রা।                                         চলো
                মোরা দুই জনে যাই রাজসভা-মাঝে
                দেখিব কেমনে, কোন্‌ ছলে, জালন্ধর
                স্পর্শ করে কেশ তব।
কুমারসেন।                                 শংকর বলিত,
                "প্রাণ যায় সেও ভালো, তবু বন্দিভাবে
                কখনো দিয়ো না ধরা।" পিতৃসিংহাসনে
                বসি বিদেশের রাজা দণ্ড দিবে মোরে
                বিচারের ছল করি, এ কি সহ্য হবে?
                অনেক সহেছি বোন, পিতৃপুরুষের
                অপমান সহিব কেমনে।
সুমিত্রা।                                     তার চেয়ে
                মৃত্যু ভালো।
কুমারসেন।                     বলো বোন, বলো, "তার চেয়ে
                মৃত্যু ভালো।" এই তো তোমার যোগ্য কথা।
                তার চেয়ে মৃত্যু ভালো। ভালো করে ভেবে
                দেখো। বেঁচে থাকা ভীরুতা কেবল। বলো,
                এ কি সত্য নয়? থেকো না নীরব হয়ে,
                বিষাদ-আনত নেত্রে চেয়ো না ভূতলে।
                মুখ তোলো, স্পষ্ট করে বলো এক বার,
                ঘৃণিত এ প্রাণ লয়ে লুকায়ে লুকায়ে
                নিশিদিন মরে থাকো, এক দণ্ড এ কি
                উচিত আমার?
সুমিত্রা।                             ভাই−
কুমারসেন।                                 আমি রাজপুত্র−
                ছারখার হয়ে যায় সোনার কাশ্মীর,
                পথে পথে বনে বনে ফিরে গৃহহীন
                প্রজা, কেঁদে মরে পতিপুত্রহীনা নারী,−
                তবু আমি কোনোমতে বাঁচিব গোপনে?
সুমিত্রা।     তার চেয়ে মৃত্যু ভালো।
কুমারসেন।                                 বলো, তাই বলো।
                ভক্ত যারা অনুরক্ত মোর− প্রতিদিন
                সঁপিছে আপন প্রাণ নির্যাতন সহি।
                তবু আমি তাহাদের পশ্চাতে লুকায়ে
                জীবন করিব ভোগ! এ কি বেঁচে থাকা!
সুমিত্রা।      এর চেয়ে মৃত্যু ভালো।
কুমারসেন।                                 বাঁচিলাম শুনে।
                কোনোমতে রেখেছিনু তোমারি লাগিয়া
                এ হীন জীবন, প্রত্যেক নিশ্বাসে মোর
                নির্দোষের প্রাণবায়ু করিয়া শোষণ।
                আমার চরণ ছুঁয়ে করহ শপথ
                যে-কথা বলিব তাহা করিবে পালন
                যতই কঠিন হোক।
সুমিত্রা।                                 করিনু শপথ।
কুমারসেন। এ জীবন দিব বিসর্জন। তার পরে
                তুমি মোর ছিন্নমুণ্ড নিয়ে, নিজ হস্তে
                জালন্ধর-রাজ-করে দিবে উপহার।
                বলিয়ো তাহারে− "কাশ্মীরে অতিথি তুমি;
                ব্যাকুল হয়েছ এত যে-দ্রব্যের তরে
                কাশ্মীরের যুবরাজ দিতেছেন তাহা
                আতিথ্যের অর্ঘ্যরূপে তোমারে পাঠায়ে।"
                মৌন কেন বোন? সঘনে কাঁপিছে কেন
                চরণ তোমার? ব'সো এই তরুতলে।
                পারিবে না তুমি? একান্ত অসাধ্য এ কি?
                তবে কি ভৃত্যের হস্তে পাঠাইতে হবে
                তুচ্ছ উপহার-সম এ রাজমস্তক?
                সমস্ত কাশ্মীর তারে ফেলিবে যে রোষে
                ছিন্নভিন্ন করি।

                          [ সুমিত্রার মূর্ছা

                                ছি ছি বোন। উঠ, উঠ।
                পাষাণে হৃদয় বাঁধো। হ'য়ো না বিহ্বল।
                দুঃসহ এ কাজ− তাই তো তোমার 'পরে
                দিতেছি দুরূহ ভার। অয়ি প্রাণাধিকে,
                মহৎহৃদয় ছাড়া কাহারা সহিবে
                জগতের মহাক্লেশ যত। বলো বোন,
                পারিবে করিতে?
সুমিত্রা।                             পারিব।
কুমারসেন।                                     দাঁড়াও তবে।
                ধরো বল, তোলো শির। উঠাও জাগায়ে
                সমস্ত হৃদয়-মন। ক্ষুদ্র নারী-সম
                আপন বেদনাভারে প'ড়ো না ভাঙিয়া।
সুমিত্রা।       অভাগিনী ইলা!
কুমারসেন।                     তারে কি জানি নে আমি?
                হেন অপমান লয়ে সে কি মোরে কভু
                বাঁচিতে বলিত? সে আমার ধ্রুবতারা
                মহৎ মৃত্যুর দিকে দেখাইছে পথ।
                কাল পূর্ণিমার তিথি মিলনের রাত।
                জীবনের গ্লানি হতে মুক্ত ধৌত হয়ে
                চিরমিলনের বেশ করিব ধারণ।
                চলো বোন। আগে হতে সংবাদ পাঠাই
                দূতমুখে রাজসভামাঝে, কাল আমি
                যাব ধরা দিতে। তাহা হলে অবিলম্বে
                শংকর পাইবে ছাড়া− বান্ধব আমার।