ভারতীয় আর্যদের দ্বারা চর্চিত সঙ্গীত।
[পূর্বপাঠ:
ভারতীয় সঙ্গীত]
[প্রাসঙ্গিক পাঠ:
সাম গান
]
ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষাগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ নৃগোষ্ঠীর একটি শাখা হলো-
ভারতীয়
আর্য জাতি। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৫০০ অব্দের
ভিতরে পারশ্য থেকে ভারতে প্রবেশ করেছিল আর্য ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠী। আদিতে ইরানীয় আর্য
এবং ভারতীয় আর্যদের ভাষা, ধর্ম, সঙ্গীত ইত্যদির ভিতরে কোনো প্রভেদ ছিল না।
ভারতে প্রবেশের পর ভারতীয়
আর্যরা, স্থানীয় ভারতীয় মিশ্র জাতি সত্তার মুখোমুখী হয় এবং নিজেদের স্থায়ী বসতি
স্থাপনের জন্য যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হয়। জাত্যাভিমানে তারা স্থানীয় অধিবাসীদের
তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো। অনেকে অস্পৃশ্য বলে স্থানীয়দের সাথে মেলামেশা করতো না।
রাজন্যবর্গ বা পুরোহিতরা এসব কঠোরভাবে মান্য করলেও সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তেমনটা
ঘটেনি। স্থানীয় অনার্যদের সংস্পর্শে এসে এদের বিরাট একটি অংশ, মিশ্র ভাষা-সংস্কৃতির
উদ্ভব ঘটিয়েছিল। বলাই বহুল্য রাজন্যবর্গ বা পুরোহিতরা তাদের কঠোর বিধি দিয়ে এই
মিশ্রণ রোধ করতে পারে নি। ফলে খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ অব্দের ভিতরে ভারতীয় আর্য ভাষা
থেকে ইরানীয় আর্যভাষার প্রভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সময়ের ইরানী আর্য ভাষায় রচিত
গ্রন্থের সাথে ভারতীয় আর্যদের দ্বারা রচিত বেদের ভাষার অনেক মিল পাওয়া যায়, কিন্তু
দুটি ভিন্নতর ভাষা তাও স্পষ্টই ধরা পড়ে। ধারণা করা হয়,
বেদের শ্লোকগুলো রচিত
হয়েছিল খ্রিষ্ট-পূর্ব ১২০০- খ্রিষ্টপূর্ব
৬০০ অব্দের ভিতরে।
বৈদিক ঋষিরা তাঁদের অধীত বিদ্যা রচিত শ্লোকাকারে শিষ্যদের শোনাতেন। শিষ্যরা মনে
রাখতেন এবং তাঁরা আবার তাঁদের শিষ্যদের ওই শ্লোক শোনাতেন। গুরু পরম্পরায় এই শ্লোকগুলো শ্রবণের
মাধ্যমে শিক্ষা হতো বলে এর নাম ছিল শ্রুতি। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন সকল শ্লোককে চারটি ভাগে ভাগ করে নাম দিলেন ঋক্, সাম, যজু, অথর্ব।
বেদের এই ভাষাকে ভাষাবিজ্ঞানীর নাম দিয়েছেন বৈদিক ভাষা। প্রতিটি বেদ রচিত হয়েছিল গদ্যে ও পদ্যে। এর ভিতরে গদ্য রচিত
শ্রুতিগুলোর নাম দেওয়া হয়েছিল ব্রাহ্মণ। এতে
ছিল তত্ত্বকথা এবং যাগযজ্ঞের বিধি। এর
পদ্যে রচিত অংশের নাম দেওয়া হয়েছিল সংহিতা। এই অংশ মূলত ছন্দে গাঁথা বেদমন্ত্রসমূহ।
বেদগুলোর আরও দুটি অংশ রয়েছে। এই অংশদুটি হলো- আরণ্যক ও উপনিষদ।
চারবেদের মধ্যে আদি বেদের নাম- ঋগ্বেদ। ধারণা করা হয়- ঋগ্বেদের আদি শ্লোকগুলো রচিত হয়েছিল
অানুমানিক ১২০০-১০০০ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের।
এই সময়ের ভিতরে মূলত আদি ছন্দোবদ্ধ ঋকমন্ত্রগুলো এবং গদ্য
নিবদ্ধ ব্রাহ্মণ রচিত হয়েছিল। এই ধারা খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
সম্ভবত এই সময়ের ভিতরেই রচিত হয়েছিল 'আরণ্যক অংশ'। আর ৮০০ থেকে-৫০০
খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে রচিত হয়েছিল উপনিষদ।
আর্য অনার্যের দ্বন্দ্ব এবং মিলনের যুগপৎ ধারায় প্রাচীন ভারতে সৃষ্টি হয়েছিল
সঙ্কর মানবগোষ্ঠী। সেই সাথে সঙ্কর ভাষা ও সঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছিল পরবর্তী ৮০০
খ্রিষ্টপূর্বের ভিতরে। আর্য ঋষিরা প্রথম দিকে অনার্যদের সংস্রব এড়িয়ে চলতেন
আভিজ্যত্যের গৌরবে। পরে তা সংক্রামিত হয়েছিল নিজেদের ভিতরে।
অর্থাৎ বর্ণ বিভেদের বিচারে আর্যরা বিভাজিত হয়ে গিয়েছিল।
ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণরা হয়ে উঠেছিল সমাজের শ্রেষ্ঠ গোষ্ঠী। নিজেদের আধিপত্যকে
সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল ধর্মবিধি। ব্রাহ্মণরা নিজেদের সৃষ্ট শাস্ত্র দিয়ে এমন অবস্থায়
তাঁরা নিয়ে গিয়েছিলেন যে, তাঁদের তপতাপে দেবতারাও ভীত ছিল। এই ক্ষমতা ধরে রাখার
জন্য এরা রাজাকে সাথে নিয়েছিল। প্রজাকে শাসন করার জন্য রাজার অমোঘ ধর্মবিবিধকে
ব্যবহার করতো। ঋষিদের প্রয়োজন ছিল জীবন-ধারণের জন্য প্রয়োজনীয়
উপকরণ। তাছাড়া অনার্য তথা রাক্ষস, দানব ইত্যাদির বন্য মানবগোষ্ঠীর আক্রমণ থেকেও
রক্ষা করতো রাজারা। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ঋষিরা রীতিমতো আজ্ঞাবাহকে পরিণত
হয়েছিল। ঋষিরা রাজাদের গুণকীর্তন করতেন এবং তাঁরা নিজেদের পরেই রাজপুরুষদেরকে
'ক্ষত্রিয়' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এমন ভাবে তাঁর বিধি তৈরি করলেন, যেখানে
ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় হয়ে জন্মানো ছিল বহু বহু বার জন্মগ্রহণ এবং পূন্য সঞ্চয়ের
সুফল। এরই ভিতর দিয়ে সনাতন আর্য ধর্ম হয়ে গেল- সর্বভারতীয় হিন্দু ধর্ম। এসব করে
ঋষিরা যে অচলায়তন তৈরি করেছিলেন, তার সুদৃঢ় দেয়ালের ভিতরে নিজেরাই বন্দী হয়ে গেলেন।
অব্রাহ্মণ এবং অক্ষত্রিয় আর্যদের সাথে অনার্যদের মেলামেশা বেড়ে গিয়েছিল। এদের
সংমিশ্রণে সঙ্কর জাতি সৃষ্টির পথ সুগম এবং দ্রুততর হয়ে উঠেছিল। দেহগত মিশ্রণের
পাশাপাশি আদিম প্রাকৃত ভাষার সাথে বৈদিক ভাষার মিশ্রণে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে
আদিম প্রাকৃত ভাষা নানা রূপ লাভ করেছিল। একই ভাবে ভারতীয় সঙ্গীতের নতুন রূপ লাভের
পথকে প্রশস্ত করেছিল।
ভারতীয় বৈদিক গানের যুগ (খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০-৮০০ অব্দ)
ভারতীয় ঋষিরা শ্লোক তৈরি করতেন ছন্দে। সেখানে আবৃত্তি বিশেষ
স্থান পেলেও, সুরের প্রাধান্য ছিল না। কিন্তু আর্য-লোকসমাজে গানের চর্চা ছিল।
কালক্রমে ঋষিরা শ্লোকগুলোতে সুরারোপ করে যাগ-যজ্ঞে পরিবেশন করা শুরু করেছিল। এই
সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল সামগান। আর এসকল গানের সংকলনই হলো- সামবেদ-সংহিতা। ১২০০-৮০০ অব্দের দিকে ভারতীয় সঙ্গীতের তিনটি ধারা সচল ছিল। এগুলো হলো-
- আদিম ভারতী্য়-আর্যদের লোক সঙ্গীত: অব্রাহ্মণদের রচিত
বা পরিবেশিত সংসারের
আনন্দবেদনার গান। সামবদের ভাষায় এসব গানকে উল্লেখ করা হয়েছে
গ্রামগেয় গান। মতঙ্গমুনির রচিত বৃহদ্দেশী গ্রন্থে এই গানকে বলা হয়েছে
দেশী গান। এই গানের চর্চা করতেন স্ত্রীলোকগণ, বালকগণ, রাখালগণ, রাজন্যবর্গ
নিজের নিজের ইচ্ছানুসারে নিজের নিজের দেশভূমিতে অনুরাগ-সহকারে। এই সংজ্ঞা থেকে
বিশেষভাবে জানা যায় আঞ্চলিক গানের উপস্থিতির কথা। বিভিন্ন অঞ্চলের সাধারণ
আর্যভাষাভাষীরা সাধারণভাবে নিজের নিজের দেশভূমিতে অনুরাগ-সহকারে পরিবেশন করতেন।
আদিম ভারতী্য়-আর্যদের সাধারণ মানুষের সাথে ব্রাহ্মণদের গভীর সম্পর্ক ছিল
পারস্পরিক স্বার্থে। ঋষিরা সাধারণ অব্রাহ্মণদের যতই অস্পৃশ্য ভাবুক, তাদের
অন্ন-বস্ত্রের যোগানদার হিসেবে তাঁদের কাছে যেতেই হতো। অন্য দিকে পরকালের
স্বর্গলোকে স্থান পাওয়ার উপায় এবং অবলম্বন ছিল ব্রাহ্মণরা। ফলে ধর্মের আফিমের
নেশায় বুঁদ হয়ে তারা ব্রাহ্মণদের সেবা করতেন।
- অনার্য লোক সঙ্গীত: সেকালের ভারতের বসবাসকারী আদিবাসীদের গান, যা
বংশ পরম্পরায় এখনো ভারতের বিভিন্ন আদিবাসীদের মধ্যে চলে আসছে। এঁরা নানাভাবে
আর্যদের দ্বারা নিগৃহীত হলেও প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষমতা ছিল না। দু'একটি ছোটো
বড় বিদ্রোহ দেখা দিলেও আর্য রাজারা তা কঠোরভাবে দমন করতেন। এঁরা মূলত আর্যদের
এড়িয়ে চলার জন্য দুর্গম অরণ্যের ভিতরে নিজেদের সংস্কৃতি নিয়ে টিকে ছিলেন। আদিম
আর্য লোকসঙ্গীত এবং অনার্য লোকসঙ্গীতের কোনো নমুনা আমাদের কাছে নেই।
ভারতের লোকসঙ্গীতের চর্চার ছিল প্রধানত ছিল
সামাজিক অনুষ্ঠানাদি নির্ভর (বিবাহ, অন্নপ্রাসন, নবান্ন), মানবিক প্রেম, কিছু
লোককাহিনি ও ধর্মীয় কাহিনিভিত্তিক গান। এ সকল গানের বাণী ছিল আঞ্চলিক ভাষারীতি (আঞ্চলিক
উচ্চারণ এবং অর্থনির্ভর শব্দ) অনুসরণে। আঞ্চলিকতার বিচারে সুরের প্রকৃতিও ছিল ভিন্ন
ভিন্ন ধরনের। খাঁটি অনার্য জাতির সঙ্গীতের সুরের প্রকৃতির সাথে আর্যপল্লীগুলোর
লোকসুরের পার্থক্য তৈরি হয়েছিল। আবার আর্য-অনার্য লোকসঙ্গীতের সংগীতের মিশ্র ধারার
সৃষ্ট লোকগানও ছিল। আঞ্চলিকতার বিচারে অনার্য লোকসঙ্গীতকে প্রাথমিক ভাবে দুটি ভাগে
ভাগ করা যায়। ভাগ দুটি হলো-
- দ্রাবিড় লোকসঙ্গীত: এর বিকাশ ঘটেছিল দক্ষিণ
ভারতে।
- উত্তরভারতীয় লোকসঙ্গীত: উত্তর ভারতের অনার্য
জনগোষ্ঠী এবং আর্য পল্লীর সাধারণ মানুষের সাধারণ সঙ্গীত চর্চার মধ্য দিয়ে
বিকশিত হয়েছিল।
বেদোত্তর যুগের ভারতীয় সঙ্গীত
খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দ পর্যন্ত ছিল আর্য তথা সনাতন হিন্দু ধর্মের
বিকাশ কাল। গৌতমবুদ্ধের (জন্ম: ৫৬৭-৫৬৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ, মৃত্যু
৪৮৭-৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ধর্মীয় দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা
ধর্মীয় মতবাদ, সনাতন ধর্মেকে ভিন্নতর দর্শনের সন্ধান দিয়েছিল। সেই
সূত্রে ভারতীয় সঙ্গীতের ভাবগত বিষয়ের নতুনত্বের সৃষ্টি হয়েছিল।
বৌদ্ধধর্মের এই বিকাশের বাইরে বিকশিত হয়েছিল পৌরাণিক যুগ। এই যুগের
শুরুতে রচিত হয়েছিল হিন্দু ধর্মের নানা ধরনের পৌরাণিক উপাখ্যান। এসকল
উপাখ্যান লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। খ্রিষ্টীয় ৩০০ অব্দের দিকে এসকল
উপখ্যানের সংকলন হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ১৮টি পুরাণ ও উপপুরাণ।
ধর্মভিত্তিক এসকল গ্রন্থের বাইরে রচিত হয়েছিল- ব্যাকরণ ও নানা দর্শনের
সূত্রাদি। এই ধারায় সৃষ্টি হয়েছিল সঙ্গীতবিষয়ক গ্রন্ধাদি। খ্রিষ্টপূর্ব
৩০০ অব্দের দিকে নারদের রচিত শিক্ষা নামক গ্রন্থ। তবে খ্রিষ্ট-পূর্ব
২০০ অব্দের দিকে পূর্ণাঙ্গ অভিনয় ও নৃত্যগীত বিষয়ক মহৎ গ্রন্থ 'নাট্যশাস্ত্র'
রচনা করেছিলেন ভরত।
মূলত মহাকাব্যিক যুগ থেকে
গান্ধর্ব গান ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিকাশে অনন্য ভূমিকা রাখে।
এর মধ্য দিয়ে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ধীরে ধীরে নব্যরূপ লাভ করতে থাকে।
তথ্যসূত্র: