ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


ভগ্নহৃদয়
দ্বাদশ সর্গ


    নলিনী বিজয় বিনোদ প্রমোদ অশোক সুরেশ নীরদ ও অনিল
     
  সুরেশ। যাইতে বলিছ বালা, কোথা যাব আর?
    দিগ্বিদিক হারাইয়া    ও রূপ-অনলে গিয়া
এ পতঙ্গ পাখা দুটি পুড়ায়েছে তার!
রূপসী, ক্ষমতা আর নাই উড়িবার!
 
  নলিনী। রূপ কিছু মোর না যদি থাকিত
          বড়ো হইতাম সুখী,
দেখিতাম যত পতঙ্গ তোমরা
      আসিতে কি লোভ দেখি!
রূপ— রূপ— রূপ— পোড়া রূপ ছাড়া
      আর কিছু মোর নাই?
তোমাদের মত পতঙ্গের দল
চারি দিকে ঘিরে করে কোলাহল,
দিবস রজনী করে জ্বালাতন,
ঝাঁপায়ে পড়ে গো, না মানে বারণ—
পোড়া রূপ থেকে এই যদি হল
     হেন রূপ নাহি চাই!
     হেন কেহ নাই হায়
শুধু ভালোবাসে নালিনী বালারে,
     আর কিছু নাহি চায়!

        [অশোকের প্রতি]
এই যে অশোক!    ওই দেখ সখা—
       দিবে কি আমারে দিবে কি তুলে
বক্ষ হতে মোর ফুল উড়ে গিয়ে
      পড়েছে তোমার চরণমূলে!
যদি সখা ওটি রাখিতে চাও
তোমারি কাছেতে রাখিয়া দাও—
দুদণ্ডেই ওটি যাইবে শুকায়ে,
      শুকায়ে গেলেই দিও গো ফেলে!
যতখন ওটি নাহি প’ড়ে ঝ’রে
ততখনো যদি মনে রাখ মোরে
      ততখনো যদি না থাক ভুলে,
তা হলেও, সখা, বড়ো ভাগ্য মানি
      চিরকাল মনে সে কথা রবে!
যদি, সখা, নাহি লইতে চাও
এখনি ভূতলে ফেলিয়া দাও,
      চরণে দলিয়া ফেল গো তবে!
কত শত হেন অভাগা কুসুম
      আপনি পড়েছে চরণে আসি,
কত শত লোক চেয়েও দেখে নি,
       চরণে দলিয়া গিয়াছে হাসি!
তবে আর কেন, ফেল গো দলিয়া—
       কিসের সরম আমার কাছে?
যে কুসুম, সখা, শাখা হতে ঝ’রে
চরণের নীচে পড়ে সাধ ক’রে,
কে না জানে বলো তাহার কপালে
       চরণে দলিয়া মরণ আছে!

        [নীরদের প্রতি]
এই যে নীরদ, এনেছ গাঁথিয়া
      গোলাপ ফুলের হার!
ভুলে গেছ কেন বাছিয়া ফেলিতে
      কাঁটাগুলি, সখা, তার?
      তবে গো পরায়ে দাও—
নাহয় কাঁটায় ছিঁড়িবে হৃদয়,
নাহয় এ বুক হবে রক্তময়,
এনেছ গাঁথিয়া গোলাপ যখন
      তবে গো পরায়ে দাও!
কতই না কাঁটা বিঁধিয়াছে হেথা
      রাখিতে গোলাপ বুকের কাছে,
জ্বলুক্‌ হৃদয়— বহুক্‌ শোণিত—
     তা বলে গোলাপ ফেলিতে আছে?

        [প্রমোদের প্রতি]
চাই নে তোমার ফুল-উপহার,
        যাও— হেথা হতে যাও!
দুটি ফুল দিয়ে, ফুলবিনিময়ে
        হাসি কিনিবার চাও!
নলিনী, নলিনী, কেন রে হলি নি
       পাষাণকঠিন-মন?
দুটো কথা শুনে, দুটো ফুল পেয়ে
       ভাঙে কেন তোর পণ?
পলকে পলকে ভাঙিস গড়িস—
       ভেঙে যায় মৃদু শ্বাসে,
যার ’পরে তুই করিস লো মান
       সেই মনে মনে হাসে!
দেখি আজ তুই কেমন পারিস
       থাকিবারে অভিমানে?
কহিস নে কথা, হাসিস নে হাসি,
       চাহিস নে তার পানে!
  বিনোদ। একটি কথাও কহিল না মোরে,
          পাশ দিয়া গেল চলি!
গর্বভারগুরু প্রতি পদক্ষেপে
      মরমে মরমে দলি।
কেন গো, কেন গো; কি আমি করেছি—
      কিছু তো না পড়ে মনে!
কহেছে তো কথা প্রমোদের সাথে,
      অশোক নীরদ-সনে!
গেল হে হৃদয়— কত দিন আর
      রবে সে এমন করি
কখনো উঠিয়া আকাশের ’পরে
      কখনো পাতালে পড়ি!
  অনিল। [দূর হইতে দেখিয়া]
    না জানি কিসের জ্যোতি নয়নে আছে গো বালা!
যে দিকে চাহিয়া দেখ সে দিক করিছ আলা।
অন্ধকারভেদী এক হাসিময় তারা-সম
প্রাণের ভিতর-পানে চাহিয়া মম!
ফিরায়ে লইনু মুখ, তবুও কেন গো দেখি
চাহিছে হৃদয়-পানে দুটি হাসিমাখা আঁখি!
আঁখি মুদি, তবু কেন হেরি গো প্রাণের কাছে
দুটি আঁখি চেয়ে আছে    এক দৃষ্টে চেয়ে আছে!
হেথা না পাইবি ঠাঁই— দূর হ তুই রে তারা—
চন্দ্রমা জোছনা করি    এ হৃদি রেখেছে ভরি,
তুই তারা সে আলোকে হইবি আপনাহারা!
দূর হ রে— দূর হ রে— দূর হ রে ক্ষুদ্র তারা!
কিন্তু কি মধুর মুখ ভাবভরে ঢলঢল!
কোমলকুসুমসম সমীরণে টলমল!
দেখি নি এহেন মুখ সুমধুর ভাবময়!
কেন? ললিতার মুখ এ হতে কি ভালো নয়?
আহা সে মধুর বড়ো ললিতার মুখখানি—
আঁখি কত কথা কয়, মুখেতে নাইক বাণী,
বাহির হইতে চায় তার সেই মৃদু হাসি—
অধরের চারি ধারে   কতবার উঁকি মারে,
লজ্জায় মরিয়া যায় কেবল দুই পা আসি!
তার মুখ পূর্ণরাকা    শরমের মেঘে ঢাকা,
মধুর মুখানি তার আমি বড়ো ভালোবাসি!
ললিতার চেয়ে কি গো মুখখানি ভালো এর?
উভেরই মধুর মুখ— দুই ভাব দু-জনের—
ললিতা সে লাজময়ী মুখেতে নাইক কথা,
মাটি-পানে চেয়ে আছে যেন লজ্জাবতী লতা;
নলিনী, নলিনীসম কেমন রয়েছে ফুটি,
বরষার নদী জল    করিতেছে টলমল
হেলি দুলি লহরীতে পড়িতেছে লুটি লুটি।
উভেরই মধুর মুখ ললিতার, নলিনীর—
অধীর সৌন্দর্য্য কারো, কারো বা প্রশান্ত স্থির!
কিন্তু নলিনীর মুখ ভাবের খেলার গেহ—
সেথা ভাবশিশুগুলি      করিতেছে কোলাকুলি,
কেহ বা অধরে হাসে, নয়নে নাচিছে কেহ,
এই যে অধরে ছিল এই সে নয়নে গেছে,
দু-দণ্ড খেলায়ে কেহ ঘুমাইয়া পড়িয়াছে!
কভু বা দু-তিন জনে নাচিতেছে এক সনে,
পলক পড়িতে চোখে আর তো তাহারা নাই—
নলিনীর মুখখানি ভাবের খেলার ঠাঁই!
নলিনীর মুখপানে যতই চাহিয়া থাকি
নূতন নূতন শোভা দেখিতে পায় যে আঁখি!
কিন্তু ললিতার মুখ কখনো এমন নয়।
এত সে কয় না কথা,     এত ভাব নাই সেথা,
নহে গো এমনতর অধীমাধুর্যময়!
নাই বা এমন হল তাহাতে কি আছে হানি?
নাহয় দেখিতে ভালো নলিনীর মুখখানি!
তবু ললিতারে মোর ভালো আমি বাসি তো রে!
তবু ত সৌন্দর্য্য তার এ হৃদি রয়েছে ভরে!
রূপেতে কি যায় আসে?    রূপ কেবা ভালো বাসে?
ললিতা নলিনী-আছে নাহয় রূপেতে হারে—
ভালোবাসি— ভালোবাসি— তবু আমি ললিতারে!
          [বিনোদের কাছে পুনর্বার ফিরিয়া আসিয়া]
  নলিনী। কেন হেন আহা মলিন আনন,
          আঁখি নত মাটি-পানে!
তোমারে, বিনোদ, পাই নি দেখিতে
       দাঁড়াইয়া এইখানে!
শিথিল হইয়া পড়েছে ঝুলিয়া
       ফুলের বলয় মোর,
দাও-না গো, সখা, দাও না তুলিয়া,
       বাঁধ গো আঁটিয়া ডোর!

               নলিনীর গান
এসো মন, এসো,       তোমাতে আমাতে
             মিটাই বিবাদ যত!
আপনার হয়ে            কেন মোরা দোঁহে
             রহি গো পরের মত?
আমি যাই এক          দিকে, মন মোর!
            তুমি যাও আর দিকে—
যার কাছ হতে ফিরাই নয়ন
            তুমি চাও তার দিকে!
তার চেয়ে এস দুজনে মিলিয়ে
হাত ধরে যাই এক পথ দিয়ে,
আমারে ছাড়িয়ে অন্য কোনোখানে
      যেও না কখনো আর!
পারি না কি মোরা দুজনে থাকিতে,
দোঁহে হেসে খেলে কাল কাটাইতে?
তবে কেন তুই না শুনে বারণ
      যাস্‌ রে পরের দ্বার?
তুমি আমি মোরা থাকিতে দুজন,
বল্‌ দেখি, হৃদি, কিবা প্রয়োজন
      অন্য সহচরে আর?
এত কেন সাধ বল্‌ দেখি, মন,
পর-ঘরে যেতে যখন তখন—
      সেথা কি রে তুই আদর পাস্‌?
বল্‌ তো কত-না সহিস যাতনা?
দিবানিশি কত সহিস লাঞ্ছনা?
       তবু কি রে তোর মিটে নি আশ?
আয়, ফিরে আয়, মন, ফিরে আয়—
       দোঁহে এক সাথে করিব বাস!
অনাদর আর হবে না সহিতে,
দিবস রজনী পাষাণ বহিতে,
মরমে দহিতে, মুখে না কহিতে,
       ফেলিতে দুখের শ্বাস!
শুনিলি নে কথা?     আসিলি নে হেথা?
      ফিরিলি নে একবার?
সখি লো, দুরন্ত হৃদয়ের সাথে
      পেরে উঠি নে তো আর!
"নয় রে সুখের খেলা ভালোবাসা!"
      কত বুঝালেম তায়—
হেরিয়া চিকণ সোনার শিকল
খেলাইতে যায় হৃদয় পাগল,
খেলাতে খেলাতে না জেনে না শুনে
     জড়ায় নিজের পায়!
বাহিরিতে চায়, বাহিরিতে নারে,
     করে শেষে হায়-হায়!
শিকল ছিঁড়িয়ে এসেছে ক'বার,
     আবার কেন রে যায়?
চরণে শিকল বাঁধিয়া কাঁদিতে
     না জানি কি সুখ পায়!
তিলেক রহে না আমার কাছেতে
     যতই কাঁদিয়া মরি,
এমন দুরন্ত হৃদয় লইয়া,
      সজনি, বল্‌ কি করি?
           ---
  অনিল। ওঠ্‌ হেথা হতে— চল্‌ চল্‌ যাই,
         কি কারণে হেথা আছিস্‌ আর!
মুদিয়া আসিছে মনের নয়ন,
     মনের চরণে পড়িছে ভার!
ললিতা আমার, না থাকুক্‌ রূপ,
     নাই বা গাহিতে পারিলি গান,
ভালোবাসি তোরে, ভালোবাসিব রে
     যত দিন দেহে রহিবে প্রাণ!

      [নলিনী ব্যতীত আর সকলের প্রস্থান]
  নলিনী। পারি নে তো আর, বসি এই খানে,
           ওই যে এ দিকে আসিছে কবি!
কথা আজ মোরে কহিতে হইবে,
      র'ব না বসিয়া অচল ছবি!
কি কথা বলিব? ভাবিতেছি মনে,
      কিছুই তো ভেবে নাহিক পাই!
বলিব কি তারে— "তোমরা কবি গো,
      তোমাদের ভালো বাসিতে নাই!
বুঝিতে পার না আপনার মন,
     দিবানিশি বৃথা কর গো শোক!
ভালোবাসা-তরে আকুল হৃদয়,
     ভালোবাসিবার পাও না লোক!
মনে তোমাদের সৌন্দর্য্য জাগিছে
     ধরায় তেমন পাও না খুঁজে,
তবুও তো ভালো বাসিতেই হবে
     নহিলে কিছুতে মন না বুঝে।
অবশেষে কারে পাও দেখিবারে
     নেশায় আপনা ভুলি,
সাজাইয়া দেয় কলপনা তারে
     নিজের গহনা খুলি।
আসি কলপনা কুহকিনীবালা
      নয়নে কি দেয় মায়া,
কলপনা তারে ঢেকে রাখে নিজে
     দিয়ে নিজে জ্যোতিছায়া।
কল্পনাকুহকে মায়া মুগ্ধ চোখে
     কি দেখিতে দেখ কিবা,
অপরূপ সেই প্রতিমা তাহার
    পুজ মনে নিশি দিবা!
যত যায় দিন, যত যায় দিন,
    যত পাও তারে পাশে,
দেবীর জ্যোতি সে হারায় তাহার
     মানুষ হইয়া আসে!
ভালোবাসা যত দূরে চলি যায়
     হাহাকার করে মনে,
কলপনা কাঁদে ব্যথিত হইয়া
     আপনার প্রতারণে!
আমি গো অবলা— করিব প্রণয়
     অত নাহি করি আশা,
আমি চাই নিজ মনের মানুষ
     সাদাসিদে ভালোবাসা!’
এমনি করিয়ে বাতাসের ’পরে
     মিছে অভিমান বাঁধি
অকারণে তার করিব লাঞ্ছনা
     অভিমানে কাঁদি কাঁদি।
কিছুতে সান্ত্বনা না আমি মানিব,
      দূরেতে যাইব চলে—
কাছেতে আসিতে করিব বারণ
      করুণ চোখের জলে!