ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
কবি ও মুরলা | ||
মুরলা। | কবি গো আমার, যদি আমি ম’রে যাই | |
তা হ'লে কি বড়ো কষ্ট হয় গো তোমার? | ||
কবি। | ওকি কথা মুরলা লো, বলিতে যে নাই! | |
তুই ছেলেবেলাকার সঙ্গিনী আমার! কাঁদিস্ না, কাঁদিস্ না, মোছ্ অশ্রুধার! আহা, সখি, বড়ো সুখী হই আমি মনে যদি দেখি প্রেমে তুই পড়েছিস্ কার, সুখেতে আছিস্ তোরা মিলি দুইজনে! নিরাশ্রয় মনে আসে কত কি ভাবনা, কিছুতে অধীর হৃদি মানে না সাত্ত্বনা— সজনি, অমন সব ভাবনা-আঁধার ভাবিস্ নে কখনো লো, ভাবিস্ নে আর! |
||
মুরলা। | কবি গো, রজনীগন্ধা ফুটেছিল গাছে— | |
তুমি ভালোবাস ব'লে আপনি
এনেছি তুলে, নেবে কি এ ফুলগুলি, রাখিবে কি কাছে? কবি। সখি লো, নলিনী কাল দুটি চাঁপা তুলে পরায়ে দেছিল মোর দুই কর্ণমূলে, পরশিতে দলগুলি পড়িছে ঝরিয়া, এখনো সুবাস তার যায় নি মরিয়া। |
||
মুরলা। | দেখি সখা, একবার দেখি হাতখানি— | |
এ হাত কাহারে, কবি, করিবে অর্পণ? কত ভালো তোমারে সে বাসিবে না জানি! না জানি, তোমারে কত করিবে যতন! কিসে তুমি রবে সুখী সকলি সে জানিবে কি? দেখিবে কি প্রতি ক্ষুদ্র অভাব তোমার? তোমার ও মুখ দেখি অমনি সে বুঝিবে কি কখন পড়েছে হৃদে একটু আঁধার! অমনি কি কাছে গিয়ে কত-না সান্ত্বনা দিয়ে দূর করি দিবে সব বিষাদ তোমার? তাই যেন হয়, কবি, আর কিবা চাই— তা হলেই সুখী হব রহি না যেথাই। |
||
কবি। | মুরলা, সখি লো, | |
কেন আজ মন মোর উঠিছে কাঁদিয়া? বিষাদ ভুজঙ্গসম কেন রে হৃদয় মম দলিতেছে চারি দিকে বাঁধিয়া বাঁধিয়া? ছেলেবেলা হতে যেন কিছুই হল না, যত দিন বেঁচে রব কিছুই হবে না, এমনি করেই যেন কাটিবেক দিন, কাঁদিয়া বেড়াতে হবে সুখশান্তিহীন! কেহ যেন নাহি মোর, রবে নাকো কেহ— ধরায় নাইক যেন বিশ্রামের গেহ। কিছু হারাই নি তবু খুঁজিয়া বেড়াই, কিছুই চাই না তবু কি যেন কি চাই! কোনো আশা না করিয়া নৈরাশ্যেতে দহি, কোনো কষ্ট না পাইয়া তবু কষ্ট সহি! কেন রে এমন কেন হল আজ মন? দিয়েছি তো, পেয়েছি তো ভালোবাসা-ধন! তুই কাছে আয় দেখি, আর একবার, মুখ তোর রাখ্ দেখি বুকেতে আমার! দেখি তাহে এ হৃদয় শান্তি পায় যদি! কে জানে উচ্ছ্বসি কেন উঠিতেছে হৃদি! দেখি তোর মুখখানি সখি, তোর মুখখানি— বুকে তোর মুখ চাপি— কেন, সখি, কেন সহসা উচ্ছ্বসি কাঁদি উঠিলি রে হেন? যেন বহুক্ষণ হতে যুঝিয়া যুঝিয়া আর পারিল না, হৃদি গেল গো ভাঙ্গিয়া! কী হয়েছে বল্ মোরে, বল্, সখি, বল্— লুকাস্ নে, লুকাস্ নে দুখ-অশ্রুজল! পৃথিবীতে কেহ যদি নাহি থাকে তোর এই হেথা এই আছে এই বক্ষ মোর! এ আশ্রয় চিরকাল রহিবে তোমার, এ আশ্রয় কখনোই হারাবি নে আর! কাঁদিবি যখন চাস্ হেথা মুখ ঢাকি, তোর সাথে বরষিবে অশ্রু মোর আঁখি! |
||
মুরলা। | তুমি সুখী হও, কবি, এই আমি চাই— | |
তুমি সুখী হলে মোর কোন দুঃখ নাই! | ||
কবি। | আমি সুখী নই সখি, সুখী কেবা আর? | |
বল্ দেখি মুরলা লো কি দুঃখ আমার! অমন নলিনী মোর হৃদয়ের ধন সে আমার— সে আমার কাছে গো যখন, পেয়েছি যখন আমি তার ভালোবাসা, তখন আমার আর কিসের বা আশা? পেয়েছি যখন আমি তোর মত সখী— দুখে মোর দুখ পায়, সুখে মোর সুখী— তবে বল্ দেখি, সখি, কি দুঃখ আমার? তবে যে উঠেছে মনে বিষাদ-আঁধার শরতের মেঘসম দু-দণ্ডে মিলাবে, কোথা হতে আসিয়াছে কোথায় বা যাবে! এখনি নলিনী-কাছে যাই একবার, এখনি ঘুচিবে এই বিষাদের ভার! মুরলা সখি লো, তুমি থাকিস্ হেথাই, ফিরে এসে পুনঃ যেন দেখিবারে পাই! [কবির প্রস্থান |
||
মুরলা। | ফিরে এসে মুরলারে পাবে না দেখিতে! | |
কবি মোর, আরেকটু যদি গো থাকিতে! নলিনী তো চিরজন্ম রহিবে তোমার, আমি যে ও মুখ কভু হেরিব না আর! ও মুখ কি আর কভু পাব না দেখিতে যত দিন হবে মোরে বাঁচিয়া থাকিতে? পল যাবে, দণ্ড যাবে, দিন যাবে, মাস যাবে, বর্ষ বর্ষ করি যাবে জীবন আমার— ও মুখ দেখিতে তবু পাব নাকো আর? মুরলা, পারিবি তুই? পরিবি থাকিতে? দারুণ পাষাণে মন বাঁধিয়া রাখিতে? না, না, না, মুরলা তুই যাইবি কোথায়? অসীম সংসারে তোর কে আছে রে হায়? হবে যা অদৃষ্টে আছে, থাকিস কবির কাছে— কবি তোর সুখ শান্তি হৃদয়ের ধন, থাকিস জড়ায়ে ধরি কবির চরণ, কবির চরণে শেষে ত্যজিস জীবন! কিন্তু স্বার্থপর তুই কি করিয়া রবি? বিষণ্ন ও মুখ তোর নিরখিয়া কবি এখনো কাঁদেন যদি, এখনো তাঁহার হৃদি পুরানো বিষাদ যদি করে গো স্মরণ? সেই ছেলেবেলাকার বিষাদযন্ত্রণাভর আমি যদি তাঁর মনে জাগাইয়া রাখি— তবে, রে হতভাগিনী, কি বলিয়া থাকি! তবে আমি যাই, তবে যাই, তবে যাই— কেহ মোর ছিল নাকো, কেহ মোর নাই! মুরলা বলিয়া কেহ আছে কি ভুবনে? মুরলা বলিয়া যারে ভাবিতেছি মনে সে একটি নিশীথের স্বপ্ন মোহময়, দেখিব স্বপন ভাঙি মুরলা সে নয়! নাই তার সুখ দুখ, নাই ভালোবাসা, নাই কবি— নাই কেহ— নাই কোন আশা! কেহই সে নয়, আর কেহ তার নাই, তবে কি ভাবনা আর— যেথা ইচ্ছা যাই! কিন্তু কবি মোর, আহা ভালোবাসাময়, আমারে না দেখে যদি তাঁর কষ্ট হয়? থাম্ থাম্, মুরলা রে, কেন মিছে বারে বারে মনেরে প্রবোধ দিস ও কথা বলিয়া! শুনিলে জগৎ যে রে উঠিবে হাসিয়া! চল্ তুই, চল্ তুই— যেথা ইচ্ছা চল্ তুই, কেহ নাই তোর লাগি কাঁদিবার তরে! তবে চলিলাম, কবি, দূর দেশান্তরে! অন্তর্যামী দেবতা গো, শুন একবার, যদি আমি ভালোবাসি করিবে আমার কবি যেন সুখী হয়, নলিনী সে সুখে রয়— সখারে আমার আমি ভালোবাসি যত নলিনীবালাও যেন ভালোবাসে তত! নলিনীবালার যত আছে দুখজ্বালা সব যেন মোর, হয়, সুখে থাক্ বালা! তবে চলিলাম কবি, আমি চলিলাম— মুরলা করিছে এই বিদায়প্রণাম! |