ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
ভগ্নহৃদয়
দ্বিতীয়
সর্গ
ক্রীড়াকানন। নলিনী ও সখীগণ |
||
নলিনী। | সখি! অলকচিকুরে কিশলয়-সাথে | |
একটি গোলাপ পরায়ে দে। চারু! দেখি ও আরশীখানি; বালা! সিঁথিটি দে তো লো আনি; লীলা! শিথিল কুন্তল দেখ্ বার বার কপোলে দুলিয়া পড়িছে আমার, একটু এপাশে সরায়ে দে। |
||
সুরুচি। | মাধবী! বল্ তো মোরে একবার | |
আজিকে হ'ল কি তোর! কতখন ধ'রে গাঁথিছিস্ মালা এখনো কি শেষ হ'ল না তা বালা? এক মালা গেঁথে করিবি না কি লো সারাটি রজনী ভোর? অনিলের হবে ফুলশয্যা আজ, সাঁঝের আগেই শেষ করি সাজ সব সখী মিলি যেতে হবে সেথা তা কি মনে আছে তোর? |
||
অলকা। | মরি মরি কিবা সাজাবার ছিরি | |
চেয়ে দেখ্ একবার! সখীর অমন ক্ষীণ দেহমাঝে কমলফুলের মালা কি লো সাজে? বিনোদিনী দেখ্ গাঁথিছে বসিয়া কমলের ফুলহার! |
||
নলিনী। | ওই দেখ্, সখি, দাঁড়ের উপরে | |
মাথাটি গুঁজিয়া পাখার ভিতরে শ্যামাটি আমার– সাধের শ্যামাটি কেমন ঘুমায়ে আছে! আন্ সখি ওরে কাছে! গান গেয়ে গেয়ে, তালি দিয়ে দিয়ে, ঘিরে বসি ওরে সকলে মিলিয়ে– দেখিব কেমন ফিরে ফিরে ফিরে তালে তালে তালে নাচে। শ্যামার প্রতি গান নাচ্, শ্যামা, তালে তালে। বাঁকায়ে গ্রীবাটি তুলি পাখা দুটি এপাশে ওপাশে করি ছুটাছুটি নাচ্, শ্যামা, তালে তালে। রুণু রুণু ঝুনু বাজিছে নূপুর, মৃদু মৃদু মধু উঠে গীতসুর, বলোয়ে বলোয়ে বাজে ঝিনি ঝিনি, তালে তালে উঠে করতালিধ্বনি– নাচ্, শ্যামা, নাচ্ তবে! নিরালয় তোর বনের মাঝে সেথা কি এমন নূপুর বাজে? বনে তোর পাখী আছিল যত গাহিত কি তারা মোদের মত এমন মধুর গান? এমন মধুর তান? কমলকরের করতালি হেন দেখিতে পেতিস্ কবে? নাচ্, শ্যামা, নাচ্ তবে! বন্দী বোলে তোর কিসের দুখ? বনে বল্ তোর কি ছিল সুখ? বনের বিহগ কি বুঝিবি তুই আছে লোক কত শত যারা, শ্যামা, তোর মত এমনি সোনার শিকলি পরিয়া সাধের বন্দী হইতে চায়! এই গীতরবে হয়ে ভরপুর শুনি শুনি এই চরণনূপুর জনম জনম নাচিতে চায়! সাধ করে ধরা দেয় গো তারা, সাথে সাথে ভ্রমি হয় গো সারা, ফিরেও দেখি নে– ফিরেও চাহি নে– বড়ো জ্বালাতন করে গো যখন অশরীরী বাজ করি বরিষণ– উপেখা-বাণের ধারা! তবে দেখ, পাখী, তোর কেমন ভাগ্যের জোর! বড়ো পুণ্যফলে মিলেছে বিহগ এমন সুখের কারা! আয় পাখী, আয় বুকে! কপোলে আমার মিশায়ে কপোল নাচ্, নাচ্ নাচ্ সুখে! বড়ো দুখ মনে, বনের বিহগ, কিছু তুই বুঝিলি না! এমন কপোল অমিয়মাখা চুমিলি, তবুও ঝাপটি পাখা উড়িতে চাহিস্ কি না! প্রতি পাখা তোর উঠে নি শিহরি? পুলকে হরষে মরমেতে মরি ঘুরিয়া ঘুরিয়া চেতনা হারায়ে পদতলে পড়িলি না? নাচ্ নাচ্ তালে তালে! বাঁকায়ে গ্রীবাটি তুলি পাখা দুটি এপাশে ওপাশে করি ছুটাছুটি নাচ্, শ্যামা, তালে তালে! |
||
দামিনী। | শুনেছিস সখি, বিবাহসভায় | |
বিনোদ আসিবে আজ! ভালো করে কর্ সাজ! |
||
নলিনী। | আহা মরে যাই কি কথা বলিলি, | |
শুনিয়া যে হয় লাজ! বিনোদ আসিবে আজ? এ বারতা দিয়ে কেন, লো সজনি, মাথায় হানিলি বাজ? সারাখন মোর সাথে সাথে ফিরে ক্ষান্ত নহে একটুক, মুখখানা তার দেখিবারে পাই যে দিকে ফিরাই মুখ! এক-দৃষ্টে হেন রহে সে তাকায়ে থেকে থেকে ফেলে শ্বাস, মুখেতে আঁচল চাপিয়া চাপিয়া রাখিতে পারি নে হাস! |
||
লীলা। | শুনেছি প্রমোদ আসিবে, যাহারে | |
ভ্রমর বলিয়া ডাকি– যাহারে হেরিলে হরষে তোমার উজলিয়া উঠে আঁখি। |
||
নলিনী। | গা ছুঁয়ে আমার বল্, লো সজনি, | |
সত্য সে আসিবে নাকি? দেখ্, দেখি সখি, অভাগীর তরে কোথাও নিস্তার নাই, মরি মরি কিবা ভ্রমর আমার! ভ্রমরের মুখে ছাই! সে ছাড়া ভ্রমর আর কি নাই? তা হলে এখনি– সখি রে, এখনি নলিনী-জনম ঘুচাতে চাই! |
||
চারুশীলা। | লুকাস্ নে মোরে, আমি জানি সখি, | |
কে তোমার মনোচোর। বলিব? বলিব? হেথা আয় তবে, বলি কানে কানে তোর! [কানে কানে কথা] |
||
নলিনী। | জ্বালাস্ নে চারু, জ্বালাস্ নে মোরে, | |
করিস্ নে নাম তার! সুরেশ?– তাহার জ্বালায়, সজনি, বেঁচে থাকা হ'ল ভার! কে জানিত আগে বল্ তো, সখি লো, রূপের যাতনা অতি? সাধ যায় বড়ো কুরূপা হইয়া লভি শান্তি এক রতি! [লীলার প্রতি জনান্তিকে] |
||
মাধবী। | শোন্ বলি লীলা, জানি কারে সখি | |
মনে মনে ভালো বাসে। দেখিনু সেদিন বিজয়ের সাথে বসি আছে পাশে পাশে। মৃদু হাসি হাসি কত কহে কথা, কভু লাজে শির নত, কভু ল'য়ে কেশ বেণী ফেলি খুলে– জড়ায়ে জড়ায়ে মৃণাল আঙ্গুলে আন্মনে খেলে কত! কখন বা শুনে অতি একমনে বিজয়ের কথাগুলি, শুনিতে শুনিতে শির নত করি তুলি কুঁড়ি এক কতখন ধরি খুলি খুলি দেয় মুদিত পাপড়ি, ফুটাইয়া তারে তুলি। কভু বা সহসা উঠিয়া যায়, কভু বা আবার ফিরিয়া চায়– মৃদু মৃদু স্বরে গুন্ গুন্ করে উঠে এক গান গেয়ে! এমন মধুর অধীরতা তার! এমন মোহিনী মেয়ে! |
||
বিনো। | সখি লো, তা নয়, কতবার আমি | |
দেখিয়াছি লুকাইয়া অশোকের সাথে বসি আছে একা প্রমোদকাননে গিয়া! জানি আমি তারে হেরিলে সখীর সুখে নেচে উঠে হিয়া। |
||
নলিনী। | হেথা আয় তোরা, দে দেখি সাজায়ে | |
শ্যামা-পাখীটিরে মোর! দুটি ফুল বসা দুইটি ডানায়, বেলকুঁড়ি-মালা কেমন মানায় সুগোল গলায় ওর! ওই দেখ্ সখি! দেখি নি কখনো এমন দুরন্ত পাখী! যতগুলি ফুল দিলেম পরায়ে সবগুলি দেখ্ ফেলেছে ছড়ায়ে, শত শত ভাগে ছিঁড়িয়া ছিঁড়িয়া একটি রাখে নি বাকী! ভালো, পাখী যদি না চায় সাজিতে আমারে সাজা লো তবে। |
||
চারু। তোর সাজ ফুরাইবে কবে? লীলা। সখি, আবার কিসের সাজ? সুরুচি। দেখ্, এসেছে হইয়া সাঁঝ। নলিনী। দেখ্ লো সুরুচি, লীলা ভালো করে |
||
বাঁধিতে পারে নি চুল– এই দেখ্ হেথা পরায়ে দিয়াছে অলকে শুকানো ফুল। বেণী খুলে চুল বেঁধে দে আবার, কানে দে পরায়ে দুল। |
||
সুরুচি। | না লো সখি, দেখ্, আঁধার হতেছে, | |
দেরি
হয়ে যায় ঢের– চল্ ত্বরা করে যাই দেখিবারে ফুলশয্যা অনিলের। |
||
অলকা। | এত খনে, সখি, এসেছে সেথায় | |
যতেক গ্রামের লোক। | ||
দামিনী। [হাসিয়া] এসেছে বিনোদ! লীলা। [হাসিয়া] এসেছে প্রমোদ! বিনো। [হাসিয়া] এসেছে সেথা অশোক! মাধবী। [হাসিয়া] এসেছে বিজয়! চারু। [চিবুক ধরিয়া] সুরেশ রয়েছে |
||
পথ চেয়ে তোর তরে! | ||
অলকা। আয় তবে ত্বরা করে! নলিনী। ভালো, সখি, ভালো, চল্ তবে চল্— জ্বালাস্ নে আর মোরে! |