ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
ভগ্নহৃদয়
প্রথম সর্গ
দৃশ্য–
বন। চপলা ও মুরলা |
||
চপলা। | সখি, তুই হলি কি আপনা-হারা? | |
এ ভীষণ বনে পশি একেলা আছিস্ বসি খুঁজে খুঁজে হোয়েছি যে সারা! এমন আঁধার ঠাঁই– জনপ্রাণী কেহ নাই, জটিল-মস্তক বট চারি দিকে ঝুঁকি! দুয়েকটি রবিকর সাহসে করিয়া ভর অতি সন্তর্পণে যেন মারিতেছে উঁকি। অন্ধকার, চারি দিক হ'তে, মুখপানে এমন তাকায়ে রয়, বুকে বড়ো লাগে ভয়, কি সাহসে রোয়েছিস্ বসিয়া এখানে? |
||
মুরলা। | সখি, বড়ো ভালোবাসি এই ঠাঁই! | |
বায়ু বহে হুহু করি, পাতা কাঁপে ঝর
ঝরি, স্রোতস্বিনী কুলু কুলু করিছে সদাই! বিছায়ে শুকানো পাতা বটমূলে রাখি মাথা দিনরাত্রি পারি, সখি, শুনিতে ও ধ্বনি। বুকের ভিতরে গিয়া কি যে উঠে উথলিয়া বুঝায়ে বলিতে তাহা পারি না সজনি! যা সখি, একটু মোরে রেখে দে একেলা, এ বন আঁধার ঘোর ভালো লাগিবে না তোর, তুই কুঞ্জবনে, সখি, কর্ গিয়ে খেলা! |
||
চপলা। | মনে আছে, অনিলের ফুলশয্যা আজ? | |
তুই হেথা বসে র'বি, কত আছে কাজ! কত ভোরে উঠে বনে গেছি ছুটে, মাধবীরে লয়ে ডাকি, ডালে ডালে যত ফুল ছিল ফুটে একটি রাখি নি বাকি! শিশিরে ভিজিয়ে গিয়েছে আঁচল, কুসুমরেণুতে মাখা। কাঁটা বিঁধে, সখি, হয়েছিনু সারা নোয়াতে গোলাপ-শাখা! তুলেছি করবী গোলাপ-গরবী, তুলেছি টগরগুলি, যুঁইকুঁড়ি যত বিকেলে ফুটিবে তখন আনিব তুলি। আয়, সখি, আয়, ঘরে ফিরে আয়, অনিলে দেখ্সে আজ– হরষের হাসি অধরে ধরে না, কিছু যদি আছে লাজ! |
||
মুরলা। | আহা সখি, বড়ো তারা ভালোবাসে দুই জনে! | |
চপলা। | হাঁ সখি, এমন আর দেখি নি তো বর-কোনে! | |
জানিস্ তো, সখি, ললিতার মতো অমন লাজুক মেয়ে অনিলের সাথে দেখা করিবারে প্রতিদিন যায় বিপাশার ধারে সরমের মাথা খেয়ে! কবরীতে বাঁধি কুসুমের মালা, নয়নে কাজলরেখা, চুপি চুপি যায়, ফিরে ফিরে চায়, বনপথ দিয়ে একা! দূর হতে দেখি অনিলে অমনি সরমে চরণ সরে না যেন! ফিরিবে ফিরিবে মনে মনে করি চরণ ফিরিতে পারে না যেন! অনিল অমনি দূর হোতে আসি ধরি তার হাতখানি কহে যে কত-কি হৃদয়-গলানো সোহাগে মাখানো বাণী। আমি ছিনু, সখি, লুকিয়ে তখন গাছের আড়ালে আসি, লুকিয়ে লুকিয়ে দেখিতেছিলেম রাখিতে পারি নে হাসি! কত কথা ক'য়ে কত হাত ধরি কত শত বার সাধাসাধি করি বসাইল যুবা ললিতা বালারে বকুল গাছের ছায়। মাথার উপরে ঝরে শত ফুল– যেন গো করুণ তরুণ বকুল ফুল চাপা দিয়ে লাজুক মেয়েরে ঢাকিয়া ফেলিতে চায়! ললিতার হাত কাঁপে থর থর, আঁখি দুটি নত মাটির উপর, ভূমি হতে এক কুসুম তুলিয়া ছিঁড়িতেছে শত ভাগে। লাজনত মুখ ধরিয়া তাহার অনিল রাখিল বুকের মাঝার, অনিমিষ আঁখি মেলিয়া যুবক চাহি থাকে মুখবাগে! আদরে ভাসিয়া ললিতার চোখে বাহিরে সলিলধার– সোহাগে সরমে প্রণয়ে গলিয়া আঁখি দুটি তার পড়িল ঢলিয়া, হাসি ও নয়নসলিলে মিলিয়া কি শোভা ধরিল মুখানি তার! আমি, সখি, আর নারিনু থাকিতে– সুমুখে পড়িনু আসি, করতালি দিয়ে উপহাস কত করিলাম হাসি হাসি! ললিতা অমনি চমকি উঠিল, মুখেতে একটি কথা না ফুটিল, আকুল ব্যাকুল হইয়া সরমে লুকাতে ঠাঁই না পায়। ছুটিয়ে পলায়ে এলেম অমনি, হেসে হেসে আর বাঁচি নে সজনি, সেদিন হইতে আমারে হেরিলে ললিতা সরমে মরিয়া যায়! |
||
মুরলা। | আহা, কেন বাধা দিতে গেলি তাহাদের কাছে? | |
চপলা। | বাধা না পাইলে, সখি, সুখেতে কি সুখ আছে? | |
মুরলা। | সূর্যমুখী ফুল, সখি, আমি ভালোবাসি বড়– | |
দু চারিটি তুলে এনে আজিকে করিস্ জড়। মনে বড়ো সাধ তার দেখে রবিমুখ-পানে, রবি যেখা মাথা তার লোয়ে যায় সেইখানে! তবু মনোআশা হায় মনেই মিশায়ে যায়, মুখানি তুলিতে নারে সরমেতে জড়সড়! সে ফুলে সাজাবি দেহ লাজময়ী ললিতার, লজ্জাবতী পাতা দিয়ে ঢাকিবি শয়ন তার; কমল আনিয়া তুলি লাজে-রাঙা পাপ্ড়িগুলি গাঁথি গাঁথি নিরমিয়া দিবি ঘোমটার ধার! পাতা-ঢাকা আধ-ফুটো লাজুক গোলাপ দুটো আনিস্, দুলায়ে দিবি সুচারু অলকে তার! সহসা রজনী-গন্ধা প্রভাতের আলো দেখে ভাবিয়া না পায় ঠাঁই কোথা মুখ রাখে ঢেকে– আকুল সে ফুলগুলি যতনে আনিস্ তুলি, তাই দিয়ে গেঁথে গেঁথে বিরচিবি কণ্ঠহার। |
||
চপলা। | তুই, সখি, আয়– একেলা আমার | |
ভালো নাহি
লাগে বালা! দুটি সখী মিলি হাসিতে হাসিতে গুন্ গুন্ গান গাহিতে গাহিতে মনের মতন গাঁথিব মালা! বল্ দেখি, সখি, হ'ল কি তোর? হাসিয়া খেলিয়া কুসুম তুলিয়া করিবি কোথায় ভাবনা ভুলিয়া কুমারীজীবন ভোর– তা না, একি জ্বালা? মরমে মিশিয়া আপনার মনে আপনি বসিয়া সাধ করে এত ভালো লাগে, সখি, বিজনে ভাবনা-ঘোর! তা হবে না, সখি, না যদি আসিস্ এই কহিলাম তোরে– যত ফুল আমি আনিয়াছি তুলি আঁচল ভরিয়া ল'ব সবগুলি, বিপাশার স্রোতে দিব লো ভাসায়ে একটি একটি করে! |
||
মুরলা। | মাথা খা, চপলা, মোরে জ্বালাস্ নে আর! | |
চপলা। | ভালো, সই, জ্বালাব না চলিনু এবার! | |
[গমনোদ্যম : পুনর্ব্বার ফিরিয়া আসিয়া] না না, সখি, এই আঁধার কাননে একেলা রাখিয়া তোরে কোথায় যাইব বল্ দিখি তুই, যাইব কেমন কোরে? তোরে ছেড়ে আমি পারি কি থাকিতে? ভালোবাসি তোরে কত! আমি যদি, সখি, হোতেম তোমার পুরুষ মনের মত সারাদিন তোরে রাখিতাম ধরে, বেঁধে রাখিতাম হিয়ে, একটুকু হাসি কিনিতাম তোর শতেক চুম্বন দিয়ে! অমিয়া-মাখানো মুখানি তোমার দেখে দেখে সাধ মিটিত না আর! ও মুখানি লয়ে কি যে করিতাম বুকের কোথায় ঢেকে রাখিতাম, ভাবিয়া পেতাম তা কি? সখি, কার তুমি ভালোবাসা-তরে ভাবিছ অমন দিনরাত ধরে, পায়ে পড়ি তব খুলে বলো তাহা– কি হবে রাখিয়া ঢাকি? |
||
মুরলা। | ক্ষমা কর মোরে, সখি, শুধায়ো না আর! | |
মরমে লুকানো থাক্ মরমের ভার! যে গোপন কথা, সখি, সতত লুকায়ে রাখি ইষ্টদেবমন্ত্র-সম পূজি অনিবার তাহা মানুষের কানে ঢালিতে যে লাগে প্রাণে– লুকানো থাক্ তা, সখি, হৃদয়ে আমার! ভালোবাসি, শুধায়ো না কারে ভালোবাসি! সে নাম কেমনে, সখি, কহিব প্রকাশি! আমি তুচ্ছ হতে তুচ্ছ, সে নাম যে অতি উচ্চ, সে নাম যে নহে যোগ্য এই রসনার! ক্ষুদ্র ওই কুসুমটি পৃথিবীকাননে, আকাশের তারকারে পূজে মনে মনে– দিন দিন পূজা করি শুকায়ে পড়ে সে ঝরি, আজন্ম নীরব প্রেমে যায় প্রাণ তার– তেমনি পূজিয়া তারে এ প্রাণ যাইবে হা-রে, তবুও লুকানো রবে এ কথা আমার! |
||
চপলা। | কে জানে সজনি, বুঝিতে না পারি | |
এ তোর কেমন কথা! আজিও তো সখি না পেনু ভাবিয়া একি প্রণয়ের প্রথা! প্রণয়ীর নাম রসনার, সখি, সাধের খেলেনা-মতো, উলটি পালটি সে নাম লইয়া রসনা খেলায় কত! নাম যদি তার বলিস্, তা হ'লে তোরে আমি অবিরাম শুনাব তাহারি নাম– গানের মাঝারে সে নাম গাঁথিয়া সদা গাব সেই গান! রজনী হইলে সেই গান গেয়ে ঘুম পাড়াইব তোরে, প্রভাত হইলে সেই গান তুই শুনিবি ঘুমের ঘোরে! ফুলের মালায় কুসুম-আখরে লিখি দিব সেই নাম– গলায় পরিবি, মাথায় পরিবি, তাহারি বলোয় কাঁকন করিবি, হৃদয়-উপরে যতনে ধরিবি নামের কুসুমদাম! যখনি গাহিবি তাহার গান, যখনি কহিবি তাহার নাম, সাথে সাথে সখি আমিও গাহিব, সাথে সাথে সখি আমিও কহিব, দিবারাতি অবিরাম– সারা জগতের বিশাল আখরে পড়িবি তাহারি নাম! যখনি বলিবি তোর পাশে তারে ধরিয়া আনিয়া দিব– সুমুখ হইতে পলাইয়া গিয়া আড়ালেতে লুকাইব। দেখিব কেমন দুখ না ছুটে ওই মুখে তোর হাসি না ফুটে– ভুলিবি এ বন, ভুলিবি বেদন, সখীরেও বুঝি ভুলিয়া যাবি! বল্, সখি, প্রেমে পড়েছিস্ কার! বল্, সখি, বল্ কি নাম তাহার! বলিবি নি কি লো? না যদি বলিস্ চপলার মাথা খাবি! |
||
মুরলা। | [নেপথ্যে চাহিয়া ] জীবন্ত স্বপ্নের মত, ওই দেখ, কবি | |
একা একা ভ্রমিছেন আঁধার অটবী। ওই যেন মূর্ত্তিমান ভাবনার মত নত করি দু-নয়ন শুনিছেন একমন স্তব্ধতার মুখ হতে কথা কত শত! [কবির প্রবেশ] |
||
কবি। | বনদেবীটির মত এই যে মুরলা, | |
প্রভাতে কাননে বসি ভাবনাবিহ্বলা! প্রকৃতি আপনি আসি লুকায়ে লুকায়ে আপনার ভাষা তোরে দেছে কি শিখায়ে? দিনরাত কলস্বরে তটিনী কি গান করে তাহা কি বুঝিতে তুই পেরেছিস্ বালা? তাই হেথা প্রতিদিন আসিস্ একালা! মুরলা! আজিকে তোরে বনবালা-মত করে চপলা সাজায়ে দিক্ দেখি একবার। এলোথেলো কেশপাশে লতা দে বাঁধিয়া, অলক সাজায়ে দে লো তৃণফুল দিয়া– ফুলসাথে পাতাগুলি একটি একটি তুলি অযতনে দে লো তাহা আঁচলে গাঁথিয়া! হরিণশাবক যত ভুলিবে তরাস, পদতলে বসি তোর চিবাইবে ঘাস। ছিঁড়ি ছিঁড়ি পাতাগুলি মুখে তার দিবি তুলি, সবিস্ময়ে সুকুমার গ্রীবাটি বাঁকায়ে অবাক্ নয়নে তারা রহিবে তাকায়ে! আমি হোয়ে ভাবে ভোর দেখিব মুখানি তোর, কল্পনার ঘুমঘোর পশিবে পরানে! ভাবিব, সত্যই হবে বনদেবী আসি তবে অধিষ্ঠান হইলেন কবির নয়ানে! |
||
চপলা। | বলো দেখি মোরে, কবি গো, হ'ল কি | |
তোমাদের দু-জনার? সখীরে আমার কি গুণ করেছ বলো দেখি একবার! সখীর আমার খেলাধূলা নেই, সারাদিন বসি থাকে বিজনেই– জানি না ত, কবি, এত দিন আছি কিসের ভাবনা তার! ছেলেবেলা হতে তোমরা দুজনে বাড়িয়াছ এক সাথে, আপনার মনে ভ্রমিতে দুজনে ধরি ধরি হাতে হাতে! তখন না জানি কি মন্ত্র, কবি গো, দিলে মুরলার কানে! কি মায়া না জানি দিয়েছিলে পড়ি সখীর তরুণ প্রাণে! বেলা হোয়ে এল সজনি এখন, করিয়াছে পান প্রভাতকিরণ ফুলবধূটির অধর হইতে প্রতি শিশিরের কণা। তুই থাক্, হেথা, আমি যাই ফিরে, অমনি ডাকিয়া ল'ব মালতীরে– একেলা তো, বালা, অত ফুলমালা গাঁথিবারে পারিব না! [প্রস্থান |
||
কবি। | মুরলা, তোমার কেন ভাবনার ভাব হেন? | |
কতবার শুধায়েছি বলো নি আমারে! লুকায়ো না কোন কথা, যদি কোন থাকে ব্যথা রুধিয়া রেখো না তাহা হৃদয়মাঝারে! হয়ত হৃদয়ে তব কিসের যাতনা আপনি মুরলা তাহা জানিতে পার না! হয়ত গো যৌবনের বসন্তসমীরে মানসকুসুম তব ফুটেছে সুধীরে, প্রণয়বারির তরে তৃষায় আকুল ম্রিয়মাণ হ'য়ে বুঝি পড়েছে সে ফুল? পেয়েছ কি যুবা কোন মনের মতন? ভালোবাসো, ভালোবাসা করহ গ্রহণ– তা হ'লে হৃদয় তব পাইবে জীবন নব, উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বাসময় হেরিবে ভুবন। |
||
মুরলা। | [স্বগত] বুঝিলে না– বুঝিলে না– কবি গো, এখনো | |
বুঝিলে
না এ প্রাণের কথা! দেবতা গো বলো দাও, এ হৃদয়ে বলো দাও, পারি যেন লুকাতে এ ব্যথা। জানি, কবি, ভালো তুমি বাস' নাক মোরে– তা হ'লে এ মন তুমি চিনিবে কি কোরে? একটুকু ভালো যদি বাসিতে আমারে তা হ'লে কি কোন কথা এ মনের কোনো ব্যথা তোমার কাছেতে, কবি, লুকায়ে থাকিতে পারে? তাহা হ'লে প্রতি ভাবে, প্রতি ব্যবহারে, মুখ দেখে, আঁখি দেখে, প্রত্যেক নিশ্বাস থেকে বুঝিতে যা গুপ্ত আছে বুকের মাঝারে। প্রেমের নয়ন থেকে প্রেম কি লুকানো থাকে? তবে থাক্, থাক্ সব, বুকে থাক্ গাঁথা– বুক যদি ফেটে যায়– ভেঙ্গে যায়– চুরে যায়– তবু রবে লুকানো এ কথা। দেবতা গো বলো দাও– এ হৃদয়ে বলো দাও পারি যেন লুকাতে এ ব্যথা! |
||
কবি। | বহুদিন হ'তে, সখি, আমার হৃদয় | |
হোয়েছে কেমন যেন অশান্তি-আলয়। চরাচর-ব্যাপী এই বোম-পারাবার সহসা হারায় যদি আলোক তাহার, আলোকের পিপাসায় আকুল হইয়া কি দারুণ বিশৃঙ্খল হয় তার হিয়া! তেমনি বিপ্লব ঘোর হৃদয় ভিতরে হ'তেছে দিবস নিশা, জানি না কি-তরে! নবজাত উল্কানেত্র মহাপক্ষ গরুড় যেমন বসিতে না পায় ঠাঁই চরাচর করিয়া ভ্রমণ, উচ্চতম মহীরুহ পদভরে ভূমিতলে লুটে, ভূধরের শিলাময় ভিত্তিমূল বিদারিয়া উঠে, অবশেষে শূন্যে শূন্যে দিবারাত্রি ভ্রমিয়া বেড়ায়, চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ঢাকি ঘোর পাখার ছায়ায়, তেমনি এ ক্লান্ত হৃদি বিশ্রামের নাহি পায় ঠাঁই– সমস্ত ধরায় তার বসিবার স্থান যেন নাই। তাই এই মহারণ্যে অমারাত্রে আসি গো একাকী, মহান্ ভাবের ভারে দুরন্ত এ ভাবনারে কিছুক্ষণ-তরে তবু দমন করিয়া যেন রাখি। চন্দ্রশূন্য আঁধারের নিস্তরঙ্গ সমুদ্রমাঝারে সমস্ত জগৎ যবে মগ্ন হয়ে গেছে একেবারে অসহায় ধরা এক মহামন্ত্রে হয়ে অচেতন নিশীথের পদতলে করিয়াছে আন্তসমর্পণ, তখন অধীর হৃদি অভিভূত হয়ে যেন পড়ে– অতি ধীরে বহে শ্বাস, নয়নেতে পলক না নড়ে। ... প্রাণের সমুদ্র এক আছে যেন এ দেহমাঝারে, মহা উচ্ছ্বাসের সিন্ধু রুদ্ধ এই ক্ষুদ্র কারাগারে! মনের এ রুদ্ধস্রোত দেহখানা করি বিদারিত সমস্ত জগৎ যেন চাহে, সখি, করিতে প্লাবিত! অনন্ত আকাশ যদি হ'ত এ মনের ক্রীড়াস্থল, অগণ্য তারকারাশি হ'ত তার খেলেনা কেবল, চৌদিকে দিগন্ত আসি রুধিত না অনন্ত আকাশ, প্রকৃতি জননী নিজে পড়াত কালের ইতিহাস, দুরন্ত এ মন-শিশু প্রকৃতির স্তন্য পান করি আনন্দসংগীতস্রোতে ফেলিত গো শূন্যতল ভরি, উষার কনকস্রোতে প্রতিদিন করিত সে স্নান, জ্যোছনা-মদিরাধারা পূর্ণিমায় করিত সে পান, ঘূর্ণ্যমান ঝটিকার মেঘমাঝে বসিয়া একেলা কৌতুকে দেখিত যত বিদ্যুৎ-বালিকাদের খেলা, দুরন্ত ঝটিকা হোথা এলোচুলে বেড়াত নাচিয়া তরঙ্গের শিরে শিরে অধীর চরণ বিক্ষেপিয়া। হরষে বসিত গিয়া ধূমকেতুপাখার উপরে, তপনের চারি দিকে ভ্রমিত সে বর্ষ বর্ষ ধরে। চরাচর মুক্ত তার অবারিত বাসনার কাছে, প্রকৃতি দেখাত তারে যেথা তার যত ধন আছে; কুসুমের রেণুমাখা বসন্তের পাখায় চড়িয়া পৃথিবীর ফুলবনে ভ্রমিত সে উড়িয়া উড়িয়া; সমীরণ কুসুমের লঘু পরিমলভার বহি পথশ্রমে শ্রান্ত হোয়ে বিশ্রাম লভিছে রহি রহি, সেই পরিমল সাথে অমনি সে যাইত মিলায়ে– ভ্রমি কত বনে বনে পরিমলরাশি-সনে অতি দূর দিগন্তের হৃদয়েতে যাইত মিশায়ে। তটিনীর কলস্বর পল্লবের মরমর শত শত বিহগের হৃদয়ের আনন্দ-উচ্ছ্বাস সমস্ত বনের স্বর মিশে হ'ত একত্তর একপ্রাণ হোয়ে তারা পরাশত উন্নত আকাশ। তখন সে সঙ্গীতের তরঙ্গে করিয়া আরোহণ মেঘের সোপান দিয়া অতি উচ্চ শূন্যে গিয়া উষার আরক্ত ভাল পারিত গো করিতে চুম্বন! কল্পনা, থাম গো থাম, কোথায়– কোথায় যাও নিয়ে? ক্ষুদ্র এ পৃথিবী, দেবি, কোন্খেনে রেখেছি ফেলিয়ে? মাটির শৃঙ্খল দিয়ে বাঁধা যে গো রোয়েছে চরণ, যত উচ্চৈ আরোহিব তত হব দারুণ পতন! কল্পনার প্রলোভনে নিরাশার বিষ ঢাকা, শূন্যে অন্ধকার মেঘে সন্ধ্যার কিরণ মাখা, সেই বিষ প্রাণ ভোরে সখি লো করিনু পান– মন হ'য়ে গেল, সখি, অবসন্ন– ম্রিয়মাণ। |
||
মুরলা। | কবি গো, ওসব কথা ভেবো নাকো আর, | |
শ্রান্ত মাথা রাখ এই কোলেতে আমার। | ||
কবি | সখি, আর কত দিন সুখহীন শান্তিহীন | |
হাহা কোরে বেড়াইব নিরাশ্রয় মন লোয়ে! পারি নে, পারি নে আর– পাষাণ মনের ভার বহিয়া পড়েছি, সখি, অতি শ্রান্ত ক্লান্ত হোয়ে। সম্মুখে জীবন মম হেরি মরুভূমিসম, নিরাশা বুকেতে বসি ফেলিতেছে বিষশ্বাস। উঠিতে শকতি নাই, যেদিকে ফিরিয়া চাই শূন্য– শূন্য– মহাশূন্য নয়নেতে পরকাশ। কে আছে, কে আছে, সখি, এ শ্রান্ত মস্তক মম বুকেতে রাখিবে ঢাকি যতনে জননী-সম! কে আছে, অজস্র স্রোতে প্রণয়অমৃত ভরি অবসন্ন এ হৃদয় তুলিবে সজীব করি! মন, যত দিন যায়, মুদিয়া আসিছে হায়– শুকায়ে শুকায়ে শেষে মাটিতে পড়ুবে ঝরি। |
||
মুরলা। | [স্বগত] হা কবি, ও হৃদয়ের শূন্য পুরাইতে | |
অভাগিনী মুরলা গো কি না পারে দিতে! কি সুখী হোতেম, যদি মোর ভালোবাসা পুরাতে পারিত তব হৃদয়পিপাসা! শৈশবে ফুটে নি যবে আমার এ মন তরুণ-প্রভাত-সম, কবি গো, তখন প্রতিদিন ঢালি ঢালি দিয়েছ শিশির– প্রতিদিন যোগায়েছ শীতল সমীর! তোমারি চোখের 'পরে করুণ কিরণে এ হৃদি উঠেছে ফুটি তোমারি যতনে! তোমারি চরণে, কবি, দেছি উপহার, যা কিছু সৌরভ এর তোমারি– তোমার। |
||
[ প্রকাশ্যে] | তোল কবি, মাথা তোল, ভেবো না, এমন– | |
দুজনে সরসীতীরে করিগে ভ্রমণ। ওই চেয়ে দেখ, কবি, তটিনীর ধারে মধ্যাহ্নকিরণ লয়ে বনদেবী স্তব্ধ হয়ে দিতেছে বিবাহ দিয়া আলোকে আঁধারে। সাধের সে গান তব শুনিবে এখন? তবে গাই, মাথা তোল, শোন দিয়ে মন।
গান |