ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
কবি ও মুরলা | ||
কবি। | উন্মাদিনী কল্লোলিনী ক্ষুদ্র এক নির্ঝরিণী | |
শিলা হতে শিলান্তরে লুটিয়া লুটিয়া, নেচে, নেচে, অট্টহেসে, ফেনময় মুক্তকেশে প্রশান্ত হ্রদের কোলে পড়ে ঝাঁপাইয়া! শুধু মুহূর্তের তরে তিল বিচলিত করে সে প্রশান্ত সলিলের শুধু এক পাশ– উন্মত্ত কোলাহল অধীর তরঙ্গদল মুহূর্তের মাঝে সব পায় গো বিনাশ! দেখ, সখি, গৃহমাঝে দেখ গো চাহিয়া, নাচ, গান, বাদ্য, হাসি– আমোদ কল্লোলরাশি– নিশীথপ্রশান্তি-মাঝে পড়িছে ঝাঁপিয়া! আলোকে আলোকে গৃহ উঠেছে মাতিয়া, স্ফটিকে স্ফটিকে আলো নাচে বিদ্যুতিয়া, শত রমণীর পদ পড়ে তালে তালে। চরণের আভরণ নেচে নেচে প্রতিক্ষণ শত আলোকের বাণ হানে এককালে, মূর্ছিয়া পড়িছে আলো হীরকে হীরকে! শতকৃষ্ণ আঁখিতারা হানিছে আলোকধারা– শত হৃদে পড়ে গিয়া ঝলকে ঝলকে! চারি দিকে ছুটিতেছে আলোকের বাণ, চারি দিকে উঠিতেছে হাসি বাদ্য গান। কিন্তু হেথা চেয়ে দেখ কি শান্ত যামিনী! কি শুভ্র জোছনা ভায়! কি শান্ত বহিছে বায়! কেমন ঘুমন্ত আছে প্রশান্ত তটিনী! বলো, সখি, পূর্ণিমা কি আমাদের রাত? এস তবে দুই জনে বসি হেথা এক সনে, করি আপনার মনে রজনী প্রভাত! গান নীরব রজনী দেখ মগ্ন জোছনায়। ধীরে ধীরে অতিধিরে– অতিধীরে গাও গো! ঘুমঘোরময় গান বিভাবরী গায়, রজনীর কণ্ঠ-সাথে সুকণ্ঠ মিলাও গো! নিশীথের সুনীরব শিশিরের সম, নিশীথের সুনীরব সমীরের সম, নিশীথের সুনীরব জোছনা সমান অতি– অতি– অতিধীরে কর সখি গান! নিশার কুহক-বলে নীরবতাসিন্ধুতলে মগ্ন হয়ে ঘুমাইছে বিশ্ব চরাচর– প্রশান্ত সাগরে হেন তরঙ্গ না তুলে যেন অধীর-উচ্ছ্বাস-ময় সংগীতের স্বর! তটিনী কি শান্ত আছে! ঘুমাইয়া পড়িয়াছে বাতাসের মৃদুহস্ত-পরশে এমনি, ভুলে যদি ঘুমে ঘুমে তটের চরণ চুমে সে চুম্বনধ্বনি শুনে চমকে আপনি! তাই বলি অতি ধীরে– অতি ধীরে গাও গো, রজনীর কণ্ঠ-সাথে সুকণ্ঠ মিলাও গো! [মুরলার প্রতি] কেন লো মলিন, সখি, মুখানি তোমার? কাছে এস, মোর পাশে বোসো একবার! কেন, সখি, বল্ মোরে, যখনি দেখেছি তোরে মাটি-পানে নত দুটি বিষণ্ন নয়ান! আননের দুই পাশ অবদ্ধ কুন্তলরাশ– করুণ ও মুখখানি বড়ো, সখি, ম্লান! |
||
মুরলা। | সত্য ম্লান কি গো, কবি, এ মুখ আমার? | |
নিশীথবাতাস লাগি মনে কত উঠে জাগি নিস্তব্ধ জোছনারাতে ভাবনার ভার! |
||
[স্বগত] আহা কি করুণ, সখা, হৃদয় তোমার! | ||
কবি গো! বুক যে যায়–
ভেঙে যায়, ফেটে যায়– অশ্রুজল রুধিবারে পারিনাক আর! পারি নে– পারি নে সখা, পারি নে গো আর! ভেঙে বুঝি ফেলে তারা মর্ম্মকারাগার! একবার পায় ধরে কেঁদে নিই প্রাণ ভরে– একবার শুধু, কবি, শুধু একবার! যুঝিছে বুকের মাঝে শত অশ্রুধার! |
||
কবি। | একটি প্রাণের কথা রয়েছে গোপনে, | |
বলিব বলিব তোরে করিতেছি মনে! আজ জোছনার রাতে বিপাশার তীরে কাছে আয়, সে কথাটি বলি ধীরে ধীরে! |
||
মুরলা।
কি কথা সে? বলো কবি! করহ প্রকাশ! কবি। কে জানে উঠেছে হৃদে কিসের উচ্ছ্বাস! |
||
খেলিছে মর্ম্মের মাঝে অধীর উল্লাস! অথচ, উল্লাস সেই সুকুমার হেন, শিশিরের বাষ্প দিয়ে গঠিত সে যেন! হৃদয়ে উঠেছে যেন বন্যা জোছনার, মধুর অশান্তিময় হৃদয় আমার। সূক্ষ্ম আবরণ, গাঁথা সন্ধ্যামেঘস্তরে, পড়িয়াছে যেন মোর নয়নের ’পরে! কিছু যেন দেখেও দেখে না আঁখিদ্বয়, সকলি অস্ফুট, যেন সন্ধ্যাবর্ণময়! শোন্ বলি, মুরলা লো, আরো আয় কাছে– শূন্য এ হৃদয় মোর ভালো বাসিয়াছে! |
||
মুরলা।
ভালোবাসে? কারে কবি? কারে সখা? কারে? কবি। মধুর নলিনী-সম নলিনী বালারে! মুরলা। নলিনী? নলিনী সখা! নলিনী বালারে? কবি মোর! সখা মোর! ভালোবাস তারে? কবি। হাঁ মুরলা, সেই নলিনী বালারে, |
||
তারে তুমি জান না কি? এমন মধুর মুখভাব তায়? এমন মধুর আঁখি! এত রাশি রাশি খেলাইছে হাসি হৃদয়ের নিরালায়– নয়ন অধর ভাসাইয়া দিয়া উথলি পড়িয়া যায়! যে দিকে সে চায় হাসিময় চোখে হাসি উঠে চারি ধার, যে দিকে সে যায়– আঁধার মুছিয়া চলে জ্যোতি-ছায়া তার! তার সে-নয়ন-নিঝর হইতে হাসি সুধারাশি ঝরি, এই হৃদয়ের আকাশ পাতাল রেখেছে জোছনা করি! |
||
মুরলা। | [স্বগত] দেবি গো করুণাময়ী, | |
কোথা পাই ঠাঁই মা গো–
কোথা গিয়ে কাঁদি! দুর্বল এ মন দে মা পাষাণেতে বাঁধি! |
||
[প্রকাশ্যে] আহা, কবি, তাই হোক্– সুখে তুমি থাক। | ||
এ নব প্রণয়ে মন পূর্ণ করে রাখ! নয়নের জল তব কিছুতে মোছে নি, হৃদয়-অভাব তব কিছুতে ঘোচে নি– আজ, কবি, ভালোবেসে সুখী যদি হও শেষে, আজ যদি থামে তব নয়নের ধার, দেবতা গো, তাই করো! চিরজন্ম সুখী করো কবিরে আমার, বাল্য-সখারে আমার! |
||
কবি। | মুছ অশ্রুজল, সখি, কেঁদো না অমন– | |
যে হাসির কিরণেতে পূর্ণ হল মন একেলা বিজনে বসি কবিরে তোমার কাঁদিতে দেখিতে, সখি, হবেনাক আর! আজ হতে মিলাবে না হাসি এ অধরে, বিষণ্ন হবে না মুখ মুহূর্তের তরে। আয় সখি, আয় তবে, কাছে আয় মোর– মুছাইয়া দিই আহা অশ্রুজল তোর! |
||
মুরলা। | অশ্রু মুছায়ো না আর– বহুক যা বহিবার– | |
এখনি আপনা হতে থামিবে উচ্ছ্বাস! এ অশ্রু মুছাতে, কবি, কিসের প্রয়াস! ক্ষুদ্র হৃদয়ের কত ক্ষুদ্র সুখ দুখ আপনি সে জাগি উঠে– আপনি শুকায় ফুটে, চেয়েও দেখে না কেহ উঠুক-পড়ুক! এস সখা, ওই কাঁধে রাখি এই মুখ একে একে সব কথা কহ গো আমারে– বড়ো ভাল বাস কি সে নলিনী বালারে? |
||
কবি। | শুধু যদি বলি, সখি, ভালো বাসি তায় | |
এ মনের কথা যেন তাহে না ফুরায়। ভালোবাসা ভালোবাসা সবাই ত কয়, ভালোবাসা কথা যেন ছেলেখেলাময়! প্রতি কাজে প্রতি পলে সবাই যে কথা বলে তাহে যেন মোর প্রেম প্রকাশ না হয়! মনে হয় যেন, সখি, এত ভালোবাসা কেহ কারে বাসে নাই, কারো মনে আসে নাই– প্রকাশিতে নারে তাহা মানুষের ভাষা! |
||
মুরলা। | তাই হোক, ভালো তারে বাস প্রাণপণে! | |
তারে ছাড়া আর কিছু না থাকুক মনে! | ||
কবি। | সে আমার ভালোবাসা না যদি পূরায়! | |
যেই প্রেম-আশা লয়ে রয়েছি উন্মত্ত হয়ে, বিশ্ব দেখি হাস্যময় যাহার মায়ায়, যদি সখি, ফিরে নাহি পাই ভালোবাসা– ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে সেই প্রেম-আশা– মুমূর্ষু আশার সেই গুরু দেহভার সমস্ত জগৎ-ময় বহিয়া বেড়াতে হয়– শ্রান্ত হৃদি দিবানিশি করে হাহাকার! অসুস্থ আশার সেই মুমূর্ষু-নিশ্বাসে যদি এ হৃদয় হয় শূন্য মরুভূমিময়, হৃদয়ের সব বৃত্তি শুকাইয়া আসে– দিনরাত্রি মৃত ভার করিয়া বহন ম্রিয়মাণ হয়ে যদি পড়ে এই মন! |
||
মুরলা। | ও কথা বোলো না, কবি, ভেবো নাক আর– | |
নিশ্চয় হইবে পূর্ণ প্রণয় তোমার। কি-জানি-কি-ভাবময় ওই তব মুখ– ওই তব সুধাময়– প্রেমময়– স্নেহময়– সুকুমার– সুকোমল– করুণ ও মুখ– হাসি আর অশ্রুজলে মাখানো ও মুখ– রাখিতে প্রাণের কাছে এমন কে নারী আছে পেতে না দিবেক তার প্রেমময় বুক! শত ভাব উথলিছে ওই আঁখি দিয়া, শত চাঁদ ওই খানে আছে ঘুমাইয়া– মুছাইতে ও মধুর নয়নের ধার কোন্ নারী দিবেনাক আঁচল তাহার! মধুময় তব গান দিবারাত করি পান ঘুমাইয়া পড়িবে সে হৃদয়ে তোমার। বসি ওই পদমূলে মুগ্ধ আঁখিপাতা তুলে দিন রাত্রি চেয়ে রবে ওই মুখপানে সূর্য্যমুখী ফুল-সম অবাক নয়ানে! হেন ভাগ্যবতী নারী কে আছে ধরায় যেজন কবির প্রেম না চাহিয়া পায়! |
||
[স্বগত] মুরলা রে, কোন আশা পূরিল না তোর– | ||
কাঁদ্ তুই অভাগিনী এ জীবন-ভোর! এ জনমে তো অশ্রু মুছাবে না কেহ, এ জনমে ফুটিবে না তোর প্রেম স্নেহ! কেহ শুনিবে না আর তোর মর্ম্মব্যথা, ভালোবেসে তোর বুকে রাখিবে না মাথা! বড়ো যদি শ্রান্ত হয়ে পড়ে তোর মন কেহ নাহি কহিবারে আশ্বাসবচন! মাতৃহারা শিশু-মত কেঁদে কেঁদে অবিরত পথের ধুলার পরে পড়িবি ঘুমায়ে– একটি স্নেহের নেত্র দেখিবে না চেয়ে? |
||
[নলিনীর প্রবেশ] [দূর হইতে] কবি। পূর্ণিমারূপিণী বালা! কোথা যাও, কোথা যাও! |
||
একবার এই দিকে মুখানি তুলিয়া চাও! কি আনন্দ ঢেলেছ যে, কি তরঙ্গ তুলেছ যে আমার হৃদয়মাঝে একবার দেখে যাও! দিবানিশি চায়, বালা, অধীর ব্যাকুল মন ও হাসি-সমুদ্র-মাঝে করে আত্মবিসর্জন! হেরি ওই হাসিময় মধুময় মুখপানে উন্মত্ত অধীর হৃদি তিল দূর নাহি মানে– চায়, অতি কাছে গিয়া ওই হাত দুটি ধরি অচেতনে কাটাইয়া দেয় দিবা বিভাবরী! একটি চেতনা শুধু জাগি রবে অনিবার– সে চেতনা তুমি-ময়— ওই মিষ্ট হাসি-ময়– ওই সুধামুখ-ময়– কিছু– কিছু নহে আর! আমার এ লঘু-পাখা কল্পনার মেঘগুলি তোমার প্রতিমা, বালা, মাথায় লয়েছে তুলি– তোমার চরণ-জ্যোতি পড়িয়া সে মেঘ-’পরে শত শত ইন্দ্রধনু রচিয়াছে থরে থরে! তোমার প্রতিমা লয়ে কিরণে-কিরণে-ভরা উড়েছে কল্পনা, কোথা ফেলিয়ে রেখেছে ধরা! হরিত-আসন-’পরে নন্দনবনের কাছে ফুলবাস পান করি বসন্ত ঘুমায়ে আছে, ঘুমন্ত সে বসন্তের কুসুমিত কোল-’পরে তোমারে কল্পনারাণী বসায়েছে সমাদরে– চারি দিকে জুঁইফুল চারি দিকে বেলফুল– ঘিরে ঘিরে রহিয়াছে অজস্র কুসুমকুল, শাখা হতে নুয়ে প’ড়ে পরশিয়া এলো চুল শতেক মালতীকলি হেসে হেসে ঢলাঢলি, কপালে মারিছে উঁকি কপোলে পড়িছে ঝুঁকি ওই মুখ দেখিবারে কৌতুহলে সমাকুল, অজস্র গোলাপ-রাশি পড়িয়া চরণতলে না জানি কি মনোদুখে আকুল শিশিরজলে! তোমার প্রতিমা লয়ে কল্পনা এমনি করি খেলাইয়া বেড়াইছে, নাহি দিবা বিভাবরী– কভু বা তারার মাঝে কভু বা ফুলের ’পরে কভু বা উষার কোলে কভু সন্ধ্যামেঘস্তরে; কত ভাবে দেখিতেছে, কত ছবি আঁকিতেছে– প্রফুল্ল-আনন কভু হরষের হাসি-মাখা, অভিমান-নত আঁখি কভু অশ্রুজলে ঢাকা। কাছে এস, কাছে এস, একবার মুখ দেখি– তোল গো, নলিনীবালা, হাসিভারে নত আঁখি! মর্মভেদী আশা এক লুকানো হৃদয়তলে, ওই হাতে হাত দিয়ে প্রাণে প্রাণে মিশাইয়ে বসন্তের বায়ু সেবি কুসুমের পরিমলে নীরব জোছনা রাতে বিপাশাতটিনীতীরে ফুলপথ মাড়াইয়া দোঁহে বেড়াইব ধীরে! আকাশে হাসিবে চাঁদ, নয়নে লাগিবে ঘোর, ঘুমময় জাগরণে করিব রজনী ভোর! আহা সে কি হয় সুখ! কল্পনায় ভাবি মনে বিহ্বল আঁখির পাতা মুদে আসে দু-নয়নে! |
||
মুরলা। | [স্বগত] হৃদয় রে! | |
এ সংসারে আর কেন রয়েছি আমরা? তুচ্ছ হতে তুচ্ছ আমাদেরো তরে আজ তিলমাত্র স্থান কি রে রাখিয়াছে ধরা! এখনো কি আমাদের ফুরায় নি কাজ? হৃদয় রে! হৃদয় রে! ওরে দগ্ধ মন! আমাদের তরে ধরা হয় নি সৃজন! |
||
কবি। | মুরলা লো! চেয়ে দেখ্– চেয়ে দেখ্ হোথা! | |
বল্ দেখি এত হাসি এত মিষ্ট সুধারাশি হেন মুখ হেন আঁখি দেখেছিস্ কোথা? |
||
মুরলা। | এমন সুন্দরী আহা কভু দেখি নাই– | |
কবির প্রেমের যোগ্য আর কিবা চাই! কবিতার উৎস-সম ও নয়ন হতে ঝরিবে কবিতা তব হৃদে শত-স্রোতে! হাসিময় সৌন্দর্য্যের কিরণ-পরশে বিহঙ্গম-হৃদি তব গাহিবে হরষে– মধুর সঙ্গীতে বিশ্ব করিবে প্লাবন! সুখে থাকো পূর্ণ মনে, ভালোবাসো প্রাণপণে প্রেমযোগ্য নারী যবে পেয়েছ এমন! |
||
[স্বগত] কেন এত অশ্রু আজি করি বরিষণ? | ||
কেন রে কিসের দুখ? কেন এত ফাটে বুক? কিসের যন্ত্রণা মর্ম করিছে দংশন? কখনো তো কবির অমূল্য ভালোবাসা অভাগিনী মনে মনে করি নাই আশা! জানিতাম চিরদিন রূপহীন গুণহীন তুচ্ছ মুরলার এই ক্ষুদ্র ভালোবাসা পুরাতে নারিবে তাঁর প্রণয়পিপাসা– মোরে ভালোবেসে কবি সুখী হইবে না! তবু আজ কিসের গো, কিসের যাতনা! আজ কবি মুছেছেন অশ্রুবারিধার, বহুদিনকার আশা পূরেছে তাঁহার! আহা কবি, সুখে থাকো, আর কিছু চাই নাকো– এই মুছিলাম অশ্রু, আর কাঁদিব না! কিসের যাতনা মোর, কিসের ভাবনা |
||
কবি। | ওই দেখ্ ফুল তুলে আঁচলটি ভরি | |
কামিনীর শাখা লয়ে ওই দেখ্ ভয়ে ভয়ে অতি যত্নে রাখিয়াছে নোয়াইয়া ধরি, পাছে কুসুমের দল ভূঁয়ে পড়ে ঝরি! ওই দেখ্ উচ্চ শাখে ফুটিয়াছে ফুল, তুলিবার তরে আহা কতই আকুল! কিছুতে তুলিতে নারে কত চেষ্টা করি– শাখাটি ধরিয়া শেষে নাড়িছে মধুর রোষে, কুসুম শতধা হয়ে পড়িতেছে ঝরি। বিফল হইয়া শেষে সখীদের কোলে ওই দেখ্ হেসে হেসে পড়িতেছে ঢলে! |
||
মুরলা। | [স্বগত] | |
আমি যদি হইতাম হাস্যোল্লাসময় নির্ঝরিণী, বরষার নবোচ্ছ্বাসময়! হরষেতে হেসে হেসে কবির কাছেতে এসে ডুবাতেম ভালোবেসে আদরে আদরে! যদি কভু দেখিতাম মুহূর্তের তরে বিষাদ ছাইছে পাখা কবির অধরে, হাসিয়া কত-না হাসি ঢালিয়া সংগীতরাশি মৃদু অভিমান করি’ মৃদু রোষভরে– মৃদু হেসে মৃদু কেঁদে বাহুতে বাহুতে বেঁধে দিতেম বিষাদভার সব দূর করে! কিন্তু আমি অভাগিনী ছেলেবেলা হতে এ গম্ভীর মুখে মম অন্ধকার ছায়া-সম রহিয়াছি সতত কবির সাথে সাথে! আমি লতা গুরুভার মেলি শাখা অন্ধকার হেন ঘন আলিঙ্গনে করেছি বেষ্টন, উন্নত মাথায় তাঁর পড়িতে দিই না আর চাঁদের হাসির আলো, রবির কিরণ! হা মুরলা, মুরলা রে, এমনি করেই হা রে হারালি– হারালি বুঝি ভালোবাসা-ধন! বুক, ফেটে যা রে, অশ্রু কর্ বরিষণ– কবি তোর অশ্রুধার দেখিতে পাবে না আর, যে কিরণে আছে ডুবি তাঁহার নয়ন! দুর্বল– দুর্বল হৃদি! আবার! আবার! আবার ফেলিস্ তুই অশ্রুবারিধার? আবার আবার কেন হৃদয়দুয়ারে হেন পাষাণে পাষাণে গাঁথা কে যেন হানিছে মাথা, কে যেন উন্মাদ-সম করে হাহাকার– সমস্ত হৃদয়ময় ছুটিয়া আমার! থাম্ থাম্, থাম্ হৃদি, মোছ্ অশ্রুধার! কবি যদি সুখী হয় কি ভাবনা আর! আহা কবি, সুখী হও! তুমি কবি সুখী হও! আমি কে সামান্য নারী?– কি দুঃখ আমার! তুমি যদি সুখী হও কি দুঃখ আমার! ও চাঁদের কলঙ্কও হতে নাহি পারি এত ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্র তুচ্ছ আমি নারী! [চপলার প্রবেশ ও গান] সখি, ভাবনা কাহারে বলে? সখি, যাতনা কাহারে বলে? তোমরা যে বলো দিবস রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা, সখি, ভালাবাসা কারে কয়? সে কি কেবলি যাতনাময়? তাহে কেবলি চোখের জল? তাহে কেবলি দুখের শ্বাস? লোকে তবে করে কি সুখের তরে এমন দুখের আশ? জীবনের খেলা খেলিছে বিধাতা, আমরা তাহার খেলেনা– আমাদের কিবা সুখ! সখি, আমাদের কিবা দুখ! সখি, আমাদের কিবা যাতনা! তোমাদের চোখে হেরিলে সলিল ব্যথা বড়ো বাজে বুকে– তবু তো, সজনি, বুঝিতে পারি নে কাঁদ যে কিসের দুখে। আমার চোখেতে সকলি শোভন– সকলি নবীন– সকলি বিমল– সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন, বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল, সকলি আমারি মত! কেবলি হাসে, কেবলি গায়, হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়, না জানে বেদন, না জানে রোদন, না জানে সাধের যাতনা যত! ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে, জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়, হাসিতে হাসিতে আলোকসাগরে আকাশের তারা তেয়াগে কায়! আমার মতন সুখী কে আছে! আয় সখি, আয় আমার কাছে! সুখী হৃদয়ের সুখের গান শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ! প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা, একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা! মুরলার প্রতি এই যে আমার সখীর অধরে ফুটেছে মৃদুল হাসি! আয়, সখি, মোরা দুজনে মিলিয়া ললিতারে দেখে আসি। মালতী সেথায়, মাধবী সেথায়, সখীরা এসেছে সবে, এতখনে সেথা ফাটিছে আকাশ কমলার হাসিরবে। |
||
মুরলা। | চল্ সখি, চল্ তবে। |