মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
United States of America(USA)

উত্তর আমেরিকা মহাদেশে অবস্থিত একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র। রাষ্ট্রটিতে রয়েছে একান্ন রাজ্য ও একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় জেলা। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি। ১৫০৭ খ্রিষ্টাব্দে জার্মান মানচিত্রকর মার্টিন ওয়াল্ডসিম্যুলার, তাঁর মানচিত্রে ইতালীয় আবিষ্কারক ও মানচিত্রকর আমেরিগো ভেসপুচির নামানুসারে পশ্চিম গোলার্ধের নামকরণ করেন আমেরিকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে পূর্বতন ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে প্রথম আমেরিকা নামটি ব্যবহৃত হতো।

১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জুলাই
"unanimous Declaration of the thirteen united States of America" নামে এই ঘোষণাপত্রটি "Representatives of the united States of America" কর্তৃক গৃহীত হয়।
১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই নভেম্বর দ্বিতীয় মহাদেশীয় কংগ্রেসে আর্টিকলস অফ কনফেডারেশন বিধিবদ্ধকরণের মাধ্যমে বর্তমান নামটি চূড়ান্ত হয়। এই আর্টিকেলে বলা হয়েছিল:
'The Stile of this Confederacy shall be 'The United States of America

ভৌগোলিক অবস্থান: ৪০° উত্তর ১০০° পশ্চিম। এর উত্তর ও দক্ষিণ সীমান্তে যথাক্রমে কানাডা ও মেক্সিকো  অবস্থিত। এর আলাস্কা রাজ্যটি উত্তর আমেরিকা মহাদেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এই রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে রয়েছে কানাডা ও পশ্চিমে বেরিং প্রণালী। উলেখ্য প্রণালীর ওপারে রয়েছে রয়েছে রাশিয়া। এর হাওয়াই রাজ্যটি মধ্য-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত একটি দ্বীপপুঞ্জ। এছাড়াও ক্যারিবীয় সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের অনেক অঞ্চল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকারভুক্ত।

আয়তন: ৩৭,৯৬,৭৪২ বর্গমাইল (৯৮,৩৩,৪২০ বর্গকিলোমিটার)। আয়তনের বিচারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের তৃতীয় অথবা চতুর্থ বৃহত্তম রাষ্ট্র।
জনসংখ্যা: ৩২৫,৭১৯,১৭৮ (২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ)
ভাষা: সরকারি ভাষা ইংরেজি।

ইতিহাস: খ্রিষ্টপূর্ব ৪০-১২ হাজার অব্দের ভিতরে আমেরিকা মহাদেশে মানুষ এসেছিল এশিয়া অঞ্চল থেকে। এরা ছিল সাইবেরিয়া অঞ্চলের মঙ্গোলীয় যাযাবর জনগোষ্ঠী। ধারণা করা হয়, এর প্রচণ্ড শীতে টিকে থাকার মতো পশুর চামড়ার পোশাক তৈরি করা শিখেছিল। এরা আগুন জ্বালাতে পারতো এবং তীক্ষ্ণ পাথর যুক্ত বর্শা এবং তীর-ধনুকের ব্যবহার করতে পারতো। ফলে সে আমলের উত্তর আমেরিকা মহাদেশের হিংস্র জীবজন্তুর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে জানতো এবং পশু শিকারার মতো কৌশল আয়ত্ত্ব করেছিলে। এরা আলাস্কা সংলগ্ন বেরিং প্রণালী দিয়ে উত্তর আমেরিকায় প্রবেশ করার পর ধীরে দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। ধারণা করা হয়, ইউরোপীয়দের আমেরিকা মহাদেশে আসার আগে আদিবাসীদের সংখ্যা ছিল ১ কোটির উপরে।

ইউরোপে মানুষ পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে সাগর বুকে নতুন দেশ খোঁজার ততটা প্রয়োজন মনে করে নি। ছোট ছোটো নৌযানের চড়ে মূল ভূখণ্ডের কাছাকাছি কিছু দ্বীপের সন্ধান পেয়েছিল। যতদূর জানা যায় নর্স অভিযাত্রী লাইফ এরিকসন এবং এরকম দুচারজন অভিযাত্রীর নাম পাওয়া যায়। তবে তাদের অভিযাত্রার ফলাফল সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

১৩৪৭ খ্রিষ্টাব্দের কনস্ট্যান্টিনোপলে প্লেগের কারণে প্রায় অর্ধেক মানুষ মারা যায়। এর পরবর্তী দেড়শ বছরে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এই বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর জন্য কিছু কিছু মানুষ আন্তদেশীয় বাণিজ্য শুরু করে। এর ফলে সাগর পথে বাণিজ্যের প্রসার ঘটতে থাকে। একই সাথে জাহাজ নির্মাণ এবং নৌবিদ্যার  ব্যাপক উন্নতি ঘটে। এই সময় পশ্চিম ইউরোপে শক্তিশালী রাজতন্ত্রের উদ্ভব হয়। এরপর একাধিক রাজতন্ত্রের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এই সময় মার্কো পলোর মতো ভূপর্যটকদের মাধ্যমে ইউরোপের মানুষ বিভিন্ন সম্পদশালী জনপদের কথা জানতে পারে। চৌদ্দ শতকে ইউরোপের কোনো রাজা বড় ধরনের সামুদ্রিক অভিযানের জন্য আর্থিক সাহায্য দেওয়া শুরু করে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে এগিয়ে গিয়েছিল পর্তুগাল। পর্তুগালের রাজার আর্থিক সাহায্যে
১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে ভাস্কো দা গামা  ভারতের কালিকট বন্দরে এসে পৌঁছেছিলেন।

বাণিজ্যিক সুবিধার বিচারে, পরতুগাল এবং স্পেনে নতুন নতুন বাণিজ্যক্ষেত্র সন্ধানের জন্য সমুদ্র অভিযানের ব্যাপক সাড়া পড়ে গিয়েছিল। এই সূত্রে 
ইতালীয় নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে উদ্যোগ নেন এবং স্পেনের রাজার আর্থিক সহায়তায় ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা আগস্ট  কলম্বাস এরপর মোট ৮৭ জন নাবিক নিয়ে অজানা সমুদ্রের পথে যাত্রা করলেন। এক্ষেত্রে তাঁকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছিলেন স্পেনের রানি ইসাবেলা। এই যাত্রা জন্য কলম্বাস তিনটি জাহাজ তৈরি করেন। এর ভিতরে সবচেয়ে বড় জাহাজ সান্তামারিয়া ছিল ১০০ টনের। অপর দুটি জাহাজ ছিল পিন্টা ৫০ টন, নিনা ৪০ টন। এই যাত্রায় কলম্বাস আমেরিকা মহাদেশের নিকটবর্তী কিছু দ্বীপের সন্ধান পান। এই নতুন মহাদেশের একটি দ্বীপের নামকরণ করেন হিস্পানিওয়ালা। এই দ্বীপে প্রথম উপনিবেশ স্থাপন করেন। কিন্তু তখনও তিনি বুঝতে পারেন নি যে, তিনি একটি নতুন মহাদেশে এসে উপস্থিত হয়েছেন। প্রথম অভিযান থেকে ফেরার সময় তিনি কিছু আদিবাসী ধরে এনেছিলেন। পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপের অধিবাসী মনে করে, তিনি এদের নামকরণ করেছিলেন ইন্ডিয়ান। কালক্রমে আমেরিকার আদিবাসীদের লালচে গায়ের রঙের বিচারে এদের নাম দাঁড়ায় 'রেড ইন্ডিয়ান'।

নানা কারণে
কলম্বাস স্পেনের রাজার বিরাগভাজন হন। ফলে তাঁর এই আবিষ্কারের সুফল তিনি পান নি। তাঁর এই কৃতিত্ব মূলত ছিনিয়ে নিয়েছিলেন ইতালির অন্য এক অভিযাত্র আমেরিগো ভেচপুচি১৫০১ খ্রিষ্টাব্দে এই অভিযাত্রী তাঁর তৃতীয় অভিযানে, দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা বরাবর সন্ধান চালান। তিনি তাঁর এই আবিষ্কার এবং কলম্বাসের আবিষ্কৃত নতুন ভূখণ্ডকে সামগ্রিকভাবে বিচার করে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি একটি 'নতুন বিশ্ব' আবিষ্কার করেছেন। এই নতুন বিশ্বের নাম 'আমেরিকা' হয়েছিল তাঁর নামানুসারেই। উল্লেখ্য, ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বেশ কিছু গবেষক এবং গ্রন্থ লেখক এই সময়ের নতুন বিশ্বের মানচিত্র-সহ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। এর ভিতরে জার্মান লেখক মার্টিন ওয়াল্ডসিমুলার একটি গ্রন্থে ভেসপুচির 'নতুন বিশ্ব-এর নামকরণ করেছিলেন 'আমেরিকা'। উল্লেখ্য, এই শব্দটি ছিল আমেরিগো ভেসপুচির 'আমেরোগো' শব্দের স্ত্রীবাচক শব্দ।

আমেরিকা মহাদেশের অধিকার লাভের জন্য পর্তুগাল ও স্পেনের ভিতর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছিল ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের শুরু থেকেই। পর্তুগিজরা বর্তমান ব্রাজিল অঞ্চলে নিজেদের অধিকার বজায় রাখতে পারলেও, দক্ষিণ আমেরিকার বাকি অংশ চলে গিয়েছিল স্পেনের হাতে।--

 

 

আমেরিকার আদিম অধিবাসীরা সম্ভবত এশীয় বংশোদ্ভুত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে এরা কয়েক হাজার বছর ধরে বসবাস করছে। তবে নেটিভ আমেরিকানদের জনসংখ্যা ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের পর থেকে মহামারী ও যুদ্ধবিগ্রহের প্রকোপে ব্যাপক হ্রাস পায়। প্রাথমিক পর্যায়ে আটলান্টিক মহাসাগর তীরস্থ উত্তর আমেরিকার তেরোটি ব্রিটিশ উপনিবেশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই এই উপনিবেশগুলি একটি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করে। এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে উপনিবেশগুলি তাঁদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ঘোষণা করে এবং একটি সমবায় সংঘের প্রতিষ্ঠা করে। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে এই বিদ্রোহী রাজ্যগুলি গ্রেট ব্রিটেনকে পরাস্ত করে। এই যুদ্ধ ছিল ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসে প্রথম সফল ঔপনিবেশিক স্বাধীনতা যুদ্ধ।[১৩] ১৭৮৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ক্যালিফোর্নিয়া কনভেনশন বর্তমান মার্কিন সংবিধানটি গ্রহণ করে। পরের বছর এই সংবিধান সাক্ষরিত হলে যুক্তরাষ্ট্র একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার সহ একক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। ১৭৯১ সালে সাক্ষরিত এবং দশটি সংবিধান সংশোধনী সম্বলিত বিল অফ রাইটস একাধিক মৌলিক নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করে।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাজ্য, মেক্সিকো ও রাশিয়ার থেকে জমি অধিগ্রহণ করে এবং টেক্সাস প্রজাতন্ত্র ও হাওয়াই প্রজাতন্ত্র অধিকার করে নেয়। ১৮৬০-এর দশকে রাজ্যসমূহের অধিকার ও দাসপ্রথার বিস্তারকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ দক্ষিণাঞ্চল ও শিল্পোন্নত উত্তরাঞ্চলের বিবাদ এক গৃহযুদ্ধের জন্ম দেয়। উত্তরাঞ্চলের বিজয়ের ফলে দেশের চিরস্থায়ী বিভাজন রোধ করা সম্ভব হয়। এরপরই যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা আইনত রদ করা হয়। ১৮৭০-এর দশকেই মার্কিন অর্থনীতি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির শিরোপা পায়।[১৪] স্পেন-মার্কিন যুদ্ধ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সামরিক শক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠা দান করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দেশ প্রথম পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং রাষ্ট্রসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করে। ঠান্ডা যুদ্ধের শেষভাগে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একমাত্র মহাশক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বিশ্বের মোট সামরিক ব্যয়ের দুই-পঞ্চমাংশ খরচ করে এই দেশ। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিধর রাষ্ট্র।[১৫] ১৯৩০ এর দশকে ও একবিংশ শতকের প্রথম দশকের শেষে আমেরিকার অর্থনীতি 'অর্থনেতিক মহামন্দা' বা 'গ্রেট ডিপ্রেশন'র স্বীকার হয়।