ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


ভগ্নহৃদয়
একাদশ সর্গ


    অনিল
     
  অনিল। কিছুই তো হল না!
    সেই সব— সেই সব— সেই হাহাকাররব,
সেই অশ্রুবারিধারা, হৃদয়বেদনা!
কিছুতে মনের মাঝে শান্তি নাহি পাই,
কিছুই না পাইলাম যাহা-কিছু চাই!
ভালো তো গো বাসিলাম— ভালোবাসা পাইলাম,
এখনো তো ভালোবাসি— তবুও কি নাই!
তবুও কেন রে হৃদি শিশুর মতন
দিবানিশি নিরজনে করিছে রোদন!
মনোমত হয় নি বা যা কিছু পেয়েছে,
সকলেরি মাঝে বুঝি অভাব রয়েছে!
আশ মিটাইয়া বুঝি ভালোবাসি নাই,
ভালোবাসা পাই নি বা যতখানি চাই!
যেন গো যাহার তরে মন ব্যগ্র আছে
অশরীরী ছায়া তার দাঁড়াইয়া কাছে,
দুই বাহু বাড়াইয়া করি প্রাণপণ
তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে করি আলিঙ্গন—
ছায়া শুধু— ছায়া শুধু— হৃদয় না পূরে—
তা চেয়ে রহে না কেন শত ক্রোশ দূরে?
আমার এ ঊর্দ্ধ্বশ্বাস পিপাসিত মন
নাহি অনুভবে তার হৃদয়স্পন্দন।
মন চায় হাতে তার রাখি মোর হাত
বুকে তার মাথা রাখি করি অশ্রুপাত!
সেই তো ধরিনু হাত বুকে মাথা রাখি,
দৃঢ় আলিঙ্গন তারে করি থাকি থাকি—
কিন্তু এ কি হল দায়, এ কিসের মায়া?
কিছু না ছুঁইতে পাই, ছায়া সব ছায়া!
তাই ভাবি, মন মোর যা কিছু পেয়েছে
সকলেরি মাঝে বুঝি অভাব রয়েছে!
তৃষিত হৃদয় চায় ভালোবাসা যত
ললিতা ফিরায়ে বুঝি দেয় নাকো তত!
আমি চাই এক সুরে দুই হৃদি বাজে,
আবরণ নাহি রয় দুজনার মাঝে!
সমুদ্র চাহিয়া থাকে আকাশের পানে,
আকাশ সমুদ্রে চায় অবাক্‌ নয়ানে,
তেমনি দোঁহার হৃদি হেরিবে দোঁহায়—
পড়িবে উভের ছায়া উভয়ের গায়!
কিন্তু কেন, ললিতার এত কেন লাজ!
এত কেন ব্যবধান দুজনার মাঝ?
মিলিবার তরে যাই হইয়া অধীর,
মাঝেতে কেন রে হেন লৌহের প্রাচীর?
আমি যাই তাড়াতাড়ি করিতে আদর,
তারে হেরে উল্লাসেতে নাচে গো অন্তর,
মিলিবারে অর্দ্ধপথে সে আসে না ছুটে—
তার মুখে একটিও কথা নাহি ফুটে!
জানি গো ললিতা মোরে ভালোবাসে মনে,
যাতে আমি ভালো থাকি করে প্রাণপণে—
কিন্তু তাহে কিছুতেই তৃপ্ত নহে প্রাণ!
দুজনার মাঝে কেন এত ব্যবধান?
যেমন নিজের কাছে লাজ নাহি থাকে
তেমনিই মনে কেন করে না আমাকে?
             কিছুই গো হল না!
সেই-সব, সেই-সব— সেই হাহাকাররব
সেই অশ্রুবারিধারা হৃদয়বেদনা!
           [ললিতার প্রবেশ]
  ললিতা।  কেন গো বিষণ্ন হেরি নাথের বদন?
    না জেনে কি দোষ কিছু করেছি এমন?
একবার কাছে গিয়ে ধরি দুটি হাত
শুধাব কি— "হয়েছে কী?    অবোধ ললিতা সে কি
না বুঝে হৃদয়ে তব দিয়েছে আঘাত?"
সেদিন ত শুধালেন নাথ যবে আসি
"একবার বল্‌ তো রে    ভালো কি বাসিস মোরে?"
মুক্তকণ্ঠে বলেছিনু ‘নাথ, ভালোবাসি!’
একেবারে সব লজ্জা দিনু বিসর্জন,
বুকে তাঁর মুখ রেখে করেছি রোদন—
কাঁদিয়ে কহেছি কথা,    জানায়েছি সব ব্যথা
যত কথা রুদ্ধ ছিল মরমতলেতে,
এত দিন বলি বলি পারি নি বলিতে!
সেদিন তো কোন লজ্জা ছিল নাকো আর,
কিন্তু গো আবার কেন উদিল আবার!
হেথায় দাঁড়ায়ে আমি রহি এক ধারে—
এখনি দেখিতে নাথ পাবেন আমারে!
ডাকিলেই কাছে গিয়ে সব লজ্জা বিসর্জিয়ে
একেবারে পায়ে ধরে কেঁদে গিয়ে কব,
"বলো, নাথ, কী করেছি? কী হয়েছে তব?"
  অনিল। এমন বিষণ্ন হয়ে বসে আছি হেথা
    তবুও সে দূরে আছে— তবু সে এল না কাছে,
তবুও সে শুধালে না একটিও কথা!
পাষাণ বজ্রেতে গড়া এ লজ্জা তাহার
প্রেমবরিষার নদী    ভাঙিতে নারিল যদি,
দয়াতেও ভাঙিবে না হেরি অশ্রুধার?
লজ্জার একাধিপত্য যে নিষ্ঠুর মনে,
প্রেম দয়া যে হৃদয়ে    বাস করে ভয়ে ভয়ে,
চরণে শৃঙ্খল বাঁধা লজ্জার শাসনে—
অনিল, কি করিবি রে লয়ে হেন মন?
তুই চাস মুখে তোর    হেরিলে বিষাদ ঘোর
অশ্রুজলে অশ্রুজল করিবে বর্ষণ!
কত না আদরে তোর মুঝাবে নয়ন!
তুই কি চাস রে হেন পাষাণমুরতি
দূরে দাঁড়াইয়া রবে—  একটি কথা না কবে,
সান্ত্বনার তরে যবে তুই ব্যগ্র অতি?
হায় রে অদৃষ্ট মোর, কিছুই হল না—
সেই-সব, সেই-সব—   সেই হাহাকাররব
সেই অশ্রুবারিধারা হৃদয়বেদনা!
                  [অনিলের বেগে প্রস্থান]
  ললিতা।            [স্বগত]
    নয়নে আঁধার হেরি, ঘুরিছে সংসার,
মা গো মা— কোথায় মা গো— পারি নে মা আর!
              'বৃক্ষতলে বসিয়া পড়িয়া]
গেলে তবে গেলে চলি নিষ্ঠুর— নিষ্ঠুর—
ললিতা যে এক ধারে    দাঁড়ায়ে রয়েছে হা রে
একটু আদর-তরে হয়ে তৃষাতুর!
কখন্‌ ডাকিবে ব'লে আছে মুখ চেয়ে,
একটু ইঙ্গিতে পায়ে পড়িত গো ধেয়ে—
দেখেও, দেখেও তারে গেলে গো চলিয়া?
একবার ডাকিলে না ললিতা বলিয়া?
দোষ কি করেছি কিছু সখা গো আমার?
তারি লাগি কেন না করিলে তিরস্কার?
একবার চাহিলে না,    ফিরেও গো দেখিলে না,
এমন কি অপরাধ পারি করিবারে?
তবে কেন, কেন, নাথ, বলো নি আমারে?
যদি সখা, পায়ে ধ'রে    শত-শতবার ক'রে
শুধাই গো, বলিবে কি, কি দোষ করেছি?
অভাগিনী যদি, নাথ, যদি ম'রে যাই—
মরণশয্যায় শুয়ে শেষ ভিক্ষা চাই,
চরণদুখানি ধুয়ে শেষ অশ্রুজলে,
দুখিনী ললিতা তব কেঁদে কেঁদে বলে,
তবুও কি ফিরিবে না?    তবুও কি চাহিবে না?
তবুও কি বলিবে না কি দোষ করেছি!
তবুও কি, সখা, তুমি যাইবে চলিয়া?
একবার ডাকিবে না 'ললিতা' বলিয়া?