দেবদাস
(১৯১৭)
শরৎচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়
প্রথম
পরিচ্ছেদ
|
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ |
তৃতীয় পরিচ্ছেদ |
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
|
পঞ্চম
পরিচ্ছেদ
|
ষষ্ঠ
পরিচ্ছেদ
|
সপ্তম
পরিচ্ছেদ
| অষ্টম
পরিচ্ছেদ
| নবম পরিচ্ছেদ
|
দশম
পরিচ্ছেদ
|
একাদশ
পরিচ্ছেদ
|
দ্বাদশ
পরিচ্ছেদ
|
ত্রয়োদশ
পরিচ্ছেদ
|
চতুর্দশ
পরিচ্ছেদ
|
পঞ্চদশ
পরিচ্ছেদ
|
ষোড়শ
পরিচ্ছেদ
তাহার পর দুই-তিনদিন দেবদাস মিছিমিছি পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইল—
অনেকটা পাগলের মত।
ধর্মদাস কি কহিতে গিয়াছিল, তাহাকে চক্ষু রাঙ্গাইয়া ধমকাইয়া উঠিল। গতিক দেখিয়া
চুনিলালও কথা কহিতে সাহস করিল না। ধর্মদাস কাঁদিয়া বলিল, চুনিবাবু, কেন এমন হল?
চুনিলাল বলিল, কি হয়েচে ধর্মদাস?
একজন
অন্ধ আর-একজন অন্ধকে পথের কথা জিজ্ঞাসা করিল। ভিতরের খবর দু'জনের কেহই জানে না। চোখ
মুছিতে মুছিতে ধর্মদাস বলিল, চুনিবাবু, যেমন করে হোক দেব্তাকে তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে
দিন। আর লেখাপড়া যদি করবে না, ত এখানে থেকে কি হবে?
কথাটা খুব সত্য। চুনিলাল চিন্তা করিতে লাগিল। চারি-পাঁচদিন পরে একদিন ঠিক তেমনি
সন্ধ্যার সময় চুনিবাবু বাহির হইতেছিল— দেবদাস কোথা হইতে আসিয়া হাত ধরিল, চুনিবাবু,
সেখানে যাচ্চ?
চুনিলাল কুণ্ঠিত হইয়া বলিতে গেল, হাঁ— না, বল ত আর যাইনে।
দেবদাস কহিল, না, যেতে বারণ করচি নে; কিন্তু একটি কথা বল, কি আশায় সেখানে তুমি যাও?
আশা
আর কি? এমনি সময় কাটে।
কাটে? কৈ, আমার সময় ত কাটে না! আমি সময় কাটাতে চাই।
চুনিলাল কিছুক্ষণ তাহার মুখপানে চাহিয়া রহিল, বোধ করি তাহার মনের ভাব মুখে পড়িতে
চেষ্টা করিল। তাহার পর কহিল, দেবদাস, তোমার কি হয়েচে খুলে বলতে পারো?
কিছুই ত হয়নি।
বলবে
না?
না চুনি, বলবার কিছুই নেই।
চুনিলাল বহুক্ষণ অধোমুখে থাকিয়া কহিল, দেবদাস, একটা কথা রাখবে?
কি?
সেখানে আর একবার তোমাকে যেতে হবে। আমি কথা দিয়েচি।
যেখানে সেদিন গিয়েছিলাম—সেইখানে ত?
হাঁ—
ছিঃ—আমার ভাল লাগে না।
যাতে
ভাল লাগে, আমি করে দেব।
দেবদাস অন্যমনস্কের মত কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আচ্ছা, চল যাই।
অবনতির এক সোপান নীচে নামাইয়া দিয়া চুনিলাল কোথায় সরিয়া গিয়াছে। একা দেবদাস
চন্দ্রমুখীর ঘরে নীচে বসিয়া মদ খাইতেছে— অদূরে বসিয়া
চন্দ্রমুখী বিষন্নমুখে চাহিয়া চাহিয়া সভয়ে বলিয়া উঠিল— দেবদাস, আর খেয়ো না।
দেবদাস মদের গ্লাস নীচে রাখিয়া ভ্রূকুটি করিল, কেন?
অল্পদিন মদ ধরেচ, অত সইতে পারবে না।
সহ্য
করব বলে মদ খাইনে। এখানে থাকব বলে শুধু মদ খাই।
এ
কথা চন্দ্রমুখী অনেকবার শুনিয়াছে। এক-একবার তাহার মনে হয় দেয়ালে মাথা ঠুকিয়া সে
রক্তগঙ্গা হইয়া মরে। দেবদাসকে সে ভালবাসিয়াছে। দেবদাস মদের গ্লাস ছুঁড়িয়া
ফেলিল। কৌচের পায়ায় লাগিয়া সেটা চূর্ণ হইয়া গেল। তখন আড় হইয়া বালিশে হেলান দিয়া
জড়াইয়া জড়াইয়া কহিল, আমার উঠে যাবার ক্ষমতা নেই, তাই এখানে বসে থাকি—
জ্ঞান থাকে না, তাই
তোমার মুখের পানে চেয়ে কথা কই— চন্দ—র—তবু অজ্ঞান হইনে—
তবু একটু জ্ঞান থাকে—
তোমাকে ছুঁতে পারিনে— আমার বড় ঘৃণা হয়।
চন্দ্রমুখী চক্ষু মুছিয়া ধীরে ধীরে কহিতে লাগিল, দেবদাস, কত লোক এখানে আসে, তারা
কখনো মদ স্পর্শও করে না।
দেবদাস চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া উঠিয়া বসিল। টলিয়া টলিয়া ইতস্ততঃ হস্ত নিক্ষেপ করিয়া বলিল,— স্পর্শ করে না? আমার বন্দুক থাকলে তাদের গুলি করতাম। তারা যে আমার চেয়েও পাপিষ্ঠ— চন্দ্রমুখী!
কিছুক্ষণ থামিয়া কি যেন ভাবিতে লাগিল; তাহার পর আবার কহিল, যদি কখনও মদ ছাড়ি—যদিও ছাড়ব না—তা হলে আর কখন ত এখানে আসব না। আমার উপায় আছে, কিন্তু তাদের কি হবে?
একটুখানি থামিয়া বলিতে লাগিল, বড় দুঃখে মদ ধরেচি— আমাদের বিপদের, দুঃখের বন্ধু! আর তোমাকে ছাড়তে পারিনে,—
দেবদাস বালিশের উপর মুখ রগড়াইতে লাগিল। চন্দ্রমুখী তাড়াতাড়ি কাছে আসিয়া মুখ তুলিয়া ধরিল। দেবদাস ভ্রূকুটি করিল— ছিঃ, ছুঁয়ো না— এখনো আমার জ্ঞান আছে। চন্দ্রমুখী, তুমি ত জান না— আমি শুধু জানি আমি কত যে তোমাদের ঘৃণা করি। চিরকাল ঘৃণা করব— তবু আসব, তবু বসব, তবু কথা কব— নাহলে যে উপায় নেই। তা কি তোমরা কেউ বুঝবে? হাঃ—হাঃ— লোকে পাপ কাজ আঁধারে করে, আর আমি এখানে মাতাল হই— এমন উপযুক্ত স্থান জগতে কি আর আছে! আর তোমরা—
দেবদাস দৃষ্টি সংযত করিয়া কিছুক্ষণ তাহার বিষণ্ণ মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আহা! সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি! লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অপমান, অত্যাচার, উপদ্রব—স্ত্রীলোকে যে কত সইতে পারে— তোমরাই তার দৃষ্টান্ত।
তাহার পর চিত হইয়া শুইয়া পড়িয়া, চুপি চুপি কহিতে লাগিল— চন্দ্রমুখী বলে, সে আমাকে ভালবাসে— আমি তা চাইনে—চাইনে—চাইনে— লোকে থিয়েটার করে, মুখে চুনকালী মাখে— চোর হয়— ভিক্ষা করে— রাজা হয়— রানী হয়— ভালবাসে— কত ভালবাসার কথা বলে— কত কাঁদে—ঠিক যেন সব সত্য! চন্দ্রমুখী আমার থিয়েটার করে, আমি দেখি! কিন্তু তাকে যে মনে পড়ে—একদণ্ডে কি যেন সব হয়ে গেল। কোথায় সে চলে গেল—আর কোন্ পথে আমি চলে গেলাম। এখন একটা সমস্ত জীবনব্যাপী মস্ত অভিনয় আরম্ভ হয়েছে। একটা ঘোর মাতাল—আর এই একটা—হোক, তাই হোক—মন্দ কি! আশা নেই, ভরসা নেই—সুখও নেই, সাধও নেই—বাঃ বহুৎ আচ্ছা—
তাহার পর দেবদাস পাশ ফিরিয়া বিড়বিড় করিয়া কি বলিতে লাগিল।
চন্দ্রমুখী তাহা বুঝিতে পারিল না। অল্পক্ষণেই দেবদাস ঘুমাইয়া পড়িল। চন্দ্রমুখী তখন কাছে আসিয়া বসিল। অঞ্চল ভিজাইয়া মুখ মুছাইয়া দিয়া, সিক্ত বালিশ বদলাইয়া দিল। একটা পাখা লইয়া কিছুক্ষণ বাতাস করিয়া, বহুক্ষণ অধোবদনে বসিয়া রহিল। রাত্রি তখন প্রায় একটা। দীপ নিভাইয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া অন্য কক্ষে চলিয়া গেল।