বাংলা আ-এর উচ্চারণ
ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষা পরিবার-এর ক্রমবিবর্তনের ধারায়, ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে যখন স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা'র উদ্ভব হয়ে. তখন শব্দরূপের নানা পরিবর্তন ঘটে। এই বিবর্তনের ধারায় বাংলা বর্ণের ধ্বনি রূপেরও নানা পরিবর্তন ঘটে।

উচ্চারণ: 'অ'= a
আন্তর্জাতিক ধ্বনিলিপিতে আ-কারচিহ্ন হিসাবে ব্যঞ্জনবর্ণের ডান পাশে a বর্ণটি ব্যবহার করা হয়। যেমন- কা=ka

আ-এর উচ্চারণ
এটি মৌলিক স্বরধ্বনি। এর উচ্চারণ স্থান কণ্ঠ। এর উচ্চারণ দীর্ঘ ও বিবৃত। এই বর্ণটি ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে যুক্ত হলে া ' -রূপ লাভ করে। এই রূপটির উচ্চারণ হবে আকার। ধ্বনিতত্ত্বের বিচারে এটি বিবৃত। এটি উচ্চারণের সময় ঠোঁট দুটো অর্ধ -বিবৃত অ-এর চেয়ে একটু বেশি প্রসারিত হয়। সংস্কৃত ব্যাকরণে অ-এর দীর্ঘরূপ হিসাবে আ-ধ্বনিকে বিবেচনা করা হয়েছে। ডান পাশের চিত্রে আ উচ্চারণে জিহ্বার অবস্থান দেখানো হলো। 

আ এর হ্রস্ব ও দীর্ঘ উচ্চারণরূপ বাংলাতে আছে,তবে তা লিপি দ্বারা চিহ্নিত করার বিধান নেই। সে কারণে, একই আ- ধ্বনি ব্যক্তি বিশেষের উচ্চারণে হ্রস্ব বা দীর্ঘ মান লাভ করে। আবার আ ধ্বনিটির দ্বারা বিশালত্ব, ছোট বা মৃদুর বিপরীত অর্থ হিসাবে, অনেকেই পর্যাপ্ত উদাহরণ টেনেছেন।

ঠোঁট দুটো অর্ধ-বিবৃত অ-এর চেয়ে একটু বেশি প্রসারিত


রবীন্দ্রনাথ ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী আ ধ্বনির বিশালত্বের পর্যাপ্ত উদাহরণ টেনেছেন অর্থের বিচারে। ধ্বনির বিচারে ওই সকল আ যে দীর্ঘই হবে,তার কোন কারণ নেই। যেমন- আসমুদ্রহিমাচল শব্দটি। এখানে আ ধ্বনিটি দীর্ঘ উচ্চারণ করলে, বিস্তীর্ণ বা বিশালত্বকে প্রকাশ করে। এরূপ হতে পারে আপাদমস্তক। ব্রজবুলিতে আ-যুক্ত ক্রিয়াপদে আ ধ্বনিটি দীর্ঘ না করলে, তার স্বমহিমা হারায়। যেমন- আইল শব্দটি ব্রজবুলিতে আ দীর্ঘ না করলে, তা ঢাকাইয়া উচ্চারণের মতো শোনায়। বাংলা বর্ণমালায় দীর্ঘ আ প্রকাশের কোন প্রতীক নেই। আন্তর্জাতিক ধ্বনিলিপি অনুসারে এর চিহ্ন হবে-a। এই বর্ণটি গ্রহণের ব্যাপারে কারো দ্বিমত পাওয়া যায় না।

যৌগিক স্বরধ্বনি সৃষ্টিতে আ- ধ্বনির পরিবর্তন
যখন আ ধ্বনির পূর্বে বা পরে অন্য স্বরধ্বনি উচ্চারিত হয়, তখন উভয় ধ্বনি মিলে একটি যৌগিক স্বরধ্বনি উৎপন্ন করে। আদ্য আ ধ্বনির পরে অন্য স্বরধ্বনি থাকলে জিহ্বার অবস্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে স্বরধ্বনি একটি বিশেষ ধ্বনি বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে, তার নমুনা পাশের চিত্রে দেখানো হলো।

মূলস্বর : আ

১। আ-ই : যেমন- খাই (খ্ + আ + ই)
২। আ-উ : যেমন- দাউ (দাউ দাউ) (দ্ + আ + উ)
৩। আ-এ : যেমন- গায়্ (গ্ + আ + এ)
৪। আ-ও : যেমন- খাও  (খ্ + আ + ও)

আ-ধ্বনি যুক্ত যৌগিক স্বরধ্বনির তালিকা
 
অআ অআ বআ আয়ো আয়োন আয়োজন
অইয়া   ওইআ    খইয়া  আয়্যা আয়এ্যা মায়এ্যা
অউয়া ওউ আমউয়া (মোউয়া) ইআ ইআ খিআতি
অওয়া অওআ সওয়া (শওয়া) ইওয়াই ইওআ দিওয়ালী
অয়া অয় আদয়া ইয়া ইআ প্রিয়া
আআ আআ কাআ ইয়াই ইআই বিয়াই
আই আই গাই ইয়াইআ ইয়াইআ পিয়াইয়া
আইও আইও আইও উআ উআ গুআ
আইয় আইও নাইয়র উইঞা উইআঁ ভুইঞা
আইয়া আইআ নাইয়া উওয়া  উওআ চুওয়াল
আইয়ে আইএ গাইয়ে উঁইয়া উঁইআ ভূঁইয়া
আউ আউ ঝাউ উঞা উআঁ ভুঞা
আউই আউই তাউই উয়া উআ জুয়া
আউও আউও আউওল উয়ায় উআয় যুয়ায়
আউয়া আউয়া কাউয়া এআ এআ লেআ
আএ আএ সাএল এইয়া এইআ ডেইয়া
আও আও খাও এউয়া এউআ ডেউয়া
আওই আওই তাওই এওয়া এওআ দেওয়া
আওয়া আওআ ছাওয়া এওয়ায় এওআঅ রেওয়ায়ত
আওয়ি আওই চাওয়ি   এ্যাওআ দেওয়া (দ্যাওয়া)
আয় আয়্ আয় এয়া এআ খেয়া
আয় আঅ পায়স এয়াই এআই নেয়াই
  আয়ো আয়তী (আয়োতি) ওআ ওআ কোআ
আয়ই আওই পায়ই (পায়োই) ওইয়া ওইআ তৈয়ার
আয়ওয়া হায়ওয়ান হায়ওয়ান ওইয়াই ওইআই নৈয়ায়িক
আয়া আয়া আয়া ওউয়া  ওউআ  চৌয়ারি 
আয়ি আ-ই কায়িক ওওয়া  ওওআ  ধোওয়া (ধোওআ) 
আয়ু আয়ু আয়ু ওয়া ওআ মোয়া
আয়ে আয়ে আয়েশ ওয়াই ওআই খোয়াই

ব্যবহারিক ক্ষেত্রের বিচারে আ
ধ্বনির পরিবর্তন

আদি স্বরাগম :       স্টেবল>আস্তাবল, স্পর্ধা>আস্পর্ধা ইত্যাদি।
মধ্য স্বরাগম :        আ-এর আগম।দিশ্>দিশা, মিশ্>মিশা ইত্যাদি।
অন্ত্য স্বরালোপ :    আশা>আশ, সঞ্ঝা>সাঁঝ
অভিশ্রুতি :           অ +ই +আ>অ=ও+এ        চলিয়া>চইলা>চলে
                        অ +আই +আ>ও               বলাইয়া>বলিয়ে>বলে
                        অ +ইআ +ই>অ=ও+এ+ই  করিয়াছি>করেছি
                        অ +উ+আ>অ=ও +ও        জলুয়া>জলো
                        আ +অ +ইআ>উ +এ         কান্দনিয়া>কাইন্দয়া>কাঁদুনে
                        আ +ই +অ>এ+ও             আইহঅ (অবিধবা>অবিহবা)>আইহ>আইঅ>আয়্য>এও
                        আ +ই +ও>এ+ও             রাখিহ>রাখিঅ>রাইখো>রেখো
                        আ +ই +আ>এ+এ            আসিয়া>আইস্যা>এসে
                        আ +আই +আ>এ              নাচাইয়া>নাআইচা>নেচে
                        আ +উ +আ>এ +ও           সাথুয়া>সাউথুআ>সাইথুয়া>সেথো
                        ই +অ +ইআ>উ+এ           শিখনিয়া>শিখুনে
                        উ +অ +ইআ>উ +উ+এ     জুড়নিয়া>জুড়ুনে
                        ও +অ +ইআ>উ +উ এ       কোন্দলিয়া>কুঁদুলে।
অ- শ্রুতি ও ব-শ্রুতি :  যা + আ =যাআ>যাওয়া,না +আ =নাআ>নাওয়া ইত্যাদি।
অসমীকরণে আ ধ্বনি : ধপ +ধপ =ধপাধাপ,টপ্ +টপ্>টপাটপ ইত্যাদি।

সন্ধির বিচারে আ- বানান পরিবর্তন রীতি

সংস্কৃত স্বরসন্ধিতে পরিবর্তিত আ বর্ণ।

অ + অ =আ
অ + আ =আ
আ + অ =আ
আ + আ =আ
আ + ই =এ
আ + ঈ =এ
আ + উ =ও
আ + ঊ =ও
আ + ঋ =অর্
আ + ঋত =আর্ত
আ + এ =ঐ
আ + ঐ =ঐ
আ + ও =ঔ
আ + ঔ =ঔ
ই + আ =‌‌অ্যা
ঈ + আ =‌‌অ্যা
উ + আ =বা (আ)
ঋ + আ =র্আ
ও + আ =অবা
নব + অন্ন =নবান্ন
হিম + আলয় =হিমালয়
আশা + অতিরিক্ত =আশাতিরিক্ত
বিদ্যা + আলয় =বিদ্যালয়
যথা + ইষ্ট =যথেষ্ট
রমা + ঈশ =রমেশ
মহা + উদয় =মহোদয়
মহা + ঊর্মি =মহোর্মি
মহা+ ঋষি =মহর্ষি
তৃষ্ণা +ঋত=তৃষ্ণার্ত
সদা + এব =সদৈব
মহা + ঐশ্বর্য্য =মহৈশ্বর্য্য
মহা + ওষধি =মহৌষধি
মহা + ঔষধ =মহৌষধ
অতি + আচার =অত্যাচার
মসী + আধার =মস্যাধার
সু + আগত =স্বাগত
পিতৃ + আলয় =পিত্রালয়
গো +আদি =গবাদি
 

সংস্কৃত ব্যঞ্জনসন্ধিতে পরিবর্তিত আ ধ্বনি ।

আ + ছ =আচ্ছ          আ +ছন্ন =আচ্ছন্ন
ঃ + আ =র্+আ>রা     নিঃ +আকার =নিরাকার ।
ট্ + আ =ড়              ষট্ +আনন =ষড়ানন
 

সংস্কৃত বিসর্গসন্ধিতে পরিবর্তিত আ বর্ণ

অঃ +আ =অআ    মনঃ +আশা =মন-আশা
আঃ +ক =স্ক       ভাঃ + কর =ভাস্কর

নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধি

আ +চর্য =আশ্চর্য       আ +পদ =আস্পদ

বাংলা স্বরসন্ধিতে পরিবর্তিত আ বর্ণ

অ + অ =আ       পোস্ট +অফিস =পোস্টাফিস
অ + আ =আ      থাল + আ =থালা
আ + আ =আ     শাঁখা + আরি =শাঁখারি
আ + ই =এ       যা + ইচ্ছেতাই =যাচ্ছেতাই
আ + ঈ =এ       ঢাকা + ঈশ্বর =ঢাকেশ্বর
আ + উ =উ       মিথ্যা + উক =মিথু্যক
আ + এ =য়       আমা + এ =আমায়
উ + আ = য়া     বাবু + আনা = বাবুয়ানা
এ + আ = এ     মেয়ে + আলি = মেয়েলি
ও + আ =য়া      শো + আ = শোয়া

সূত্র :
  • ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব মুহম্মদ আবদুল হাই রচনাবলী প্রথম খণ্ড। বাংলা একাডেমী ঢাকা। আষাঢ় ১৪০১/জুন ১৯৯৪।
  • ব্যাবহারিক বাংলা উচ্চারণ অভিধান। আনিসুজ্জামান, ওয়াহিদুল হক, জামিল চৌধুরী, নরেন বিশ্বাস। জাতীয় গণমাধ্যম ইনসটিটিউট। ৮ ফাল্গুন ১৩৯৪
  • ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। রূপম। মে ১৯৮৯।
  • সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা। ডঃ রামেশ্বর শ'। পুস্তক বিপণি। ৮ই ফাল্গুন, ১৩৯৪/২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮।