শ্রবণ নমুনা
আফসানা রুনা [শ্রবণ নমুনা]

             ১৭৬০
রাগ: উদাসী ভৈরব (নজরুল সৃষ্ট), তাল: ত্রিতাল

সতী-হারা উদাসী ভৈরব কাঁদে।
বিষাণ ত্রিশূল ফেলি' গভীর বিষাদে

              জটাজুটে গঙ্গা
              নিস্তরঙ্গা,
রাহু যেন গ্রাসিয়াছে ললাটের চাঁদে॥
দুই করে দেবী-দেহ ধরি' বুকে বাঁধে,
রোদনের সুর বাজে প্রণব-নিনাদে।
ভক্তের চোখে আজি ভগবান শঙ্কর

সুন্দরতর হ'ল
পড়ি' মায়া ফাঁদে॥

ভাবার্থ:
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে
ভৈরব হলেন শিব বা মহাদেবের অপর নাম। শিবের স্ত্রী সতীর (মহামায়া, দুর্গা) দেহত্যাগের পর, তাঁর বিরহজনীত কাতরতা এই গানে ফুটে উঠেছে।

কালিকা পুরাণ মতে– দক্ষ মহামায়াকে [দুর্গা] কন্যারূপে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করেন দক্ষের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহামায়া দক্ষকে বলেন, তিনি অবিলম্বে তাঁর (দক্ষের) পত্নীর গর্ভে তাঁর কন্যারূপ জন্মগ্রহণ করবেন এবং মহাদেব-এর স্ত্রী হবেন। বে তাঁকে (দুর্গাকে) যথাযথ সমাদর না করলে তিনি দেহত্যাগ করবেন এরপর দক্ষ অসিক্লী-কে বিবাহ করেন বীরিণী'র গর্ভে মহামায়া জন্মগ্রহণ করেন দক্ষ এঁর নাম রাখেন সতী [১-৪৪। অষ্টমোহধ্যায়, কালিকাপুরাণ]

সতী যৌবনে পদার্পণ করলে, মহাদেব-এর সাথে তাঁর বিবাহ হয় কিন্তু মহাদেব দক্ষকে যথোচিত সম্মান প্রদর্শন না করায় ইনি ক্রমে ক্রমে মহাদেবের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেন বিবাহের এক বৎসর পর, দক্ষ এক মহাযজ্ঞের য়োজন করেন এই যজ্ঞে দক্ষ মহাদেব ও সতী কাউকেই নিমন্ত্রণ করলেন না সতী নারদের মুখে এই যজ্ঞের কথা জানতে পেরে অযাচিতভাবে যজ্ঞে যাবার উদ্যোগ নেন মহাদেব এই যাত্রায় সতীকে বাধা দেন এতে সতী ক্রুদ্ধ হয়ে– তাঁর মহামায়ার দশটি রূপ প্রদর্শন করে মহাদেবকে বিভ্রান্ত করেন এর দশটি রূপ ছিল– কালী, তারা, রাজ-রাজেশ্বরী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলামূখী, মাতঙ্গী ও মহালক্ষ্মী মহাদেব শেষ পর্যন্ত সতীকে দক্ষের যজ্ঞানুষ্ঠানে যাবার অনুমতি প্রদান করেন কিন্তু যজ্ঞস্থলে দক্ষ মহাদেবের নিন্দা করলে– সতী পতি নিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহত্যাগ করেন সতীর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে ক্রুদ্ধ মহাদেব নিজের জটা ছিন্ন করলে, বীরভদ্র জন্মলাভ করেন পরে বীরভদ্র দক্ষের যজ্ঞ পণ্ড করে মুণ্ডুচ্ছেদ করেন এরপর মহাদেব সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেন এর ফলে সৃষ্টি ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হলে, বিষ্ণু তাঁর চক্র দিয়ে সতীদেহকে একান্নভাগে বিভক্ত করে দেনএই ৫১টি খণ্ড ভারতের বিভিন্ন স্থানে পতিত হয় ফলে পতিত প্রতিটি খণ্ড থেকে এক একটি মহাপীঠ উৎপন্ন হয় হিন্দু ধর্মাম্বীরা প্রতিটি মহাপীঠকে পবিত্র তীর্থস্থান হিসাবে বিবেচনা করেন। বিক্ষু্দ্ধ অন্যান্য দেবতারা মহাদেবকে শান্ত করেন। কিন্তু সতীর বিরহে তিনি অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন।  [দেখুন: দুর্গা]

গানটি শুরু হয়েছে 'সতী-হারা উদাসী ভৈরব কাঁদে' দিয়ে। বিরহকাতর মহাদেব তার নিত্য সঙ্গী বিষাণ, ত্রিশূল ত্যাগ করেছেন। তাঁর জটায় পতিত গঙ্গার তরঙ্গোচ্ছ্বাস যেন হারিয়ে গেছে। রাহু র গ্রাসে (চন্দ্রগ্রহণকালে) চন্দ্র নিষ্প্রভ হয়ে যায়, সতীর বিরহে মহাদেবের কপালে শোভিত চন্দ্রও তেমনি নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। তিনি দুই হাতে দেবীকে আলিঙ্গন করে কাঁদছেন। তাঁর কান্নার সুরে ধ্বনিত হচ্ছে বেদনার্ত ওঙ্কারধ্বনি। কবি, শঙ্করের (মহাদেবের অপর নাম) সেরূপ দেখে মোহিত এবং ভক্তির গভীর অনুভবে কবির কাছে শিব মহিমান্বিত হয়ে উঠেন ।

১. প্রকাশ ও গ্রন্থভুক্তি:

২. রেকর্ড সূত্র: নাই। 

৩. রচনাকাল:
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে, কাজী নজরুল ইসলাম উদাসী ভৈরব  নামনাটিকাটি বেতারে অভিনয় আকারে পরিবেশনের পরিকল্পনা নেন । এই বিচারে বলা যায়, গানটি রচিত হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলাম ৪০ বৎসর বয়সের দিকে।
 

৪. প্রাসঙ্গিক পাঠ: গানটি কাজী নজরুল ইসলাম, জগৎ ঘটক রচিত উদাসী ভৈরব নামক
নাটকের জন্য লিখেছিলেন। মূলত এই নাটিকাটির গান এবং অধিকাংশ সংলাপ নজরুল ইসলাম রচনা করেছিলেন।  নাটিকাটি ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই নভেম্বর তারিখে বেতারে প্রচারিত হয়। এটি ছিল উক্ত নাটকের ষষ্ঠ গান। গানটি পরিবেশন করেছিলেন এ বাগচী-এর কণ্ঠে গীত হয়েছিল।

এই গানটি নজরুল-সৃষ্ট 'উদাসী-ভৈরবী' রাগে নিব্দ্ধ। এই বিষয়ে জগৎ ঘটক তাঁর স্বরলিপি গ্রন্থ 'নবরাগ' -এ লিখেছেন

'বহুকাল পূর্বের কথাউদাসী ভৈরব  নামে একখানি নাটিকা বেতারে অভিনীত হবার জন্যে কবি আমাকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন এবং এর ছয়খানি গান তিনি রচনা ও তাতে সুরারোপ করেন। সুরগুলি রাগ-ধর্মী ও তাঁর সৃষ্ট নবরাগ। বাসন্তী বিদ্যাবীথির প্রয়োজনীয় নাটিকাটি বেতারে সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হয়েছিল। ... গানগুলি অরুণ-ভৈরব, আশা-ভৈরব, শিবানী-ভৈরবী, রুদ্র-ভৈরব, যোগিনী ও উদাসী ভৈরব।' 

 ৫. সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম

. স্বরলিপিকার: জগৎ ঘটক।

. সঙ্গীত বিষয়ক তথ্যাবলী:
রাগ: উদাসী ভৈরব (নজরুল সৃষ্ট), তাল: ত্রিতাল।
গ্রহস্বর: সা