ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
অনিল ললিতা | ||
অনিল। | [গাহিতে গাহিতে] | |
কাছে তার যাই যদি কত
যেন পায় নিধি, তবু হরষের হাসি ফুটে ফুটে ফুটে না! কখনো বা মৃদু হেসে আদর করিতে এসে সহসা সরমে বাধে, মন উঠে উঠে না! রোষের ছলনা করি দূরে যাই, চাই ফিরি, চরণ বারণ তরে উঠে উঠে উঠে না। কাতর নিশ্বাস ফেলি, আকুল নয়ন মেলি চাহি থাকে, লাজ-বাঁধ তবু টুটে টুটে না! যখন ঘুমায়ে থাকি মুখপানে মেলি আঁখি চাহি থাকে, দেখি দেখি সাধ যেন মিটে না! সহসা উঠিলে জাগি, তখন কিসের লাগি সরমেতে ম’রে গিয়ে কথা যেন ফুটে না! লাজময়ি! তোর চেয়ে দেখি নি লাজুক মেয়ে, প্রেমবরিষার স্রোতে লাজ তবু টুটে না! |
||
ললিতা। | [স্বগত] | |
পাষাণে বাঁধিয়া মন
আজ করেছিনু পণ কাছে যাব– কথা কব– যাচিব আদর আজ! ওরে, মন, ওরে মন, কার কাছে তোর লাজ? আপনা র চেয়ে যারে করেছিস্ আপনার তার কাছে বল্ দেখি কিসের সরম আর? |
||
অনিল। | ফুল তুলিবার ছলে ওই যে ললিতা আসে, | |
মনে মনে জানা আছে এলেই আমার কাছে অমনি হাতটি ধরি বসাব আমার পাশে। অন্য দিকে -পানে আমি চাহিয়া রহিব আজ, দেখিব কেমন করি কোথা তার থাকে লাজ? |
||
ললিতা। | [ফুল তুলিতে তুলিতে] | |
নাহয় বসিনু কাছে কি
তাহাতে দোষ আছে? বসিব নাথের পাশে তাহাতে কি আসে যায়? আর, লজ্জা– লজ্জা নয়– লজ্জারে করিব জয়– নাহয় বসিনু কাছে, কিসের সরম তায়! কোথা লজ্জা– লজ্জা কোথা? এই তো বসিনু হেথা– এই তো করিনু জয়, এই ত বসিনু কাছে– বসিব নাথের পাশে কি তাহাতে দোষ আছে? এখনো– এখনো মোরে দেখিতে পান নি তবে– তবে কি গো আরো কাছে– আরো কাছে যেতে হবে? আর নয়– আরো কাছে যাইব কেমন করে? হেথা তবে বসে থাকি, মালাগুলি গেঁথে রাখি, এখনি ভাবনা ভাঙি দেখিতে পাইবে মোরে! যদিবা দেখিতে পায় কি তবে করিবে মনে? যদি গো বুঝিতে পারে দেখিতে এসেছি তারে, মিছে মালা-গাঁথা ছলে বসে আছি এইখানে? |
||
অনিল। | এই যে ললিতা হোথা– ফুরালো কি মালা গাঁথা? | |
আরেকটু কাছে এসে নাহয় গাঁথিতে মালা! এই হেথা কাছে আয়– কিসের সরম তায়? কেমন গাঁথিলি ফুল একবার দেখি বালা! আদরিণী– আদরিণী– দেখি হাতখানি তোর! এমনি করিয়া সখি, বাঁধ্ লো হৃদয় মোর! একবার দেখি সখি, কাছে আন্ মুখখানি– এমনি করিয়া রাখ্ বুকের মাঝারে আনি! কেন, লাজ এত কেন– আঁখি দুটি নত কেন? কি করেছি? একটি শুধু চুম্বন বইত নয়! আরেকটি এই লও– অরেকটি এই লও– আর নয় করিব না বড়ো যদি লাজ হয়! নাহয় কুন্তল দিয়ে ঢেকে দিই মুখখানি! দেখিতে আনন তোর ওই চন্দ্র ভাবে-ভোর এক দৃষ্টে চেয়ে, সখি, রয়েছে অবাক্ মানি! ওই দেখ্ তারাগুলি সহস্র নয়ন খুলি ওই মুখটির তরে খুঁজিছে সমস্ত ধরা– উচিত কি হয়, সখি, তাদের নিরাশ করা– নয়নে নয়ন রাখি একবার মেল আঁখি, মিশাও কপোলে মোর ললিত কপোল তব! কথা কও কানে,কানে, মৃদু প্রণয়ের গানে জাগাও ঘুমন্ত হৃদে সুখস্বপ্ন নব নব! মনে আছে সেই রাত্রে কত সাধনার পরে একটি সংগীত, সখি, গিয়াছিলে গাহিবারে– আরম্ভ করেই সবে অমনি থামালে গীত, নিজের কণ্ঠের স্বরে নিজে হয়ে সচকিত! সেই আরম্ভের কথা এখনো রয়েছে কানে, সেই আরম্ভের সুর এখনো বাজিছে প্রাণে! সে আরম্ভ শেষ, বালা, আজিকে করিতে চাই! বড়ো কি হতেছে লাজ? ভালো, সখি, কাজ নাই! |
||
ললিতা। | [স্বগত] কি কহিব? বড়ো, সখা, মনে মনে পাই ব্যথা, | |
না জানি গাহিতে গান, না জানি কহিতে
কথা! কত আজ বেছে বেছে তুলেছি কুসুমভার, কতখন হতে আজ ভেবেছি ভুলিয়া লাজ নিশ্চয় এ ফুলগুলি দিব তারে উপহার! হাতটি এগিয়ে আজ গিয়েছিনু কতবার, অমনি পিছায়ে হাত লইয়াছি শতবার! সহস্র হউক লাজ, এ কুসুমগুলি আজ নিশ্চয় দিব গো তাঁরে না হবে অন্যথা তার! কিন্তু কি বলিয়া দিব? কি কথা বলিতে হবে? বলিব কি– "ফুলগুলি যতনে এনেছি তুলি, যদি গো গলায় পর’ মালা গেঁথে দিই তবে" ? ছি ছি গো বলি কি করে– সরমে যে যাব মরে– নাইবা বলিনু কিছু, শধু দিই উপহার! দিই তবে? দিই তবে? দিই তবে এইবার? দূর হোক্ কি করিব? বড়ো যে গো লজ্জা করে! থাক্ গো এখন থাক্– দিব আরেকটু পরে! অনিল। কি হয়েছে? দিতে কি লো চাস্ ফুল-উপহার? দে-না লো গলায় গেঁথে, কিসের সরম তার? একটি দাও তো সখি, পরাই তোমার চুলে। আর দুটি দাও সখি, পরাইব কর্ণমূলে। মোরে দাও সবগুলি– গাঁথিব ফুলের বালা, গলায় দুলায়ে দিব গাঁথিয়া চাঁপার মালা, আসন রচিয়া দিব দিয়ে শত শতদল! তা হলে কি দিবি মোরে– বল্ সখি বল্ বল্– যতগুলি ফুল গাঁথি যত তার দল আছে ততেক চুম্বন আমি লইব তোমার কাছে! যত দিন না পারিবি শুধিতে চুম্বন-ধার এ ভুজে রহিবি বদ্ধ এই বক্ষকারাগার! দিবানিশি সজনি লো রেখে দেব চোখে চোখে! বল্ তবে ফুলসাজে সাজায়ে দেব কি তোকে? বলিবি না? ভালো, সখি, দুইটি চুম্বন দাও– নাহয় একটি দিও, মহার্ঘ হল কি তাও? |
||
ললিতা। [স্বগত] | ||
আরেকটি বার, সখা, কর গো চুম্বন মোরে– আরেকটি বার, সখা, রাখ গো বুকেতে ধরে! জান আমি মুখ ফুটে সরমে বলিতে নারি, তাই কি সহিতে হবে? এত শান্তি, সখা, তারি? আদরে হৃদয়ে যদি রাখ এ মাথাটি মোর, আদরে চুম গো যদি আঁখির পাতাটি মোর, তাহাতে আমার, সখা, অসাধ কি হতে পারে? তবে কেন ব্যথা দিতে শুধাইছ বারে বারে? আকুল ব্যাকুল হৃদি মিলিবারে তব পাশে শতবার ধায়, সখা, শতবার ফিরে আসে! দীন আপনারে, হেরে এমন সে লাজ পায় তোমার কাছেতে, সখা, সঙ্কোচে না যেতে চায়! সখা, তারে ডেকে নাও– তুমি তারে ডেকে নাও– তোমারি সে মুখ চেয়ে দাঁড়াইয়া একধার, একটু আদর পেলে স্বর্গ হাতে পাবে তার! অনিল। ডুবিছে চতুর্থী চাঁদ বিপাশার নীরে। আয় সখি, আয় মোরা ঘরে যাই ফিরে। আঁধারে কাননপথ দেখা নাহি যায়, আয় তবে আরো কাছে– আরো কাছে আয়। হাতখানি রাখ্ মোর হাতের উপর, শ্রান্ত যদি হোস্ মোর কাঁধে দিস্ ভর। দেখিস্, বাধে না যেন চরণ লতায়– আঁচল না ছিঁড়ে যায় গাছের কাঁটায়! চমকি উঠিলি কেন? কিছু নাই ভয়– বাতাসের শব্দ শুধু, আর কিছু নয়! এই দিকে পথ, বালা, এই দিকে আয়– বাম পাশে বিপাশার স্রোত বহে যায়। শ্রান্তি কি হতেছে বোধ? লজ্জা কেন প্রিয়ে? বেষ্টন কর না মোর স্কন্ধ বাহু দিয়ে! কিসের তরাস এত– ও কি বালা, ও কি? ঝরিয়া পড়েছে শুধু শুষ্ক পত্র সখি! ওই গেল গেল চাঁদ, ওই ডোবে ডোবে– একটু জোছনারেখা এখনো যেতেছে দেখা, আর নাই– আর নাই– ওই গেল ডুবে! |