সিন্ধু সভ্যতা


মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় ভারতবর্ষের সিন্ধু নদীর তীরে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ বৎসর বা তার আগে থেকে যে প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাকেই সিন্ধু সভ্যতা নামে অভিহিত করা হয়। আয়তনের বিচারে এই সভ্যতা প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার চেয়ে অনেক বড়। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এই সভ্যতার আয়তন সব মিলিয়ে প্রায় ১২,৫০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। সম্প্রতি বাংলাদেশের
উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে বিকশিত সভ্যতাকে এরই বর্ধিত অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তা যদি হয়, তবে এর আয়তন দাঁড়ায় পুরো ভারতবর্ষব্যাপী। ধারণা করা হয় এই সভ্যতা গড়ে তুলেছিল- ভারতে আগত দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মানুষ।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পাক-ভারত বিভাজনের সূত্রে, প্রাচীন ভারতবর্ষের সিন্ধু সভ্যতার বেশিরভাগ অংশই পড়েছে পাকিস্তানে। ভারতের পশ্চিমাংশে কিছু অঞ্চলে এর নমুনা পাওয়া গেছে। অবিভক্ত ভারতে এই সভ্যতার সন্ধনে যে কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, সে কার্যক্রমের ধারাটি ১৯৪৭-উত্তর ভারত ও পাকিস্তানে অব্যাহত রয়েছে এবং সে সূত্রে আরও অনেক অঞ্চলে এই সভ্যতার নমুনা পাওয়া গেছে।


এই সভ্যতার অনুসন্ধানের সূত্রপাত ঘটেছিল খ্রিষ্ট্রীয় ১৮শ শতকের প্রথম দিকে। ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে চার্লস ম্যাসন (জেমস লুইস) নামক 'ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি'র জনৈক সৈন্য, পাঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিংহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। এই যাত্রাকালে পাঞ্জাবের পশ্চিমে মন্টোগোমারি জেলার ইরাবতী (রাভি) নদীর পূর্ব তীরে হরপ্পায় একটি স্তূপ লক্ষ্য করেন। চার্লস ম্যাসন তাঁর ন্যারেটিভস অফ ভেরিয়াস জার্নিস ইন বালোচিস্তান, আফগানিস্তান অ্যান্ড দ্য পাঞ্জাব গ্রন্থে এই স্তূপকে  প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে সম্ভাবনাময় একটি অংশ হিসাবে ধারণা দিয়েছিলেন। এরপর দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এই অঞ্চলের স্তূপ নিয়ে কেউ আগ্রহ দেখান নি।

১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার জন ও উইলিয়াম ব্রান্টন (দু্‌ই ভাই) করাচি ও লাহোরের মধ্যে ইষ্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানি লাইন স্থাপনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সূত্রে  তিনি রেললাইন স্থাপনের জন্য উপযুক্ত ব্যালাস্ট তৈরির উপকরণের সন্ধান করতে থাকেন।  স্থানীয় লোকদের মারফতে জানতে পারেন, স্থানীয় লোকেরা এই অঞ্চলের স্তূপ থেকে পোড়া ইট তুলে ঘর বাড়ি তৈরি করে থাকে। ইঞ্জিনিয়াররা রেললাইন স্থাপনের জন্য যে স্থান নির্ধারণ করেছিলেন, তার পাশেই একটি প্রাচীন নগরীর কথা জানতে পারেন। স্থানীয় লোকদের ভাষায় এই নগরীর নাম ছিল ব্রাহ্মণাবাদ। উল্লেখ্য এটি ছিল হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ। এর কিছুদিন পর,  উইলিয়াম ব্রান্টন এই স্থানের উত্তরে দ্বিতীয় স্তূপে একই ধরনের ইটের সন্ধান পান। সম্ভবত এই স্থানটি ছিল ময়েঞ্জোদারো। কথিত আছে এই ইট দিয়ে রেলপথের জন্য ব্যালাস্ট তৈরি করা হয়েছিল এবং লাহোর থেকে করাচি পর্যন্ত ৯৩ মাইল (১৫০ কিলোমিটার) দৈর্ঘ্যের রেলপথ স্থাপিতও হয়েছিল এই ব্যালাস্ট দিয়ে।
 

হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম নগর ধোলাভিরা-র ধ্বংসাবশেষ

এই সময়ে তৎকালনী ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের প্রধান মেজর জেনারেল আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৫৩ এবং ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে কয়েকবার এই অঞ্চল পরিদর্শন করেন এবং কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা সংগ্রহ করতে সমর্থ হন। ১৮৭২-৭৫ খ্রিষ্টাব্দে কানিংহাম প্রথম হরপ্পা সিলমোহর প্রকাশ করেন। এই সিলমোহরে অঙ্কিত লিপি দেখে তিনি মনে করেছিলেন ব্রাহ্মীলিপি। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে জে. ফ্লিট নামক অপর একজন গবেষক আরও কতকগুলি হরপ্পা সিলমোহর আবিষ্কার করেন। এতসব সব নমুনা পাওয়ার সূত্রে, তদানীন্তন ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অধিকর্তা ডিরেক্টর জেনারেল জন মার্শাল এই অঞ্চলে খনন কাজে উৎসাহ বোধ করেন। অবশেষে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ মার্শালের তত্ত্বাবধানে ময়েঞ্জোদারো ও হরপ্পায় খনন কাজ শুরু হয়। এই অভিযানের সূত্রে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে প্রত্নতত্ত্ববিদ্ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধুনদের পশ্চিম তীরে ময়েঞ্জোদাড়ো স্তূপকে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থল হিসাবে সুনিশ্চিতভাবে ঘোষণা দেন। তিনি অবশ্য এই স্থানকে বৌদ্ধ বিহারের ধ্বসস্তূপ ভেবেছিলেন। একই বৎসরে রায়বাহাদুর দয়ারাম সাহানী হরপ্পাতে প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ বলে অনুমান করেন।

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই মহেঞ্জোদাড়োর অধিকাংশ প্রত্নস্থল আবিষ্কৃত হয়ে গিয়েছিল। এরপর ১৯৪৪ সালে ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক বিভাগের তদানীন্তন ডিরেক্টর স্যার মর্টিমার হুইলারের নেতৃত্বে অপর একটি দল এই অঞ্চলে খননকার্য চালায়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে


মেহেরগড়ের
সভ্যতার
 

আহমদ হাসান দানি, ব্রিজবাসী লাল, ননীগোপাল মজুমদার, স্যার মার্ক অরেল স্টেইন প্রমুখ এই অঞ্চলে খননকার্যে অংশ নিয়েছিলেন। ভারত বিভাগের পর সিন্ধু সভ্যতার অধিকাংশ প্রত্নস্থল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত হয়। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান সরকারের পুরাতাত্ত্বিক উপদেষ্টা স্যার মর্টিমার হুইলার এই সব অঞ্চলে খননকার্য চালায়। পরবর্তী সময়ে সিন্ধু সভ্যতার সীমান্তবর্তী প্রত্নস্থলগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে পশ্চিমে বেলুচিস্তানের সুকতাগান ডোর এবং উত্তরে আফগানিস্তানের আমুদারিয়া বা অক্সাস নদীর তীরে শোর্তুগাই অঞ্চলে। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসী প্রত্নতাত্ত্বিক মিশন উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের বোলান নদীর তীরে মেহেরগড় নামক স্থানে আরও একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের সন্ধান পান।  ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে Scientific American পত্রিকায় জাঁ ফ্রাঁসোয়া জারিজ ও রিচার্ড মিডৌ তাঁদের গবেষণাপত্রে জানান যে, খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে মেহেরগড়ের সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিল এবং এই সভ্যতা সাতটি স্তরে বিকশিত হয়েছিল।

বিভিন্ন গবেষণাপত্রের সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, এই অঞ্চলের সভ্যতার কালানুক্রমিক ক্রমবিকাশের ধারাটি নিচে উল্লেখ করা হলো। 

হরপ্পা সভ্যতার শুরু হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব  ৩০০০ অব্দের দিকে। একে বলা হয়, আদি হরপ্পা সভ্যতা। এই সময়ে মানুষ ইরাবতী নদীর তীরে বসবাস শুরু করেছিল। সম্ভবত মেহেরগড় থেকে আগত মানুষ এই অঞ্চলে নতুন নগর স্থাপন করেছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০-২৯০০ অব্দের মেহেরগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনার সাথে আদি হরপ্পার প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনার বিশেষ মিল পাওয়া যায়। এই সভ্যতা পশ্চিমে হাকরা-ঘগ্গর নদী উপত্যকার সাথে এই সভ্যতার সাথে সম্পর্ক ছিল। মহেঞ্জোদাড়োর নিকটবর্তী অপর একটি স্থানের নাম কোট দিজি। এই অঞ্চলে খ্রিষ্টপূর্ব ২৮০০-২৬০০ একটি সভ্যতার নমুনা পাওয়া গেছে। একে হরপ্পার কোট দিজি পর্ব বা হরপ্পারর দ্বিতীয়ধাপ হিসাবেও বিবেচনা করা হয়।

খ্রিষ্টপূর্ব
২৬০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দের ভিতরে হরপ্পার আশেপাশের অনেক অঞ্চলে বিভিন্ন নগর গড়ে উঠেছিল। ধারণা করা হয়, এই জাতীয় ছোটো বড়ো নগরীর সংখ্যা ছিল প্রায় সহস্রাধিক। এদের ভিতের উল্লেখযোগ্য নগরীগুলো সে সকল স্থানে পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো
পাকিস্তানের হরপ্পা, গনেরিওয়ালা, মহেঞ্জোদাড়ো এবং ভারতের ধোলাবীরা, কালিবঙ্গান, রাখিগড়ি, রুপার, লোথাল ইত্যাদি।
       
           দেখুন : হরপ্পা (বিস্তারিত)
 


http://www.harappa.com/har/indus-saraswati.html
বাংলা বিশ্বকোষ (চতুর্থ খণ্ড)। নওরোজ কিতাবিস্তান। নবেম্বর, ১৯৭৬।