দেবদাস
(১৯১৭)
শরৎচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়
প্রথম
পরিচ্ছেদ
|
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ |
তৃতীয় পরিচ্ছেদ |
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
|
পঞ্চম
পরিচ্ছেদ
|
ষষ্ঠ
পরিচ্ছেদ
|
সপ্তম
পরিচ্ছেদ
| অষ্টম
পরিচ্ছেদ
| নবম পরিচ্ছেদ
|
দশম
পরিচ্ছেদ
|
একাদশ
পরিচ্ছেদ
|
দ্বাদশ
পরিচ্ছেদ
|
ত্রয়োদশ
পরিচ্ছেদ
|
চতুর্দশ
পরিচ্ছেদ
|
পঞ্চদশ
পরিচ্ছেদ
|
ষোড়শ
পরিচ্ছেদ
রাত্রি বোধ হয় একটা বাজিয়া গিয়াছে। তখনও ম্লান জ্যোৎস্না আকাশের গায়ে লাগিয়া আছে। পার্বতী বিছানার চাদরে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়া ধীরপদবিক্ষেপে সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া আসিল। চারিদিকে চাহিয়া দেখিল,—কেহ জাগিয়া নাই। তাহার পর দ্বার খুলিয়া নিঃশব্দে পথে আসিয়া উপস্থিত হইল। পাড়াগ্রামের পথ, একেবারে স্তব্ধ, একেবারে নির্জন— কাহারও সাক্ষাতের আশঙ্কা ছিল না। সে বিনা বাধায় জমিদারবাড়ির সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। দেউড়ির উপর বৃদ্ধ দরোয়ান কিষণ সিংহ খাটিয়া বিছাইয়া তখনও তুলসীদাসী রামায়ণ পড়িতেছিল; পার্বতীকে প্রবেশ করিতে দেখিয়া চোখ না তুলিয়াই কহিল, কে?
পার্বতী বলিল, আমি।
দ্বারবানজী কণ্ঠস্বরে বুঝিল স্ত্রীলোক। দাসী মনে করিয়া, সে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না
করিয়া, সুর করিয়া রামায়ণ পড়িতে লাগিল। পার্বতী চলিয়া গেল। গ্রীষ্মকাল; বাহিরে
উঠানের উপর কয়েকজন ভৃত্য শয়ন করিয়া ছিল; তাহাদের মধ্যে কেহ-বা নিদ্রিত, কেহ-বা
অর্ধ-জাগরিত। তন্দ্রার ঘোরে কেহ-বা পার্বতীকে দেখিতে পাইল, কিন্তু দাসী ভাবিয়া কথা
কহিল না। পার্বতী নির্বিঘ্নে ভিতরে প্রবেশ করিয়া সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া গেল। এ
বাটীর প্রতি কক্ষ, প্রতি গবাক্ষ তাহার পরিচিত। দেবদাসের ঘর চিনিয়া লইতে তাহার বিলম্ব
হইল না। কপাট খোলা ছিল এবং ভিতরে প্রদীপ জ্বলিতেছিল। পার্বতী ভিতরে আসিয়া দেখিল,
দেবদাস শয্যায় নিদ্রিত। শিয়রের কাছে কি একখানা বই তখনও খোলা পড়িয়াছিল,
—ভাবে বোধ
হইল, সে এইমাত্র যেন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। দীপ উজ্জ্বল করিয়া দিয়া সে দেবদাসের পায়ের
কাছে আসিয়া নিঃশব্দে উপবেশন করিল। দেয়ালের গায়ে বড় ঘড়িটা শুধু টক্টক্ শব্দ
করিতেছে, ইহা ভিন্ন সমস্ত নিস্তব্ধ, সমস্ত সুপ্ত।
পায়ের উপর হাত রাখিয়া পার্বতী ধীরে ধীরে ডাকিল, দেবদা!—
দেবদাস ঘুমের ঘোরে শুনিতে পাইল, কে যেন ডাকিতেছে। চোখ না চাহিয়া সাড়া দিল, উঁ—
ও দেবদা—
এবার
দেবদাস চোখ রগড়াইয়া উঠিয়া বসিল। পার্বতীর মুখে আবরণ নাই, ঘরে দীপও উজ্জ্বলভাবে
জ্বলিতেছে; সহজেই দেবদাস চিনিতে পারিল। কিন্তু প্রথমে যেন বিশ্বাস হইল না। তাহার পর
কহিল, এ কি! পারু নাকি?
হাঁ,
আমি।
দেবদাস ঘড়ির পানে চাহিয়া দেখিল। বিস্ময়ের উপর আরও বিস্ময় বাড়িল— কহিল, এত রাত্রে?
পার্বতী উত্তর দিল না, মুখ নীচু করিয়া বসিয়া রহিল।
দেবদাস পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, এত রাত্রে কি একলা এসেচ নাকি?
পার্বতী বলিল, হাঁ।
দেবদাস উদ্বেগে, আশঙ্কায় কণ্টকিত হইয়া কহিল, বল কি! পথে ভয় করেনি?
পার্বতী মৃদু হাসিয়া কহিল, ভূতের ভয় আমার তেমন করে না।
ভূতের ভয় না করুক, কিন্তু মানুষের ভয় ত করে! কেন এসেচ?
পার্বতী জবাব দিল না, কিন্তু মনে মনে কহিল, এ সময়ে আমার তাও বুঝি নেই।
বাড়ি
ঢুকলে কি করে? কেউ দেখেনি ত?
দরোয়ান দেখেচে।
দেবদাস চক্ষু বিস্ফারিত করিল, দরোয়ান দেখেচে? আর কেউ?
উঠানে চাকরেরা শুয়ে আছে —তাদের মধ্যেও বোধ হয় কেউ দেখে থাকবে।
দেবদাস বিছানা হইতে লাফাইয়া উঠিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল। কেউ চিনতে পেরেচে কি?
পার্বতী কিছুমাত্র উৎকণ্ঠা প্রকাশ না করিয়া অত্যন্ত সহজভাবে বলিল, তারা সবাই আমাকে জানে, হয়ত-বা কেউ চিনে থাকবে।
বল
কি? এমন কাজ কেন করলে পারু?
পার্বতী মনে মনে কহিল, তা তুমি কেমন করে বুঝবে? কিন্তু কোন কথা কহিল না,
—অধোবদনে
বসিয়া রহিল।
এত
রাত্রে! ছি ছি! কাল মুখ দেখাবে কেমন করে?
মুখ
নীচু করিয়াই পার্বতী বলিল, আমার সে সাহস আছে।
কথা
শুনিয়া দেবদাস রাগ করিল না, কিন্তু নিরতিশয় উৎকণ্ঠিত হইয়া বলিল, ছি ছি
—এখনও কি তুমি
ছেলেমানুষ আছ? এখানে, এভাবে আসতে কি তোমার কিছুমাত্র লজ্জাবোধ হল না?
পার্বতী মাথা নাড়িয়া কহিল, কিছু না।
কাল
তোমার লজ্জায় কি মাথা কাটা যাবে না?
প্রশ্ন শুনিয়া পার্বতী তীব্র অথচ করুণ দৃষ্টিতে দেবদাসের মুখপানে ক্ষণকাল চাহিয়া
থাকিয়া অসঙ্কোচে কহিল, মাথা কাটাই যেতো —যদি না আমি নিশ্চয় জানুতম, আমার সমস্ত লজ্জা
তুমি ঢেকে দেবে।
দেবদাস বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া বলিল, আমি! কিন্তু আমিই কি মুখ দেখাতে পারব?
পার্বতী তেমনি অবিচলিতকণ্ঠে উত্তর দিল, তুমি? কিন্তু তোমার কি দেবদা?
একটুখানি মৌন থাকিয়া পুনরায় কহিল, তুমি পুরুষ মানুষ। আজ নাহয় কাল তোমার কলঙ্কের কথা
সবাই ভুলবে; দুদিন পরে কেউ মনে রাখবে না —কবে কোন্ রাত্রে হতভাগিনী পার্বতী তোমায়
পায়ের উপর মাথা রাখবার জন্যে সমস্ত তুচ্ছ করে এসেছিল।
ও কি
পারু?
আর আমি—
মন্ত্রমুগ্ধের মত দেবদাস কহিল, আর তুমি?
আমার
কলঙ্কের কথা বলচ? না, আমার কলঙ্ক নেই। তোমার কাছে গোপনে এসেছিলাম বলে যদি আমার
নিন্দে হয়, সে নিন্দে আমার গায়ে লাগবে না।
ও কি
পারু? কাঁদচ?
দেবতা, নদীতে কত জল। অত জলেও কি আমার কলঙ্ক চাপা পড়বে না?
সহসা
দেবদাস পার্বতীর হাত দুখানি ধরিয়া ফেলিল —পার্বতী!
পার্বতী দেবদাসের পায়ের উপর মাখা রাখিয়া অবরুদ্ধস্বরে বলিয়া উঠিল
—এইখানে একটু স্থান
দাও, দেবদা!
তাহার পর দুইজনেই চুপ করিয়া রহিল। দেবদাসের পা বহিয়া অনেক ফোঁটা অশ্রু শুভ্র শয্যার
উপর গড়াইয়া পড়িল।
বহুক্ষণ পরে দেবদাস পার্বতীর মুখ তুলিয়া ধরিয়া বলিল, পারু, আমাকে ছাড়া কি তোমার
উপায় নেই?
পার্বতী কথা কহিল না। তেমনি করিয়া পায়ের উপর মাথা পাতিয়া পড়িয়া রহিল। নিস্তব্ধ ঘরের
মধ্যে শুধু তাহার অশ্রুব্যাকুল ঘন দীর্ঘশ্বাস দুলিয়া দুলিয়া, ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে
লাগিল। টং টং করিয়া ঘড়িতে দুইটা বাজিয়া গেল। দেবদাস ডাকিল, পারু!
পার্বতী রুদ্ধকণ্ঠে বলিল, কি?
বাপ-মায়ের একেবারে অমত, তা শুনেচ?
পার্বতী মাথা নাড়িয়া জবাব দিল যে, সে শুনিয়াছে। তাহার পর দুইজনেই চুপ করিয়া রহিল।
বহুক্ষণ অতিবাহিত হইবার পর দেবদাস দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া কহিল, তবে আর কেন?
জলে
ডুবিয়া মানুষ যেমন করিয়া অন্ধভাবে মাটি চাপিয়া ধরে, সেটা কিছুতেই ছাড়িতে চাহে না,
ঠিক তেমনি করিয়া পার্বতী অজ্ঞানের মত দেবদাসের পা দুটি চাপিয়া ধরিয়া রাখিল। মুখপানে
চাহিয়া কহিল, আমি কিছুই জানতে চাইনে, দেবদা!
পারু, বাপ-মায়ের অবাধ্য হব?
দোষ
কি? হও।
তুমি
তাহলে কোথায় থাকবে?
পার্বতী কাঁদিয়া বলিল, তোমার পায়ে—
আবার দুইজনে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। ঘড়িতে চারিটা বাজিয়া গেল। গ্রীষ্মকালের
রাত্রি, আর অল্পক্ষণেই প্রভাত হইবে দেখিয়া দেবদাস পার্বতীর হাত ধরিয়া কহিল, চল,
তোমাকে বাড়ি রেখে আসি—
আমার
সঙ্গে যাবে?
ক্ষতি কি? যদি দুর্নাম রটে, হয়ত কতকটা উপায় হতে পারবে
—
তবে
চল।
উভয়ে
নিঃশব্দ পদক্ষেপে বাহির হইয়া গেল।