ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


রাজা ও রানী
পঞ্চম অঙ্ক
 নবম দৃশ্য

কাশ্মীর। রাজসভা
বিক্রমদেব ও চন্দ্রসেন

বিক্রমদেব।  আর্য, তুমি কেন আজ নীরব এমন?
                মার্জনা তো করেছি কুমারে।
চন্দ্রসেন।                                         তুমি তারে
                মার্জনা করেছ। আমি তো এখনো তার
                বিচার করি নি। বিদ্রোহী সে মোর কাছে।
                এবার তাহার শাস্তি দিব।
বিক্রমদেব।                                 কোন্‌ শাস্তি
                করিয়াছ স্থির?
চন্দ্রসেন।                         সিংহাসন হতে তারে
                করিব বঞ্চিত।
বিক্রমদেব।                     অতি অসম্ভব কথা।
                সিংহাসন দিব তারে নিজ হস্তে আমি।
চন্দ্রসেন।     কাশ্মীরের সিংহাসনে তোমার কী আছে
                অধিকার?
বিক্রমদেব।                 বিজয়ীর অধিকার।
চন্দ্রসেন।                                             তুমি
                হেথা আছ বন্ধুভাবে অতিথির মতো।
                কাশ্মীরের সিংহাসন কর নাই জয়।
বিক্রমদেব। বিনা যুদ্ধে করিয়াছে কাশ্মীর আমারে
                আত্মসমর্পণ। যুদ্ধ চাও যুদ্ধ করো,
                রয়েছি প্রস্তুত। আমার এ সিংহাসন।
                যারে ইচ্ছা দিব।
চন্দ্রসেন।                         তুমি দিবে! জানি আমি
                গর্বিত কুমারসেন জন্মকাল হতে।
                সে কি লবে আপনার পিতৃসিংহাসন
                ভিক্ষার স্বরূপে? প্রেম দাও প্রেম লবে,
                হিংসা দাও প্রতিহিংসা লবে, ভিক্ষা দাও
                ঘৃণাভরে পদাঘাত করিবে তাহাতে।
বিক্রমদেব। এত গর্ব যদি তার তবে সে কি কভু
                ধরা দিতে মোর কাছে আপনি আসিত?
চন্দ্রসেন।     তাই ভাবিতেছি, মহারাজ, নহে ইহা
                কুমারসেনের মতো কাজ। দৃপ্ত যুবা
                সিংহসম। সে কি আজ স্বেচ্ছায় আসিবে
                শৃঙ্খল পরিতে গলে? জীবনের মায়া
                এতই কি বলবান।

                   প্রহরীর প্রবেশ
প্রহরী।                                 শিবিকার দ্বার
                রুদ্ধ করি প্রাসাদে আসিছে যুবরাজ।
বিক্রমদেব। শিবিকার দ্বার রুদ্ধ?
চন্দ্রসেন।                             সে কি আর কভু
                দেখাইবে মুখ? আপনার পিতৃরাজ্যে
                আসিছে সে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে; রাজপথে
                লোকারণ্য চারিদিকে, সহস্রের আঁখি
                রয়েছে তাকায়ে। কাশ্মীরললনা যত
                গবাক্ষে দাঁড়ায়ে। উৎসবের পূর্ণচন্দ্র
                চেয়ে আছে আকাশের মাঝখান হতে।
                সেই চিরপরিচিত গৃহ পথ হাট
                সরোবর মন্দির কানন, পরিচিত
                প্রত্যেক প্রজার মুখ। কোন্‌ লাজে আজি
                দেখা দিবে সবারে সে? মহারাজ, শোনো
                নিবেদন। গীতবাদ্য বন্ধ করে দাও।
                এ উৎসব উপহাস মনে হবে তার।
                আজ রাত্রে দীপালোক দেখে ভাবিবে সে,
                নিশীথ-তিমিরে পাছে লজ্জা ঢাকা পড়ে
                তাই এত আলো। এ আলোক শুধু বুঝি
                অপমান-পিশাচের পরিহাস-হাসি।

                      দেবদত্তের প্রবেশ

দেবদত্ত।     জয়োস্তু রাজন্‌। কুমারের অন্বেষণে
                বনে বনে ফিরিয়াছি, পাই নাই দেখা।
                আজ শুনিলাম নাকি আসিছেন তিনি
                স্বেচ্ছায় নগরে ফিরি। তাই চলে এনু।
বিক্রমদেব। করিব রাজার মতো অভ্যর্থনা তারে।
                তুমি হবে পুরোহিত অভিষেক-কালে।
                পূর্ণিমা-নিশীথে আজ কুমারের সনে
                ইলার বিবাহ হবে, করেছি তাহার
                আয়োজন।

                      নগরের ব্রাহ্মণগণের প্রবেশ
সকলে।          মহারাজ, জয় হোক।
প্রথম।                                      করি
                আশীর্বাদ,ধরণীর অধীশ্বর হও।
                লক্ষ্মী হোন অচলা তোমার গৃহে সদা।
                আজ যে আনন্দ তুমি দিয়েছ সবারে
                বলিতে শকতি নাই− লহো মহারাজ,
                কৃতজ্ঞ এ কাশ্মীরের কল্যাণ-আশিস।

                 [ রাজার মস্তকে ধান্যদূর্বা দিয়া আশীর্বাদ

বিক্রমদেব। ধন্য আমি কৃতার্থ জীবন।
                                     [ ব্রাহ্মণগণের প্রস্থান

                যষ্টিহস্তে কষ্টে শংকরের প্রবেশ

                         চন্দ্রসেনের প্রতি
শংকর।                                 মহারাজ!
                এ কি সত্য? যুবরাজ আসিছেন নিজে
                শক্রকরে করিবারে আত্মসমর্পণ?
                বলো, এ কি সত্য কথা?
চন্দ্রসেন।                                   সত্য বটে।
শংকর।                                                   ধিক,
                সহস্র মিথ্যার চেয়ে এই সত্যে ধিক
                হায় যুবরাজ, বৃদ্ধ ভৃত্য আমি তব,
                সহিলাম এত যে যন্ত্রণা, জীর্ণ অন্থি
                চূর্ণ হয়ে গেল মূক-সম রহিলাম
                তবু, সে কি এরি তবে? অবশেষে তুমি
                আপনি ধরিলে বন্দিবেশ, কাশ্মীরের
                রাজপথ দিয়ে চলে এলে নতশিরে
                বন্দিশালা-মাঝে? এই কি সে রাজসভা
                পিতামহদের? যেথা বসি পিতা তব
                উঠিতেন ধরণীর সর্ব্বোচ্চ শিখরে
                সে আজ তোমার কাছে ধরার ধুলার
                চেয়ে নিচে! তার চেয়ে নিরাশ্রয় পথ
                গৃহতুল্য, অরণ্যের ছায়া সমুজ্জ্বল,
                কঠিন পর্বতশৃঙ্গ অনুর্বর মরু
                রাজার সম্পদে পূর্ণ। চিরভৃত্য তব
                আজি দুর্দিনের আগে মরিল না কেন?
বিক্রমদেব। ভালো হতে মন্দটুকু নিয়ে, বৃদ্ধ, মিছে
                এ তব ক্রন্দন।
শংকর। ‌                            রাজন্‌, তোমার কাছে
                আসি নি কাঁদিতে। স্বর্গীয় রাজেন্দ্রগণ
                রয়েছেন জাগি ওই সিংহাসন-কাছে,
                আজি তাঁরা ম্লানমুখ, লজ্জানতশির,
                তাঁরা বুঝিবেন মোর হৃদয়-বেদনা।
বিক্রমদেব। কেন মোরে শত্রু বলে করিতেছ ভ্রম?
                মিত্র আমি আজি।
শংকর।                             অতিশয় দয়া তব
                জালন্ধরপতি; মার্জনা করেছ তুমি।
                দণ্ড ভালো মার্জনার চেয়ে।
বিক্রমদেব।                                     এর মতো
                হেন ভক্ত বন্ধু হায় কে আমার আছে?
দেবদত্ত।     আছে বন্ধু, আছে মহারাজ।
                বাহিরে হুলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, কোলাহল

                   শংকরের দুই হস্তে মুখ আচ্ছাদন

                         প্রহরীর প্রবেশ

প্রহরী।                         আসিয়াছে
                দুয়ারে শিবিকা।
বিক্রমদেব।                     বাদ্য কোথা, বাজাইতে
                বলো। চলো সখা, অগ্রসর হয়ে তারে
                অভ্যর্থনা করি।

               বাদ্যোদ্যম। সভামধ্যে শিবিকার প্রবেশ

                     অগ্রসর হইয়া

বিক্রমদেব।                         এস, এস, বন্ধু এস।

            স্বর্ণথালে ছিন্নমুণ্ড লইয়া সুমিত্রার শিবিকা বাহিরে আগমন
                     সহসা সমস্ত বাদ্য নীরব

বিক্রমদেব।     সুমিত্রা! সুমিত্রা!
চন্দ্রসেন।                             এ কী, জননী সুমিত্রা!
সুমিত্রা।       ফিরেছ সন্ধানে যার রাত্রিদিন ধরে
                কাননে কান্তারে শৈলে− রাজ্য ধর্ম দয়া
                রাজলক্ষ্মী সব বিসর্জিয়া, যার লাগি
                দিগ্বিদিকে হাহাকার করেছ প্রচার,
                মূল্য দিয়ে চেয়েছিলে কিনিবারে যারে,
                লহ মহারাজ, ধরণীর রাজবংশে
                শ্রেষ্ঠ সেই শির। আতিথ্যের উপহার
                আপনি ভেটিলা যুবরাজ। পূর্ণ তব
                মনস্কাম, এবে শান্তি হোক, শান্তি হোক
                এ জগতে, নিবে যাক নরকাগ্নিরাশি,
                সুখী হও তুমি।

                          ঊর্ধ্বস্বরে

                         মাগো জগৎজননী,
                দয়াময়ী, স্থান দাও কোলে।
                                           [ পতন ও মৃত্যু

                   ছুটিয়া ইলার প্রবেশ

ইলা।                                     এ কী, এ কী,
                মহারাজ, কুমার আমার−

                        অগ্রসর হইয়া
শংকর।                                     প্রভু, স্বামী,
                বৎস, প্রাণাধিক, বৃদ্ধের জীবনধন,
                এই ভালো, এই ভালো। মুকুট পরেছ
                তুমি, এসেছ রাজার মতো আপনার
                সিংহাসনে। মৃত্যুর অমর রশ্মিরেখা
                উজ্জ্বল করেছে তব ভাল। এতদিন
                এ বৃদ্ধেরে রেখেছিল বিধি, আজি তব
                এ মহিমা দেখাবার তরে। গেছ তুমি
                পুণ্যধামে− ভৃত্য আমি চিরজনমের
                আমিও যাইব সাথে।

                    মাথা হইতে মুকুট ভূমে ফেলিয়া
চন্দ্রসেন।                                 ধিক এ মুকুট।
                ধিক এই সিংহাসন।
                            [ সিংহাসনে পদাঘাত

                    রেবতীর প্রবেশ

                                            রাক্ষসী পিশাচী
                দূর হ দূর হ− আমারে দিস নে দেখা
পাপীয়সী।
রেবতী।     এ রোষ রবে না চিরদিন।
                                                [ প্রস্থান

                     নতজানু
বিক্রমদেব।     দেবী, যোগ্য নহি আমি তোমার প্রেমের,
                    তাই বলে মার্জনাও করিলে না? রেখে
                    গেলে চির অপরাধী করে? ইহজন্ম
                    নিত্য-অশ্রুজলে লইতাম ভিক্ষা মাগি
                    ক্ষমা তব; তাহারো দিলে না অবকাশ?
                    দেবতার মতো তুমি নিশ্চল নিষ্ঠুর,
                    অমোঘ তোমার দণ্ড, কঠিন বিধান।