মিশরের ইতিহাস

ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ২ লক্ষ ৫০ হাজার বছর আগে, বর্তমান মিশরের নীল নদের উভয় প্রান্ত জুড়ে ছিল বিস্তীর্ণ ঘাসে ঢাকা প্রান্তর। এই সময় এই অঞ্চলে প্রচুর উদ্ভিদভোজী প্রাণীর অবাধ বিচরণ ছিল। প্রায় ১ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে ইথিওপিয়া অঞ্চল থেকে আদি মানবগোষ্ঠীর একদল এখানে প্রবেশে করেছিল। এরা ছিল মূলত শিকার

কোয়াটার্নারি বরফ যুগের প্রভাবে এই অঞ্চল বরফে ঢেকে গিয়েছিল। আনুমানিক ১৫,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে। এর ফলে হিমবাহ অধিযুগ শেষ হয়ে যায়। এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল বর্তমান মিশর ও সাহারা মরুভূমি অঞ্চলে। ক্রমাগত তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়ার সূত্রে এই অঞ্চল ধীরে ধীরে গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে পরিণত হতে থাকে।  

৮০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হয় এবং এই আমলের শেষ সময় পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। ফলে বর্তমান সাহারা একটি বিশাল অরণ্যাঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। এর প্রভাব পড়েছিল মিশরে। এই অঞ্চলে ব্যাপক বনায়নের ফলে প্রচুর উদ্ভিদভোজীর প্রাণীর আধিক্য ঘটে।
সেই সাথে মাংশাসী প্রাণীরও আধিক্য ঘটেছিল এই অঞ্চলে।

৬০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে বৃষ্টিপাতের আধিক্য কমতে থাকে এবং ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে সাহারা মরুভূমিতে পরিণত হওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। একই ভাবে মিশরে  গাছপালার পরিমাণ কমতে শুরু করেছিল। তবে নীল নদের প্রভাবে মিশর সাহারা মতো অনুর্বর ভূমিতে পরিণত হতে পারে নি।

একই সাথে শিকারের জন্য পর্যাপ্ত পশু না পাওয়ায়
৬০০০ খ্রিষ্ট্রাপূর্বাব্দের দিকে সাহারা অঞ্চল মানুষ স্থান ত্যাগ করে আফ্রিকার অন্যান্য অংশ এবং ইউরেশিয়ার দিকে চলে আসে। সম্ভবত এমনি একটি গোষ্ঠী ৬০০০-০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে বসতি স্থাপন করেছিল এবং পরবর্তী ৪০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এর একটি নব-সংস্কৃতি গড়ে তোলে। এই সংস্কৃতিটি বর্তমানে বদারিয়ান সভ্যতার (
Badari culture) নামে অভিহিত করা হয়। এর কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছিল এরা গম ও বার্লির চাষ করতো। উল্লেখযোগ্য গৃহপালিত পশুর ভিতরে ছিল ভেড়া ও ছাগল। এরা নীল নদীতে মৎস শিকার করতো। এর বাইরে বুনো ছাগল বা হরিণ শিকার করতো। শিকারের জন্য এরা বুমেরাং ব্যবহার করতো।

এরা কাঠের স্তম্ভ ব্যবহার করে ঘর তৈরি করতে শিখেছিল। তবে বাড়ির ছাদে কি ধরনের উপকরণ ব্যবহার করতো তা জানা যায় নি। তামা, স্ফটিক ও হাতির দাঁতের তৈরি অলঙ্কার ব্যবহার করতো। এরা মৃতদেহকে কবর দিত। মৃত ব্যক্তিকে এরা মাদুর বা পশুর চামড়া দিয়ে  মুড়ে দিত। সেই সাথে কবরে মৃত্ ব্যক্তির ব্যক্তিগত জিনিস-পত্রও রাখতো।
 

নাডাক সভ্যতার মাটির পাত্র

খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের ভিতরে এই অঞ্চলে জীবনযাত্রার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এই পৃথক সভ্যতার নামকরণ করা হয়েছে নাকাডা (Naqada)। এদের ব্যবহার্য দ্রব্যাদির সাথে বদারিয়ান সভ্যতার দ্রব্যাদির পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এই সভ্যতার মানুষেরা বদারিয়ান সভ্যতার মানুষদের বিতারিত করে নতুন সভ্যতার পত্তন ঘটিয়েছিল, না কি  বদারিয়ান সভ্যতার মানুষেরা এই সভ্যতার পত্তন ঘটিয়েছিল, তা স্পষ্টভাবে বলা যায় না। এরা কৃষিকাজের পাশাপাশি মৃত্তিকা-পাত্র তৈরিতে বিশেষ পারদর্শী ছিল। এছাড়া কাঠ হাতির দাঁতের তৈরি নানারকমের চিত্তাকর্ষক পণ্য তৈরি করতে পারতো। বাইরে থেকে Lapis Lazuli নামক রত্ন আমদানি করতো এবং এই রত্ন থেকে নানা ধরনের সৌখিন পণ্য তৈরি করতো।

খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৩৫০০ অব্দের ভিতরে নাকাডা সভ্যাতার মানুষের  জীবনযাত্রায় নানাভাবে পরিবর্তন ঘটে। এদের ছোটো ছোটো দল ছোটো রাজত্ব গড়ে তোলে। এবং প্রতিটি গোত্রের মানুষ পৃথক পৃথকভাবে ছোটো ছোটো কেন্দ্রীয় অঞ্চল হিসেবে সুগঠিত হয়ে উঠে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮০০ অব্দের দিকে এরা আন্তঃবাণিজ্য এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। এরই সূত্রে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও ঘটতে থাকে। ছোটো ছোটৌ গোষ্ঠীগুলো মিলে বড়ধরনের প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিণত হতে থাকে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪০০ অব্দের দিকে পুরো মিশর দুটি প্রশাসনিক পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এই ভাগ দুটি হলো- উচ্চ মিশর ও নিম্ন মিশর।

প্রাগৈতিহাসিক মিশরের ইতিহাসে শাসক হিসেবে যাদের নাম পাওয়া যায়, পৌরাণিক কাহিনিতে। পৌরাণিক চরিত্রগুলো মূলত দেবতা। এরা কিভাবে মিশরের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল এবং এদের ভিতরের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব কিভাবে কাজ করেছিল এসব নিয়ে মিশরের পৌরাণিক ইতিহাস রচিত হয়েছিল। এই ইতিহাস মানুষের ইহলৌকিক ও পরলৌকিক জীবনযাত্রা, ধর্মীয় বিধি ইত্যাদির সাথে জড়িত পরবর্তী বহুদিনের মানুষের কার্যক্রমকে প্রভাবিত এবং নিয়ন্ত্রণ করেছিল।

জন শাসকের সূত্রে মিশরের রাজতন্ত্রের ইতিহাস পাওয়া যায়। এই বিচারে মিশরের আদি ইতিহাসকে পৌরাণিক যুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরা মিশরীয় পৌরাণিক কাহিনিতে দেবতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই যুগের দেবতারা ছিলেন

নিম্ন মিশরে এরূপ কিছু পৌরাণিক রাজার নাম পাওয়া যায়। এদের ভিতরে এদের দেবতারা ছিল- হেসকিউ (Hsekiu), খায়ু (Khayu), তিউ (Tiu), থেশ (Thesh), নেহেব (Neheb), ওয়াজনের (Wazner), মেখ (Mekh), দ্বি ফ্যালকন (Double Falcon)।

এর পরের পর্যায়ে কিছু শাসকের নাম পাওয়া যায়। এরাও ঠিক পূর্ণ মানবসত্তা নয়। খ্রিষ্ট-পূর্ব ২৩শ অব্দের ভিতরে তিন জন রাজার নাম পাওয়া যায়। এরা সবাই ছিলেন উচ্চ মিশরের শাসক। এরা হলেন-

ফারাও প্রথম রাজবংশ: নার্মার
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ অব্দের দিকে দক্ষিণাঞ্চলের রাজা স্কর্পিয়ন উত্তরাঞ্চল দখল করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রাথমিকভাবে এই অভিযান ব্যর্থ হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০০ অব্দের দিকে তারা উত্তরাঞ্চল দখল করতে সক্ষম হয় এবং প্রথমবারের মতো উভয় মিশর একত্রিত হয়। এই যুদ্ধ জয়ের অধিনায়ক ছিলেন মেনেস। উল্লেখ্য মেনেসের অপর নাম নার্মার। এই রাজাই স্থাপন করে প্রথম ফারাও সাম্রাজ্য। নার্মার মেমফিস নামক স্থানে তার রাজধানী স্থাপন করে। নার্মার-এর পরে এই রাজ্যের রাজ হন তাঁর পুত্র হোর-আহা। নার্মার তাঁর পুত্র হোর-আহা-র হাতে রাজ্য সমর্পণ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৫০ অব্দ পর্যন্ত তিনি রাজ্য শাসন করেন। এরপর রাজ্য লাভ করেন দ্‌জের (
Djer)। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৯১ অব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।  দ্‌জের -এর পুত্র দ্‌জে (Djet) রাজত্ব করেন খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০১ অব্দ পর্যন্ত। এরপর রাজত্ব লাভ করেন মেরনেইথ। তিনি কতদিন রাজত্ব করেন তা স্পষ্ট জানা যায় না। এরপর তার পুত্র ডেন রাজত্ব করেন ৪২ বৎসর। ডেন-এর পুত্র আনেদ্‌জিব রাজত্ব করেন ১০ বৎসর। এরপর এঁর পুত্র রাজা হন সেমেরখেৎ। এঁর রাজত্বকাল ছিল ৯ বৎসর। এরপর রাজত্ব লাভ করেন তাঁর পুত্র কা'আ। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৯০ অব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ....

আখেনআতেন

ক্রমশ