কনসার্ট ফর বাংলাদেশ
the concert for bangladesh

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অর্থ সাহায্য করা জন্য আয়োজিত একটি সঙ্গীতানুষ্ঠান। এই সঙ্গীতানুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন পণ্ডিত রবি শঙ্কর। তিনি ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেন। এই সময় তিনি ব্রিটিশ সঙ্গীত শিল্পী এবং বিটলের অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসনকে এই বিষয়ে উৎসাহী করে তোলেন। এই আয়োজনে তিনি ভারতবর্ষ এবং পাশ্চাত্য অন্যান্য আরও বহু বিখ্যাত শিল্পীদের একত্রিত করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন উল্লেখযোগ্য সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব ছিলেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, জোয়ান বায়েজ, আল্লা রাখা খাঁ ও ওস্তাদ আলী আকবর খান

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসের দিকে পণ্ডিত রবি শঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনকে 'রাগ' নামক চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করছিলেন। এই সময় বাংলাদেশের রবি শঙ্কর মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করার বিষয়টি নিয়ে  জর্জ হ্যারিসন -এর সাথে গভীরভাবে আলোচনা করেন এবং  জর্জ হ্যারিসনকে স্বপক্ষে আনতে সক্ষম হন। প্রাথমিকভাবে রবি শঙ্কর ২৫ হাজার মার্কিন ডলার সংগ্রহের কথা ভেবেছিলেন। জুন মাসের শেষের দিকে এ্যান্থোনি ম্যাসকারনহাসের বাংলাদেশ সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় সানডে টাইমস পত্রিকায়। রবি শঙ্কর-এর তাড়না এবং প্রকাশিত সংবাদাদি পাঠ করে জর্জ হ্যারিসন গভীরভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং কনসার্টের জন্য উঠে পড়ে লাগেন। এই সময় উভয় সঙ্গীত শিল্পীর সাথে বাংলাদেশের বিষয়টি নিয়ে হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়া বলেছিলেন, ‘জর্জের কাছে শুনেছি, একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা, ধ্বংস আর হানাহানি বিপর্যস্ত করে তুলেছিল রবি শংকরকে। এ নিয়ে মনঃকষ্টে ছিল সে।

 অন্যদিকে নিজের রেকর্ডিং নিয়ে ব্যস্ত ছিল জর্জ। সত্তরে বিটল্‌স ভেঙে যাওয়ায় নতুন করে ক্যারিয়ার গড়তে সে মনোযোগী হয়ে ওঠে। এ সময় রবিশঙ্কর জানায়, বাংলাদেশের জন্য তহবিল সংগ্রহে একটি কনসার্ট করতে চায়। এ উদ্যোগে সে জর্জকে পাশে পেতে চায়। জর্জেরও মনে হলো, এ কাজে তার নিযুক্ত হওয়া উচিত। তার ডাকে অনেকে সাড়া দেবে, একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোর মাঝামাঝি সময়ে ওই কনসার্ট আয়োজন সময়োপযোগী ছিল। জর্জ তখন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, ওস্তাদ আলী আকবর খান, ওস্তাদ আল্লা রাখা ও রবি শঙ্করকে নিয়ে কনসার্ট আয়োজন করে। ওই কনসার্ট দিয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে জর্জের বন্ধন শুরু।’

জর্জ হ্যারিসন এই কনসার্টের জন্য বিটলেসর সহশিল্পীদের ডাকেন। প্রথমেই এই ডাকে সারা দেন বিটলেসর ড্রামার রিঙ্গো স্টার। এছাড়া প্রথম আহ্‌বানে সাড়া দিয়েছিলেন বিল প্রেস্টন, লিওন রাসেল। বব ডিলান ও এরিক ক্ল্যাপটন প্রস্তাবটি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত কনসার্টে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

২৬ জুলাই (সোমাবার) এই কনসার্টের মহড়া শুরু হয় নিউইয়র্কের নোলা স্টুডিওতে (Nola Studios)।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ারে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ রবি শঙ্কর (সেতার), আল্লা রাখা খাঁ (তবলা) ও ওস্তাদ আলী আকবর খান (সরোদ)

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১ আগষ্ট, তাঁর প্রধান সহযোগী এবং বন্ধু জর্জ হ্যারিসনকে সঙ্গে নিয়ে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ারে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামে ঐতিহাসিক কনসার্টের আয়োজন করেন।

জর্জ হ্যারিসন অনুষ্ঠানে হাজার হাজার শ্রোতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে শুরুতেই বলেন, ‘ভারতীয় সংগীত আমাদের চেয়ে অনেক গভীর।’ তারপর পণ্ডিত রবিশংকর ও ওস্তাদ আলী আকবর খান এবং সহশিল্পীদের পরিচয় করিয়ে দেন। কনসার্টটির শুরুতেই পণ্ডিত রবিশংকর এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, ‘প্রথম ভাগে ভারতীয় সংগীত থাকবে। এর জন্য কিছু মনোনিবেশ দরকার। পরে আপনারা প্রিয় শিল্পীদের গান শুনবেন। আমাদের বাদন শুধুই সুর নয়, এতে বাণী আছে। আমরা শিল্পী, রাজনীতিক নই। বাংলাদেশে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের পল্লিগীতির সুরের ভিত্তিতে আমরা বাজাব “বাংলা ধুন”।’ তিনি ‘বাংলা ধুন’ নামের একটি নতুন সুর সৃষ্টি করেছিলেন। সেটি দিয়েই ওস্তাদ আলী আকবরের সঙ্গে যুগলবন্দীতে কনসার্ট শুরু হয়েছিল। তবলায় ছিলেন ওস্তাদ আল্লা রাখা এবং তানপুরায় ছিলেন কমলা চক্রবর্তী।

'দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' এর বড় আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসন। অসাধারণ গিটার বাজিয়েছিলেন এরিক ক্ল্যাপটন। জর্জ হ্যারিসন আটটি গান গেয়েছিলেন। এর একটি ছিল বব ডিলানের সঙ্গে। বব ডিলান গেয়েছিলেন পাঁচটি গান (প্রথম লং প্লেতে পাঁচটি গান আছে, তবে ২০০৫ সালের ডিভিডিতে আছে চারটি গান)। রিঙ্গো স্টার ও বিলি প্রেস্টন একটি করে গান করেছিলেন। লিওন রাসেল একটি একক এবং ডন প্রেস্টনের সঙ্গে একটি গান করেছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষ পরিবেশনা ছিল জর্জ হ্যারিসনের সেই অবিস্মরণীয় গান ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল, একটি কনসার্ট হবে। কিন্তু সেদিন এত বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল কনসার্টটি যে পরে অনুষ্ঠানসূচি ঠিক রেখে, একই দিনে আরও একটি অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর।

জর্জ হ্যারিসন (বামে), বব ডিলন (মাঝে) ও এরিক ক্লিপটন (ডানে)

২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে নতুন করে প্রকাশিত হয়েছে 'দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' অ্যালবামের ডিভিডি। দুটি ডিভিডির একটি সুদৃশ্য সেট এখনো পাওয়া যায়। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অলিভার হ্যারিসন। একটি সিডিতে রয়েছে পুরো গানের অনুষ্ঠান। আরেকটি সিডিতে রয়েছে শিল্পী-কলাকুশলীদের সাক্ষাৎকার, যাতে কনসার্টটি আয়োজনের নেপথ্য কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। আরও আছে মহড়ার কিছু চিত্র ও গান। এর সঙ্গে আছে একটি সচিত্র পুস্তিকা। এই নতুন ডিভিডির ভূমিকায় পণ্ডিত রবিশংকর বলেছেন, ৭৫ বছরের সংগীতজীবনে যত কনসার্ট করেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ওই কনসার্টটিই। নতুন ডিভিডিতে সাক্ষাৎকারে এরিক ক্ল্যাপটন বলেছেন, এ অনুষ্ঠান সারা জীবনের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সংগীতশিল্পী হওয়াটা যে গর্বের একটা বিষয়, তা সেই মুহূর্তে বুঝেছিলাম। রিঙ্গো স্টার বলেন, অনুষ্ঠানটি যেন অনন্য সাজে সেজেছিল। দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি ছিল বিশাল।

২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে পুনঃপ্রচারিত দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ডিভিডি উপলক্ষে সঙ্গে প্রকাশিত পুস্তিকায় ইউএসএ ফান্ড ফর ইউনিসেফের সভাপতি চার্লস জে. লিওনসের লেখা থেকে জানা যায়, কনসার্টের টিকিট বিক্রি থেকে সংগ্রহ হয়েছিল প্রায় আড়াই লাখ ডলার। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত তিনটি রেকর্ডসহ অ্যালবাম এবং ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের মার্চের কনসার্ট নিয়ে তৈরি ফিল্ম থেকে আয় নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। পরবর্তী দশকগুলোতে এসব অর্থ দান করা হয় ইউনিসেফ পরিচালিত শিশুদের কল্যাণমূলক তহবিলে।

কনসার্টে অংশগ্রহণকারীরা