ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


ভগ্নহৃদয়
চতুর্থ সর্গ


                কবি
             প্রথম গান
     
    বিপাশার তীরে ভ্রমিবারে যাই,
প্রতিদিন প্রাতে দেখিবারে পাই
লতা-পাতা-ঘেরা জানালা-মাঝারে
       একটি মধুর মুখ।
চারি দিকে তার ফুটে আছে ফুল,
কেহ বা হেলিয়া পরশিছে চুল,
দুয়েকটি শাখা কপাল ছুঁইয়া,
দুয়েকটি আছে কপোলে নুইয়া,
কেহবা এলায়ে চেতনা হারায়ে
      চুমিয়া আছে চিবুক।
বসন্ত প্রভাতে লতার মাঝারে
      মুখানি মধুর অতি!
অধর দুটির শাসন টুটিয়া
রাশি রাশি হাসি পড়িছে ফুটিয়া,
দুটি আঁখি-'পরে মেলিছে মিশিছে
     তরল চপল জ্যোতি।

       দ্বিতীয় গান
প্রতিদিন যাই সেই পথ দিয়া,
      দেখি সেই মুখখানি

কুসুমমাঝারে রয়েছে ফুটিয়া
     কুসুমগুলির রাণী!
আপনা-আপনি উঠে আঁখি মোর
     সেই জানালার পানে,
আনমন হয়ে রহি দাঁড়াইয়া
     কিছুখন সেইখানে।
আর কিছু নহে, এ ভাব আমার
     কবির সৌন্দর্য্যতৃষা,
কলপনা-সুধা-বিভল কবির
     মনের মধুর নেশা!
গোলাপের রূপ, বকুলের বাস,
      পাপিয়ার বনগান,
সৌন্দর্য্যমদিরা দিবস রজনী
       করিয়া করিয়া পান
শিথিল হইয়া পড়েছে হৃদয়

       নয়নে লেগেছে ঘোর

বিকশিত রূপ বড়ো ভালো লাগে
       মুগ্ধ নয়নে মোর!
   
        তৃতীয় গান
প্রতিদিন দেখি তারে,    কেন না দেখিনু আজি?
আলিঙ্গিতে গ্রীবা তার    লতাগুলি চারি ধার
আছে শত বাহু তুলি    শত ফুলহারে সাজি।
দূর-বন হতে ছুটি    আসিয়া প্রভাতবায়
সে বয়ান না দেখিয়া    শূন্য বাতায়ন দিয়া
প্রবেশি আঁধার গৃহে    করিতেছে হায় হায়!
কত খন
কত খন  কত খন ভ্রমি একা,
গনিনু ফুলের দল,    মাটিতে কাটিনু রেখা।
কত খন
কত খন    গেল চলি কত খন
খনে খনে দেখি চাহি,   তবু না পাইনু দেখা!
ফিরিনু আলয়মুখে,    চলিনু আপন মনে,
চলিতে চলিতে ধীরে   ভুলে ভুলে ফিরে ফিরে
বার বার এসে পড়ি   সেই
সেই বাতায়নে!
নিরাশ-আশার মোহে চেয়ে দেখি বার বার,
শূন্য
শূন্য শূন্য সব    বাতায়ন অন্ধকার!
ফুলময় বাহু দিয়া   আঁধারকে বুকে নিয়া
আঁধারকে আলিঙ্গিয়া   রয়েছে সে লতাগুলি,
তবু ফিরি ফিরি সেথা   আসিলাম ভুলি ভুলি!
তেমনি সকলি আছে
   বাতায়ন ফুলে সাজি,
দুলিছে তেমনি করি    বাতাসে কুসুমরাজি!
শুধু এ মনে আমার   এক কথা বার বার
এক সুরে মাঝে মাঝে   উঠিতেছে বাজি বাজি

"প্রতিদিন দেখি তারে,   কেন না দেখিনু আজি?
কেন না দেখিনু তারে,    কেন না দেখিনু আজি?"
অতিধীর পদক্ষেপে    আলয়ে আসিনু ফিরি,
শতবার আনমনে    বলিলাম ধীরি ধীরি

"প্রতিদিন দেখি তারে,   কেন না দেখিনু আজি?

               চতুর্থ গান
কাল যবে দেখা হ'ল পথে যেতে যেতে চলি
মোরে হেরে আঁখি তার কেন গো পড়িল ঢলি?
অজানা পথিকে হেরি এত কি সরম হবে?
কি যেন গো কথা আছে,    আটকিয়া রহিয়াছে!
আধ—মুদা দুটি আঁখি    কি যেন রেখেছে ঢাকি,
খুলিলে আঁখির পাতা প্রকাশ তা হয় পাছে!
সরম না হয় যদি, এ ভাব কিসের তবে?
কাল তাই বোসে বোসে ভাবিয়াছি সারাক্ষণ,
স্বপনে দেখেছি তার ঢ'লে-পড়া দু-নয়ন!
প্রভাতে বসিয়া আজ ভাবিতেছি নিরিবিলি

"মোরে হেরে আঁখি তার কেন গো পড়িল ঢলি?"

               পঞ্চম গান
সত্য কি তাহারে ভালোবাসি?
ভুলিনু কি শুধু তার দেখে রূপরাশি?
স্বপনে জানি না তার হৃদয় কেমন,
সহসা আপনা ভুলে
শুধু কি রূপসী ব'লে
জীবন্তপুত্তলী-পদে বিসর্জিনু মন?

                 ষষ্ঠ গান
মোর এ যে ভালোবাসা রূপমোহ এ কি?
ভালো কি বেসেছি শুধু তার মুখ দেখি?
মুখেতে সৌন্দর্য্য তার হেরিনু যখনি
তখনি কি মন তার দেখিতে পাই নি?
মধুর মুখেতে তার আঁখি-দরপণে
মনচ্ছায়া হেরিয়াছি কল্পনানয়নে!
সেই যে মুখানি তার মধুর-আকার
বেড়াতেছে খেলাইয়া হৃদয়ে আমার!
কত কথা কহিতেছে হরষে বিভোর,
কত হাসি হাসিতেছে গলা ধরে মোর!
কি করিয়া হাসে আর কি ক’রে সে কয়,
কি ক’রে আদর করে ভালোবাসাময়,
মুখানি কেমন হয় মৃদু অভিমানে,
সকলি হৃদয় মোর না জানিয়া জানে!
যেন তারে জানি কত বর্ষ অগনন,
এ হৃদয়ে কিছু তার নহে গো নূতন!
মুখ দেখে শুধু ভালো বেসেছি কি তারে?
মন তার দেখি নি কি মুখের মাঝারে?

              সপ্তম গান
দু জনে মিলিয়া যদি ভ্রমি গো বিপাশা-পারে!
কবিতা আমার যত সুধীরে শুনাই তারে!
দোঁহে মিলি একপ্রাণ    গাহিতেছি এক গান,
দু জনের ভাবে ভাবে একেবারে গেছে মিশে,
দু জনে দু জন -পানে চেয়ে থাকি অনিমিষে,
দু জনের আঁখি হতে দু জনে মদিয়া পিয়া
আসিবে অবশ হয়ে দোঁহার বিভল হিয়া!
মুখে কথা ফুটিবে না,    আঁখিপাতা উঠিবে না,
আমার কাঁধের পরে নোয়াবে মাথাটি তার

দু জনে মিলিয়া যদি ভ্রমি গো বিপাশা-পার!

             অষ্টম গান
শুনেছি
শুনেছি কি নাম তাহার
     শুনেছি
শুনেছি তাহা!
নলিনী
নলিনী নলিনী নলিনী
     কেমন মধুর আহা!
নলিনী
নলিনী বাজিছে শ্রবণে
    বাজিছে প্রাণের গভীর ধাম!
কভু আনমনে উঠিতেছে মুখে
    নলিনী
নলিনী নলিনী নাম!
বালার খেলার সখীরা তাহারে
    নলিনী বলিয়া ডাকে,
স্বজনেরা তার নলিনী
নলিনী
    নলিনী বলে গো তাকে!
    নামেতে কি যায় আসে?
    রূপেতে কি যায় আসে?
হৃদয় হৃদয় দেখিবারে চায়
    যে যাহারে ভালোবাসে!
নলিনীর মত হৃদয় তাহার
    নলিনী যাহার নাম

কোমল
কোমল কোমল অতি
    যেমন কোমল নাম!
যেমন কোমল তেমনি বিমল,
    তেমনি সুরভধাম!
নলিনীর মত হৃদয় তাহার
    নলিনী যাহার নাম!