২৪ পরগনা
বঙ্গদেশে বিলুপ্ত একটি বিশাল প্রশাসনিক এলাকার নাম। বর্তমানে এই পরগনাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের অন্তর্গত। এই পরগনা দুটি ভাগে বিভাজিত করে দুটি জেলায় রূপ দেওয়া হয়েছে। এই ভাগ দুটি হলো উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে আলেকজান্ডার ভারতের দিকে যাত্রা করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডার সিন্ধু নদ পার হয়ে তক্ষশীলায় প্রবেশ করেন।  আলেকজান্ডারের সময়ে ভারতে আগত গ্রিক ঐতিহাসিকরা গঙ্গারিডাই নামক একটি শক্তিশালী রাজার কথা উল্লেখ করেছেন। ধারণা করা হয়, এই অঞ্চল গঙ্গারিডাই রাজার অধীনে ছিল।

উল্লিখত ২৪টি পরগনা সরাসরি গুপ্ত সাম্রাজ্যের অংশ ছিল না। গৌড় রাজ
শশাঙ্ক এই অঞ্চলে শাসন কায়েম করতে পারে নি। পাল বংশের রাজা ধর্মপালের রাজ্যভুক্ত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। তবে সেন যুগের বহু দেব-দেবীর মুর্তি জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আবিস্কৃত হয়েছে। “মনসামঙ্গল” কাব্যে ২৪টি পরগনা জেলার অনেক স্থানের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। চাঁদ সওদাগর চম্পকনগরী থেকে যাত্রা শুরু করে তাঁর তরী ভাসিয়েছিলেন ভাগীরথীর প্রবাহে। তিনি কুমারহট্ট, ভাটপাড়া, কাকিনাড়া, মুলাজোর, গারুলিয়া, ইছাপুর, দিগঙ্গা-চনক (ব্যারাকপুর, খড়দহ, চিৎপুর, কলিকাতা, কালীঘাট ইত্যাদি জায়গা পার হয়েছিলেন। তিনি চম্পকনগরী থেকে যাত্রা শুরু করে বারুইপুরে পৌছেছিলেন। কর্ণপুর রচিত “চৈতন্যচরিতামৃত” গ্রন্থে ও ২৪টি পরগনা জেলার অনেক জায়গার নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।“মনসামঙ্গল” কাব্যে ও “চৈতন্যচরিতামৃত” গ্রন্থে পাওয়া বিভিন্ন জায়গার নাম ও বিবরণ তুলনা করলে দেখে যায় ২৪টি পরগনা জেলার উক্ত জায়গাগুলির অস্তিত্ব ছিল। চাঁদসওদাগর বারুইপুরে পৌছে আদি গঙ্গা তীরবর্তী মনসামন্দির লুঠ করেন। শ্রীচৈতন্যদেব বারুইপুরের কাছে অতিসরাতে অনন্ত পণ্ডিতের আতিথ্য গ্রহণ করেন।মথুরাপুর থানা অঞ্চলে ছিল ছত্রভোগ বন্দর।

ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে এই অঞ্চলের নদীপথে পর্তুগিজ জলদস্যুদের একচ্ছত্র আদিপত্য ছিল। পরবর্তী ১০০ বছর এই অঞ্চলে তাদের আধিপত্য বজায় ছিল। এই সময় পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচারে এই অঞ্চলের জনপদগুলো জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল। ১৭ শতাব্দীর শুরুতে প্রতাপাদিত্য যশোর, খুলনা, বরিশালসহ গোটা ২৪টি পরগনা জেলার অধিপতি ছিলেন। যশোররাজ প্রতাপাদিত্য পর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে বারবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন। তিনি সাগরদ্বীপ, সরসুনা ,জগদ্দল প্রভৃতি অঞ্চলে দুর্গ বানিয়ে এদের আটকাবার চেষ্ঠা করেন।

১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে মুঘলদের হাতে প্রতাপাদিত্য পরাজিত হয়। প্রতাপাদিত্যের পরাজয়ে বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরী বংশের প্রতিষ্টাতা লক্ষীকান্ত মজুমদার(গাঙ্গুলি) বাংলার সুবেদার মানসিংহের পক্ষ নেন। এর প্রতিদানে ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গির তাকে মাগুরা, পাইকান, আনোয়ারপুর, কলকাতার জমিদারি স্বত্ত্ব দেন। লক্ষীকান্ত মজুমদাররে নাতি কেশবচন্দ্র মজুমদার মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে দক্ষিণ ২৪টি পরগনা ও খুলনার জমিদার নিযুক্ত হন।

১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার নবাব মীরজাফর কলকাতার দক্ষিণে কুলপি পর্যন্ত অঞ্চলে ২৪টি জংলীমহল বা পরগনার জমিদারি সত্ত্ব ভোগ করার অধিকার দেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। ২৪টি পরগনা ছিল :

১. আকবরপুর
২. আমীরপুর
৩. আজিমবাদ
৪. বালিয়া
৫. বাদিরহাটি
৬. বসনধারী
৭. কলিকাতা
৮. দক্ষিণ সাগর
৯. গড়
১০. হাতিয়াগড়
১১. ইখতিয়ারপুর
১২. খাড়িজুড়ি
১৩. খাসপুর
১৪. মেদনমল্ল
১৫. মাগুরা
১৬. মানপুর
১৭. ময়দা
১৮. মুড়াগাছা
১৯. পাইকান
২০. পেচাকুলি
২১. সাতল
২২. শাহনগর
২৩. শাহপুর
২৪. উত্তর পরগনা।

১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে কোম্পানি লর্ড ক্লাইভকে এই ২৪টি পরগনা ব্যক্তিগত জায়গীর হিসাবে দেয়। ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড ক্লাইভের মৃত্যুর পর এটি আবার কোম্পানির হাতে চলে আসে। ইংরেজ আমলে ২৪ পরগনা জেলা জেলায় পরিণত করা হয়। ইংরেজ আমলে কলকাতাকে ২৪ পরগনা জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতের রাজধানীতে পরিণত করা হয়েছিল। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত বিভাজনের সূত্রে, যশোর জেলার বনগাঁ ২৪ পরগনা জেলার মধ্যে চলে আসে এবং সুন্দরবনের বৃহত্তম অংশ খুলনা ও বাখরগঞ্জের অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিম বঙ্গের ডঃ অশোক মিত্রের প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি এই জেলাকে বিভাজনের সুপারিশ করে। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ জেলাটিকে উত্তর ২৪ পরগণা জেলা ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা নামে দুটি জেলায় ভাগ করা হয়। বর্তমানে এই দুটি জেলাই প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত।


সূত্র :
http://www.gaibandha.gov.bd/node/106941