সোনা মসজিদ, ছোটো
মূল নাম : ছোটো সোনা মসজিদ।

বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন মসজিদরাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার ফিরোজপুর গ্রামে এই মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদের মাঝের দরজার উপর উপর প্রাপ্ত এক শিলালিপি থেকে জানা যায় সুলতান আলা-উদ-দীন শাহ এর শাসনামলে (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দ) ওয়ালী মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি এটি নির্মাণ করেছিলেন। মসজিদের দরজার উপর উপর প্রাপ্ত শিলালিপির অংশবিশেষ ভেঙে যাওয়ার কারণে, এর প্রকৃত নির্মাণকাল জানা যায় নাই। স্থপতিরা এই মসজিদের স্থাপত্য রীতিকে অনেক সময় হোসেন-শাহ আমলের মুসলিম-বাংলার রীতি নামে অভিহিত করে থাকেন। আকারের বড় এমন অপর একটি মসজিদকে বলা হয় বড় সোনা মসজিদ। আকারে ছোটো বলে এই মসজিদকে বলা হতো ছোটো সোনা মসজিদ। 

এর বহির্ভাগ ২৫.১ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৫.৯ মিটার। দেয়ালগুলো ইটের কিন্তু এর ভেতর ও বাইরের অংশ পাথর দিয়ে ঢাকা। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ভূমিকম্পের পর সংস্কার কাজের সময় পশ্চিম দেয়ালের দক্ষিণ অংশে পাথরের আস্তরণ অপসারিত হয়েছে। মসজিদের বাইরের চারকোণে চারটি বহুভুজাকৃতির বুরুজ আছে। এই বহুভুজের নয়টি অংশ বাইরে থেকে দেখা যায়। বুরুজগুলো ছাদের কার্নিশ পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এতে চারটি বড় ধাপ ধাপ আছে।

মসজিদের পূর্বদিকের সম্মুখভাগে পাঁচটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে তিনটি করে প্রবেশদ্বার রয়েছে। এর পূর্বদিকের ৫টি দ্বারের মধ্যটির উপরে আরবিতে একটি বাণী উৎকীর্ণ আছে। এর অনুবাদ 'দয়াময় ও করুণাময় আল্লাহর নামে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন যে, আল্লাহ ও বিচার দিনের উপর আর কাউকে ভয় করো না।'  

মসজিদের খিলান ও গম্বুজগুলো ইটের তৈরি।  পূর্ব দেয়ালের খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার বরাবর পশ্চিম দেয়ালের অভ্যন্তরে পাঁচটি অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব রয়েছে। অধিকাংশ মিহরাবের পাথর সরিয়ে নেয়ার ফলে এখন সমগ্র পশ্চিম দেওয়ালটি অনাবৃত হয়ে পড়েছে। অথচ এক সময় এ দেয়ালটিই ছিল মসজিদের সর্বাপেক্ষা সুদৃশ্য অংশ। পেছন দেয়ালের মধ্যবর্তীস্থলে কেন্দ্রীয় মিহরাবের বাইরের দিকে আয়তাকার একটি বর্ধিত অংশ রয়েছে। এর কার্নিসগুলো ধনুকের মতো বাঁকানো এবং ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি নিস্কাশনের জন্য ছাদের কিনারায় পাথরের নালি বসানো আছে।

দরজার খিলানগুলো বহুভাগে বিভক্ত এবং অলংকরণে সমৃদ্ধ। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আছে তিনটি করে দরজা। উত্তর দেয়ালের সর্ব-পশ্চিমের দরজাটি ব্যবহৃত হয়েছে সিঁড়ির জন্য। এই সিঁড়ি দিয়ে মসজিদের অভ্যন্তরের উত্তর-পশ্চিম দিকে দোতলার একটি বিশেষ কক্ষে যাওয়া যায়। এই কক্ষটি একটি পাথরের স্তম্ভের উপর অবস্থিত। ধারণা করা হয়,এই কক্ষটি মহিলারা ব্যবহার করতেন। আবার অনেকের ধারণা সুলতান বা শাসনকর্তার নিরাপদে নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা করে এই কক্ষটি তৈরি করা হয়েছিল।

মসজিদের অভ্যন্তরভাগ ২১.২ মিx১২.২ মি পরিমিত এবং কালো ব্যাসাল্ট দ্বারা মেঝে নির্মিত। ভিতরে ৮টি প্রস্তর স্তম্ভ দুসারিতে রয়েছে। প্রতি সারিতে রয়েছে চারটই স্তম্ভ। ফলে মসজিদের অভ্যন্তরে উত্তর-দক্ষিণে তিনটি সারি ও পূর্ব-পশ্চিমে পাঁচটি সারি সৃষ্টি হয়েছে। এই স্তম্ভ-মধ্যবর্তী স্থানগুলোর অভ্যন্তরে মোট ১৫টি বর্গাকার অংশ সৃষ্টি করেছে। যার মধ্যে তিনটি আয়তাকার অংশ চৌচালা খিলানযুক্ত ছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত। বাকি বারোটি বর্গাকৃতি অংশের প্রত্যেকটির উপর উল্টানো পানপাত্র আকারের গম্বুজ রয়েছে। এগুলোর সবই স্বতন্ত্র পাথরের স্তম্ভ ও ভবনের সঙ্গে যুক্ত স্তম্ভের শীর্ষে বসানো। কিন্তু এই অংশগুলোকে খিলানের মধ্যবর্তী অংশের উপরে, গম্বুজগুলোকে বসানোর উপযোগী করার জন্য করবেল পদ্ধতিতে ইটের পেন্ডেন্টিভ দ্বারা বন্ধ করা হয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরের ৮টি স্তম্ভ ও চারপাশের দেয়ালের উপর তৈরি হয়েছে মসজিদের ১৫টি গম্বুজ। মাঝের মিহরাব ও পূর্ব দেয়ালের মাঝের দরজার মধ্যবর্তী অংশে ছাদের ওপর যে গম্বুজগুলো রয়েছে সেগুলো বাংলা চৌচালা গম্বুজ। এদের দুপাশে দুসারিতে তিনটি করে মোট ১২টি গম্বুজ রয়েছে। এগুলো অর্ধ-বৃত্তাকার গম্বুজ। এ মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, বাইরের যে কোনো পাশ থেকে তাকালে কেবল পাঁচটি গম্বুজ দেখা যায়, পেছনের গম্বুজগুলো দৃষ্টিগোচর হয় না।

মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণের উপরিভাগে দোতলার কায়দায় নির্মিত একটি রাজকীয় গ্যালারি রয়েছে। গ্যালিরিটির এখন ধ্বংসপ্রায় অবস্থা। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে গ্যালারির প্রবেশপথ। দরজার সঙ্গে সংযুক্ত একটি সোপানযুক্ত প্লাটফর্ম হয়ে গ্যালারিতে পৌঁছানো যায়। গ্যালারির সম্মুখভাগে রয়েছে একটি মিহরাব।

পূব দেয়ালের পাঁচটি দরজা বরাবর মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে পাঁচটি মিহরাব। এদের মধ্যে মাঝেরটি আকারে বড়। প্রতিটির নকশাই অর্ধ-বৃত্তাকার। মিহরাবগুলোতে পাথরের উপর অলংকরণ রয়েছে। সর্ব উত্তরের মিহরাবটির উপরে দোতলার কামরাটিতেও একটি মিহরাব রয়েছে।

মসজিদের অলংকরণের ক্ষেত্রে খোদাইকৃত পাথর, ইটের বিন্যাস, পোড়ামাটির ফলকের গিল্টি ও চকচকে টালি ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এগুলোর ভেতর প্রাধান্য পেয়েছে খোদাইকৃত পাথর। পূর্বে পনেরোটি গম্বুজ ও খিলান ছাদের সবগুলোই গিল্টি করা দেখতে পান। কিন্তু বর্তমানে গিল্টির কোন চিহ্ন নেই। প্যানেলের কিনারাগুলিতে রয়েছে লতাপাতার নকশা এবং এদের অভ্যন্তরভাগে হিন্দু আমলের শিকল ও ঘন্টার মোটিফ অনুসরণে বিভিন্ন ধরনের ঝুলন্তরীতি অনুসরণ করা হয়েছে। খিলানের স্প্যান্ড্রিল ও ফ্রেমের উপরের স্থানগুলি আকর্ষণীয় অলংকরণরীতিতে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে খোদাই করা গোলাপ দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। গম্বুজ ও খিলান ছাদের অভ্যন্তর ভাগে পোড়ামাটির ফলক দিয়ে অলংকৃত। তবে খিলান ছাদের অলংকরণ করা হয়েছে স্থানীয় কুঁড়েঘরের বাঁশের ফ্রেমের অনুকরণে। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় অলংকরণ হলো কোণের বুরুজের খোদাইকৃত পাথরের বেষ্টনী এবং দ্বারপথ ও ফ্রেমের উপরে বসানো পাথরের কার্নিস ও অলংকরণ রেখা। উল্লেখ্য, সম্মুখের সবগুলি খিলানপথ ও মির্‌হাবের খিলানগুলি ছিল খাঁজবিশিষ্ট এবং এগুলো অনেকাংশে এ মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিল।

মসজিদের প্রবেশদ্বারের মতোই পূর্ব দিকের ফটকে একসময় বিভিন্ন নকশা খোদাইকৃত প্রস্তর ফলকের আস্তরণ ছিল। কিন্তু এখানে সেখানে বিক্ষিপ্ত কিছু গোলাপ নকশা ছাড়া এসব অলংকরণের তেমন কিছই এখন আর নেই। ফটকের ১৪.৫ মিটার পূর্বদিকে একটি পাথরের প্লাটফর্ম রয়েছে যার আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৪.২ মিটার, পূর্ব-পশ্চিমে ৬.২ মিটার এবং উচ্চতা ১ মিটার। এর চার কোণে রয়েছে একটি করে প্রস্তর স্তম্ভ। প্লাটফর্মের পরে কয়েকটি উর্ধ্বমুখী আয়তাকার ধাপ আছে এবং এ ধাপসমূহের পরিধি উপরের দিকে ক্রমশ হ্রাস হয়ে এসেছে। দুটি সমাধিতে রয়েছে কুরআনের আয়াত ও আল্লাহর কতিপয় নাম সম্বলিত অগ্রভাগ সরু পিপাকৃতির পাথরের সমাধিফলক। এখানে কারা সমাহিত আছেন তা জানা যায় নি। অনে মনে করেন, কবর দুটি মসজিদের নির্মাতা ওয়ালী মুহম্মদ ও তার পিতা আলীর।

মূল মসজিদের উত্তর দিকে একটি দিঘি রয়েছে। বর্তমানে স্থাপনাটির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ১.৩ মিটার উঁচু একটি পাচিল দিয়ে ঘেরা দুটো কবর রয়েছে। এ কবর দুটো হলো
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও শহীদ মেজর নাজমুল হক টুলু'র।


তথ্য সূত্র :
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা তথ্য বাতায়ন। [ইন্টারনেট]
বাংলা বিশ্বকোষ। দ্বিতীয় খণ্ড। নওরোজ কিতাবিস্তান। ডিসেম্বর ১৯৭৫

বহিঃসংযোগ : http://www.dcchapainawabganj.gov.bd/index.php?option=com_content&view=article&id=57