তৎকালীন পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি অঞ্চলে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। দিনাজপুর ও রংপুর জেলায় এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। এই কারণে তেভাগা আন্দোলনকে দিনাজপুর ও রংপুর জেলার আন্দোলন হিসেবেই অধিক পরিচিতি লাভ করেছে। অন্যান্য যে সকল জেলায় এর উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল, সেগুলো হলো পাবনা, ঢাকা, হাওড়া, হুগলি, নদীয়া, মালদহ, রাজশাহী। আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল, হিন্দু-মুসলমান এবং অত্র অঞ্চলের বাঙালি এবং আদিবাসীরা। আন্দোলনের সূত্রে নিহত হয়েছিল প্রায় ৮৬ জন, আহত হয়েছিল প্রায় ১০ হাজার এবং কারারুদ্ধ হয়েছিল প্রায় ৩ হাজার।
তেভাগা আন্দোলনের সূত্রপাত ও পূর্বের ফসল-বণ্টন প্রথা
বঙ্গদেশের কৃষকরাই এক সময় সকল ভূমির মালিক ছিল। বিভিন্ন রাজাদের দ্বারা শাসিত বঙ্গদেশে
কৃষকরা সরাসরি জমিদারদের রাজস্ব দিত। কালক্রমে, অভিজাত শ্রেণির লোকেরা রাজানুগ্রহে
কিছু জমির মালিক হলে, কৃষকরা তাদের জমি চাষের বিনিময়ে পারশ্রমিক বা ফসল নিতো। সে
সময়ে ফসলের হিসাব নিয়ে যে খুব বেশি দ্বন্দ্ব ছিল, তেমন উদাহরণ পাওয়া যায় না। মোগল আমলে
সকল জমির খাজনা মালিকরাই দিতো। এই সময় বর্গাচাষীরা এক তৃতীয়াংশ বা কখনো কখনো তার
চেয়েও কম ফসল মালিককে বা স্থানীয় শাসনকর্তার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে প্রদান করতো।
ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি'র শাসনামলে খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে গভর্নর জেনারেল
ওয়ারেন হেস্টিংস প্রথমবারের মতো পাঁচশালা এবং দুই বৎসর মেয়াদী ভূমি ইজারা পদ্ধতি
চালু করেন। ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যাণ্ডের মতো করে, দশশালা বন্দোবস্ত চালু করেন। এই
সূত্রে
১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তিত হয়। এই সময় জমির মালিকানা
চলে যায় জমিদারদের হাতে। এই আইনে জমিদাররা জমির পরিমাণ ও উর্বরতা অনুযায়ী
বৃটিশদের খাজনা দিত। জমিদাররা তাদের অধিকারভুক্ত জমি স্থানীয় কৃষকদের কাছে
শর্তানুসারে বণ্টন করতো। এই প্রথায় উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক অংশ কৃষকরা স্থানীয়
জমিদারকে খাজনা হিসেবে প্রদান করতো। এই ব্যবস্থার চাষকে বলা হতো আধি বা আধিয়ার।
এক্ষেত্রে ফসল উৎপাদনের খরচ কৃষক না জমিদার কিভাবে নির্বাহ করবে, তা অঞ্চলভেদে
ভিন্ন ভিন্ন ছিল। তবে অধিকাংশ অঞ্চলে কৃষকই উৎপাদনের ব্যয়ভার বহন করতো। কখনো কখনো
সহৃদয় জমিদার কৃষককে কিছু সাহায্য করতো। আধিয়ারের তালিকায় ছিল বিপুল পরিমাণ কৃষক।
এরা যে পরিমাণ ফসল ফলাতো, তাদের ভাগের অর্ধেক ফসল দিয়ে সংসারের সাংবাৎসরিক প্রয়োজন
মিটতো না। কোনো বৎসর ফসল উৎপাদন না হলেও জমিদারকে খাজনা দিতেই হতো। প্রথম দিকে
খাজনা আদায়ের জন্য জমিদাররা ততটা নিষ্ঠুর হয়ে উঠে নি। তবে খাজনা আদায়ের সুবিধার
জন্য এরা বড় বড় এলাকা কিছু জোতদারকে প্রদান করে এবং তাদের খাজনা আদায়ের অধিকার দেয়।
ফলে মধ্যসত্বভোগী জোতদাররা খাজনা আদায় শুরু করে। কালক্রমে এরা একটি নিষ্ঠুর শ্রেণির
খাজনা ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়।
তবে কোম্পানি আইনে
প্রজাদের উপর এই বলপ্রয়োগ করা যেতো না। এই কারণে জমিদার বা জোতদাররা তখনও প্রজাদের
উপর যথেচ্ছাচার থেকে কিছুটা বিরত থাকতো। এই অবস্থায় এরা প্রজাদের উপর অধিকতর
কর্তৃত্ব লাভের জন্য আইন করার জন্য চেষ্টা করতে থাকে। এরই ফলে, ১৭৯৫ ও ১৭৯৯
খ্রিষ্টাব্দের দুটি রেগুলেশনে প্রজাদের উপর খাজনা আদায়ের জন্য দৈহিক নির্যাতনেরও
অধিকার লাভ করে। এই সময় বাংলার কৃষক সম্প্রদায় পুরোপুরি স্থানীয় জমিদার ও জোতদারদের
দাসে পরিণত হয়।
ভারতীয় কৃষক সমিতি ও
তেভাগা আন্দোলন
এরপর দীর্ঘসময় ধরে বাংলার অধিকাংশ কৃষকরা দাস শ্রেণিতে পরিণত হয়। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ
পর্যন্ত জমিদার ও জোতদাররা একটি নিষ্ঠুর শোষকদলে পরিণত হয়।
এই অবস্থার ভিতর দিয়ে কৃষকদের ভিতরে যে দীর্ঘদিনের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল, তারই
ভিত্তিতে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত হয় 'সর্ব ভারতীয় কৃষক সমিতি'। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে
এই সমিতির উদ্যোগে কৃষকসভা হয় এবং এরপর থেকে কৃষকদের ক্ষোভ সাংগঠনিক রূপ লাভ করতে
থাকে। এই বৎসরেই ব্রিটিশ সরকার রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে থাকে। এই সকল
রাজনৈতিক কর্মীদের অধিকাংশই জেলে মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল। ফলে জেলের বাইরে
এসে এরা মার্কসবাদের আদর্শে কৃষকদের সমস্যাকে চিহ্নিত করা শুরু করে। এরা জেল থেকে
বেরিয়ে গ্রামগঞ্জে কৃষকদের সংগঠিত করতে থাকে। এদের প্রভাবেই ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে
ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা মন্ত্রীসভা প্রজাস্বার্থে বঙ্গীয়স্বত্ব আইনের সংশোধনী আনে।
কিন্তু সে সময়ের কংগ্রেসী এবং মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতাদের তৎপরতায় এই সংশোধনী
দ্রুত আইনে পরিণত হতে পারে নি। কিন্তু মার্কসবাদীদের ব্যাপক তৎপরতায় উত্তর, পশ্চিম
এবং পূর্ববঙ্গের কৃষকর সুসংগঠিত হয়ে উঠে। এরা দিনাজপুরের কিছু এলাকাকে 'কৃষক
সমিতি'র এলাকা হিসেবে নির্ধারিত করে। তবে এক্ষেত্রে এরা জমিদার ও জোতদারদের সাথে
সংঘর্ষ এড়িয়ে কাজটি করে। এই কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করার জন্য, ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের
ফেব্রুয়ারি মাসে ফুলবাড়ি থানার লালপুরডাঙায় প্রায় ৩ হাজার কৃষকের উপস্থিতিতে একটি
কৃষক সম্মেলন করে। এই অধিবেশনে তৎকালীন কমিউনিষ্ট পার্টির অন্যতম নেতা কমরেড
মুজফ্ফর আহম্মদ ও কমিউনিষ্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটির নেতা বঙ্কিম মুখার্জি
উপস্থিত ছিলেন। কৃষক প্রজা পার্টির পক্ষ থেকে ছিলেন কিশোরগঞ্জের এমএলএ আব্দুল
ওয়াগার বোকাইনগরী ও রংপুরের দিনেশ লাহিড়ি। এই সম্মেলনের পর, দিনাজপুর জেলা কৃষক
সমিতির সদস্যরা ১৬ দফার দাবিসম্বলিত একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে। এই দাবিগুলো ছিল‒
১. বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করো
২. নিলামি জমি কৃষককে ফেরত দাও
৩. হাটেবাজারে তোলাবাটির জুলুম বন্ধ করো।
৪. সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল করো।
৫. লাঙ্গল যার জমি তার।
৬. কৃষকের সকল ঋণ মওকুফ করো।
৭. বেগার প্রথা বন্ধ করো।
৮. জোতদারদের জুলুম চলবে না।
৯. কর্জা ধানের সুদ নাই।
১০. সকল প্রকার আবহাওয়া বন্ধ করো।
১১. কোনো সেলামি নেওয়া চলবে না।
১২. জমি থেকে প্রজা উচ্ছেদ বন্ধ করো।
১৩. আধিয়ারকে নিজ খামারে ধান তুলতে দিতে হবে।
১৪. ইউনিয়ন বোর্ডে মনোয়ন প্রথা বাতিল করো।
১৫. গরিব কৃষকদের চৌকিদারি ট্যাক্স বন্ধ করো।
১৬. খাবার পানির পাকা ইন্দারা গরিব পাড়ায় বসাতে হবে।
দিনাজপুর কৃষক সমিতির
এই দাবিপত্র ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। এর ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষুব্ধ কৃষকরা কৃষক
সমিতির সাথে যোগাযোগ করে। এই সময় আটওয়ারি থেকে কৃষক রাজেন সিং, রামলাল সিং, পাথাল
সিং ও ডিলুরাম সিং প্রথম কৃষক সমিতিতে সাগ্রহে যোগাদান করেন। এই সময় কৃষক সমিতির
পক্ষে বিশেষভাবে কাজ করেন বিভূতি গুহ, কালী সরকার, সুশীল সেন, বসন্ত চট্টোপাধ্যায়,
ননী সরকার, জনার্দন ভট্টাচার্য, অজিত রায়, মাধব দত্ত, গুরুদাস তালুকদার প্রমুখ।
এই সময় উত্তরবঙ্গে দিনাজপুর কৃষক সমিতি কেন্দ্রীয় শক্তিতে পরিণত হয়। এই সমিতি
জমিদার জোতদারদের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক সংগ্রাম গড়ে তোলার ডাক দেয়। এই আন্দোলনের প্রথম
বাস্তব প্রতিবাদ ঘটে আটওয়রিতে। আটওয়ারি ১ নম্বর শিবরামপুর ইউনিয়নের কালী জোতদার
একজন কৃষককের উপর দৈহিক নির্যাতন চালালে, রামলাল বাঁধাল ও ডুলিরাম সিং-এর নেতৃত্বে
কৃষকরা কালী জোতদারের বাড়ি ঘেরাও করে। কালী জোতদারের অনুরোধে স্থানীয় থানা থেকে
পুলিশ এসে কয়েকজন কৃষককে ধরে নিয়ে হাজতে পাঠায়। এরপর আরও বহু কৃষক এসে থানার সামনে
এসে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির দাবি করে এবং কালী জোতদারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে
থাকে। শেষ পর্যন্ত জামিনে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দেওয়া হয় এবং কালী জোতদার
ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। এই ঘটনার পর আশপাশের সকল সকল ইউনিয়নের কৃষকরা কৃষক
সমিতিতে যোগদান করে এবং আটওয়ারি-সহ অন্যান্য অঞ্চলে কৃষক সমিতির শাখা প্রতিষ্ঠিত
হয়। সে সময় এই অঞ্চলের নেতৃত্ব দেন কম্পরাম সিং, স্পষ্টরাম, রিনেসাদ দাস, আমিরচাঁদ,
রূপনারায়ায়ণ রায়, শেখ খবিররুদ্দিন প্রমুখ।
আটওয়ারির এই প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে, সকল শ্রেণির কৃষক স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসে। কৃষকদের এই উদ্যমকে কাজে লাগিয়ে কৃষক সমিতি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে। এক ঠাকুরগাঁও মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় সাতশত সদস্যের স্বচ্ছাসেবক কর্মীর বাহিনী গঠিত হয়েছিল। এদের অস্ত্র ছিল লাঠি। দিনাজপুরের কৃষক সমিতি তেভাগা আন্দোলনে নব জোয়ার আনলেও সাংগঠনিক দিক থেকে অন্যান্য এলাকা থেকে সুদৃঢ় অবস্থানে ছিল না। ফলে দিনাজপুরের লাঠিয়াল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীই আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে সম্মানজনক অবস্থানে ছিল। বীরগঞ্জ অঞ্চলে স্থানীয় জমিদাররা অবৈধভাবে হাট এবং মেলাতে 'লেখাই' এবং 'তোলা' তুলতো। উল্লেখ্য, ব্যাপরিরা যখন বিক্রয়ের জন্য হাটে আনা গরু, ছাগল, মহিষ আনতো, তখন জমিদারের লোকেরা ওই প্রাণীগুলো যে চোরাই নয় এই ছাড়পত্র দিত। এক্ষেত্রে হাটে ওই পশুগুলো বিক্রয়ের আগে উচ্চ মূল্য প্রদান করে জমিদারের খাতায় ব্যাপারির নাম এবং পশুর বিবরণ লিখতে হতো। এই লেখার কাজটিকে বলা হতো 'লেখাই'। অন্যদিকে বাজারে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জমিদারের লোকেরা ইচ্ছা মতো চাঁদা তুলতো। এতে যে সকল ব্যবসায়ী রাজি হতো না, তাদের পণ্য হাটে বিক্রয় করতে দেওয়া হতো না। অনেক সময় তাদের মালামাল বাজেয়াপ্ত করা হতো। বীরগঞ্জের স্বেসবক বাহিনী হাটে 'লেখাই' এবং 'তোলা' বন্ধ করে দেয়। এরপর অন্যান্য স্থানেও এই পদ্ধতি বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া কৃষক সমিতি জমিদারের হাট বর্জন করে, অনেক জায়গায় নিজেদের হাট বসায়। এসব হাটের নাম দেওয়া হয় 'সমিতির হাট'। 'লেখাই' ও 'তোলা' উঠানো বন্ধ এবং 'সমিতির হাট' গড়ে তোলার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সত্যেন রায়, হাজি দানেশ, সুনীল সেন, কানা সরকার কম্পমান সিং প্রমুখ। এই আন্দোলনের জন্য কম্পমান সিংকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এর ফলে এই আন্দোলন আরও ব্যাপকভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।
এই অবস্থায় জমিদাররা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের শরণাপন্ন হয়। কৃষকের আন্দোলন এবং জমিদারদের চাপের মুখে জেলা প্রশাসক কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে, যার অনেকটাই কৃষক সমিতির পক্ষে গিয়েছিল। এই বিষয়ে জেলা প্রশাসকের বিধিগুলো ছিল
এই জাতীয় সাফল্য লাভের
পর, কৃষকরা কমিউনিষ্ট পার্টির সাথে আলোচনা করে, নতুন আন্দোলন ঘোষণা করে। এই
আন্দোলনকে বলা হয়ে থাকে 'নিজ খেলানে ধান' এবং 'সুদ বন্ধ' আন্দোলন। আগে জমির ফসল
তোলা হতো জমিদার বা জোতদারদের গোলায়। সেখান থেকে ইচ্ছা মাফিক কৃষকদের ফসলের ভাগ
দেওয়া হতো। এক্ষেত্রে জমিদাররা গোলা পরিষ্কার করা, ধান মাপা, ধান পরিষ্কারের
অজুহাতে কৃষকে ফসল কম দিত।
এই আন্দোলনে দাবি করা হয় কৃষকরা নিজেদের গোলায় আগে ফসল তুলবে এবং সেখান থেকে
প্রাপ্য ফসল জমিদারকে দেওয়া হবে। এছাড়া কর্জ হিসেবে নেওয়া ধানের উপর সুদ নেওয়া যাবে
না, এই দাবিই একই সাথে তোলা হয়েছিল। কৃষক সমিতি এবং কমিউনিষ্ট পার্টি এই আন্দোনের
সময় নির্ধারণ করেছিল ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ধানকাটা মৌসুমে। এই কার্যক্রম শুরু হলে,
জমিদার ও জোতদাররা বিভিন্ন কৃষকদের বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় অভিযোগ পেশ করে। যদিও এই
অভিযোগুলোর কোনো বৈধতা ছিল না। কিন্তু জমিদারদের আশীর্বাদপুষ্ট থানার কর্মকর্তারা
এসব অভিযোগ গ্রহণ করে অনেককে গ্রেফতার করে। এই সময় ঠাকুর গাঁয়ের কেরামত আলি,
মতিবাবু ও আজিরুদ্দিন কৃষকদের পক্ষে বিনা পারিশ্রমিকে আদালতে মামলা চালান। প্রাথমিক
ধাক্কা কেটে যাওয়ার পর, কৃষকরা নতুনভাবে সংগঠিত হতে থাকে। এর ফলে সরকার একটি
শান্তিপূর্ণ মীমাংশার জন্য উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনার ব্যবস্থা করে। এই সূত্রে
ঠাকুরগাঁও ঈদগাহ মাঠে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রায় দশ হাজার কৃষক এবং
স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা যোগদান করে। এই সভায় কৃষক সমিতির পক্ষে প্রতিনিধিত্ব
করেন হাজি দানেশ ও সত্যেন রায়। জমিদার ও জোতদারদের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন কাজি
কেরামত আলি। আর প্রশাসনের পক্ষে থাকেন তৎকালীন ঠাকুর গাঁও মহকুমার প্রশাসক আলতাফুর
রহমান এবং তাঁর ডেপুটি। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন পুলিশ ইনস্পেক্টর। নানা রকম নানা
আলোচনার পরে যে সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, তার উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত ছিল
এই সভার সিদ্ধান্ত পরে, প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ, জোতদারদের প্রতিনিধি এবং কৃষক সমিতির প্রতিনিধির স্বাক্ষরযুক্ত হয়ে ছাপানো হয়।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই নভেম্বর ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা মন্ত্রীসভা বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য, একটি সুপারিশমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল। এই সুপারিশমালা প্রণয়নে দায়িত্ব নিয়েছিলেন স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউড। এই কমিশনের রিপোর্ট উপস্থাপিত হয় ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে মার্চ। দুই খণ্ডে দাখিল করা এই রিপোর্টে কয়েকটি সংস্কারের প্রস্তাব রাখা হয়। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবগুলো ছিল‒
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ও ৯ই জুন যশোহর জেলার পাজিয়ায় কৃষকসভার প্রাদেশিক সম্মেলন হয়। এই সভার চতুর্থ অধিবেশনে ফ্লাউড কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে দুই-তৃতীয়াংশ ফসল আদায়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। আর এই ডাক থেকেই শুরু হয় মূল 'তেভাগা আন্দোলন।' তবে এর চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে কৃষক সভার নেতৃত্বে। ১৯৪৬-৪৭ খ্রিষ্টাব্দকে যদিও তেভাগা আন্দোলনের সময় সীমা বলা হয়, কিন্তু বাস্তবে এই সময়টি হলো এই আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্বে ক্রমান্বয়ে কৃষকের অধিকারের অনেকটাই পূরিত হয়েছিল কিন্তু চূড়ান্ত জয় পাওয়ার জন্য এই আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছিল। এবারের দাবির মূল বিষয়গুলো ছিল‒
এই দাবির সূত্রে অখণ্ড বঙ্গদেশের সকল জেলাতেই বিপুল সাড়া মেলে। তবে প্রতিরোধের আন্দোলন তীব্রভাবে জ্বলে উঠে সে সময়ের কয়েকটি জেলাতে। এইউ জেলগুলো হলো- চট্টগ্রাম, চব্বিশ পরগনা, জলপাইগুড়ি, ঢাকা, ত্রিপুরা (কুমিল্লা), দিনাজপুর, নদীয়া, নোয়াখালি, পাবনা, ফরিদপুর, বর্ধমান, বাঁকুড়া, বাখেরগঞ্জ (বরিশাল), বীরভূম, ময়মনসিংহ, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর, যশোহর, রংপুর, রাজশাহী, হাওড়া ও হুগলি।
এই আন্দোলনে অনেক জায়গায় কৃষকরা রাস্তায় নেমে মিছিল ও শ্লোগানে জমিদার জোতদারদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে থাকে। এই সময়ের কয়েকটি বহুল ব্যবহৃত শ্লোগান ছিল-
কৃষকদের আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য, জোতদাররা তাদের নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী এবং পুলিশ ব্যবহার করা শুরু করে। এক্ষেত্রে কৃষক সমিতির সদস্যরা জোতদারদের এসব বাহিনীর উপর নজরদারি করতো। কোনো এলাকায় এদের দেখা গেলে, কাঁসার ঘণ্টা বাজিয়ে সকলে সতর্ক করে দিত। ধান তোলার মৌসুমে, কৃষকদের প্রতিরোধে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জোতদারদের বাহিনী পিছু হটতো। এই সময়, জমিদাররা হিন্দু মুসলমানের বিভেদ তৈরি করে আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টা করে। কিন্তু এরা ততটা সাফল্য লাভ করতে পারে নি। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারিতে জোতদারদের বাহিনীর হাতে শিবরাম এবং সমিরুদ্দিন প্রাণ হারায়। এরকম অনেক জায়গাতেই দরিদ্র হিন্দু-মুসলমান কৃষকরা অত্যাচারিত হয়। এই বৎসরের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত বিভাজন প্রায় সুনিশ্চিত হয়ে যায়। এই সময় বাংলার মুসলিম লীগ সরকার এই আন্দোলনকে হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে। মার্চ মাসের ভিতরে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই বুঝে উঠতে পারে নি যে, তারা কোন রাষ্ট্রের অধীনস্থ হবে। যে আন্দোলন করে এরা ভূমির উপর অধিকার অর্জনের চেষ্টা করছে, তা শেষ পর্যন্ত নিজের অধিকারে থাকবে নাকি নিজ ভূমি থেকে বিতারিত হবে। ফলে কৃষকরা তেভাগা আন্দোলনের চেয়ে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠে দেশ বিভাজনের বিষয়ে।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই এপ্রিল বিধানসভায় বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন উত্থাপন করা হয়। তবে ভারত বিভাগের কারণে এ বিষয়ে আর কোন অগ্রগতি হয় নি। বিলটির মাধ্যমে বর্গা প্রথা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। দেশবিভাগ এবং নতুন সরকারের অঙ্গীকার এ আন্দোলনকে সাময়িকভাবে স্থবির করে দেয়। তেভাগা আন্দোলন সফল হওয়ার ফলে শতকরা ৪০ ভাগ বর্গাচাষি ভূমিমালিকদের কাছ থেকে স্বেচ্ছায় তেভাগা প্রাপ্ত হন। এ আন্দোলনের ফলে, বলপূর্বক অর্থ আদায় বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৪৮-৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পূর্ব-পাকিস্তানে তেভাগা আন্দোলন ভিন্নরূপে প্রকাশিত হয়েছিল। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এ আন্দোলনকে ভারতীয় দালালদের আন্দোলন হিসেবে প্রচার করে। সাধারণ মানুষের একটি অংশ এটা বিশ্বাস করে, এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ থেকে নিজেদের বিরত রাখে। তব্দে এই আন্দোলনটি ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত 'পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন '- প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
সূত্র :
বাংলা বিশ্বকোষ। প্রথম খণ্ড। নওরোজ কিতাবিস্তান। ডিসেম্বর, ১৯৭২।
http://en.wikipedia.org/wiki/Anti-Comintern_Pact