বাংলা গান
(১৯০০-৫০ খ্রিষ্টাব্দ)

১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের শুরু থেকে বাংলা গানের জগতে নাগরিক গান হিসেবে জনপ্রিয় ছিল- নানা ধরনের লোক গান। এর পাশাপাশি ছিল আধা লোক গান হিসেবে কীর্তন। ছিল কবি গান ও যাত্রা গানের চল। এসব গানের প্রভাবে নাগরিক গানের অন্যতম ধারা তথা থিয়েটারের গানে তার প্রভাব পড়েছিল ব্যাপক।

ধর্মসঙ্গীতের বিচারে কীর্তনের প্রভাব বঙ্গদেশের প্রায় সকল অঞ্চলকেই ছুইয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আঙিনা থেকে বেরিয়ে এসে ব্রহ্মসঙ্গীত কলকাতা এবং অন্যান্য শহরাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।

আধুনিক গান:
১৯৩০
খ্রিষ্টাব্দের ২৭ এপ্রিল (বুধবার, ১৪ এপ্রিল ১৩৩৪) কলকাতা বেতারে হৃদয়রঞ্জন রায় নাম এক শিল্পীর বাংলা গান সম্প্রচারের সময়, উপস্থাপক বাংলা গান কথাটির আগে আধুনিক শব্দটি ব্যবহার করেন। এরপর থেকে বেতারে বাংলা গানের সম্প্রচারের সময় আধুনিক গান শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে। েতারের সম্প্রচারের সূত্রে এই শব্দটি  ব্যাপক ভাবে চালু হয়ে যায়।

সবাক চলচ্চিত্রে বাংলা গানের অনুপ্রবেশে
ভাষাভিত্তিক চলচ্চিত্রের কথা বললেই সবাক চিত্রের কথাই উঠে আসে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত 'জামাই ষষ্ঠী'র কথা। এর আগে বঙ্গদেশে নির্মিত সকল ছবিই ছিল- নির্বাক। বঙ্গদেশে নির্মিত নির্বাকযুগের চলচ্চিত্রের আদি পরিচালক ছিলেন হীরালাল সেন১৮৯৩ থেকে ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি চল্লিশটিরও বেশি ছোটবড় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন।

অন্যদিকে ভারতে বসবাসকারী পারশ্যের ব্যবসায়ী জামশেদজি ফ্রেমজি ম্যাডান ঘটনাক্রমে কলকাতার আদি চলচ্চিত্র প্রযোজনার সাথে যুক্ত হন ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। প্রথম দিকে তিনি প্রথমে প্যারিশের 'পাথে প্রোডাকশনস' কোম্পানীর নির্মিত ছবি দেখানোর ব্যবস্থা করেন। তিনি এই ছবিগুলো বায়োস্কোপ নামে েখাতেন কলকাতার ময়দানে এবং তাঁর ক্রয়কৃত করিন্থিয়ান হলে। এসকল প্রদর্শন করতেন এলফিনস্টোন বায়োস্কোপ কোম্পানীর নামে।

১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতার প্রথম স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ প্রতিষ্ঠা করেন 'এলফিনস্টোন পিক্‌চার প্যালেস'। বর্তমানে এর নাম 'চ্যাপলিন সিনেমা'। এছাড়া তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ম্যাডান থিয়েটার আর 'প্যালেস অফ্‌ ভ্যারাইটিস'।

১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে, জামশেদজি তাসকল ব্যবসাকে ম্যাডান থিয়েটারস লিমিটেড নামে একটি যৌথ স্টক সংস্থার অধীনে আনেনফলে এই কোম্পানির অধীনে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো  ম্যাডান থিয়েটারস নামে বাজারজাত হয়েছিল।  ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাডানের প্রযোজনায় তৈরি হয় 'বিল্বমঙ্গল' নামক নির্বাক চিত্র। এ ছায়াছবিটি প্রথম প্রদর্শন হয় 'কর্ণওয়ালিস থিয়েটার'-এ। দ্রষ্টব্য [প্রচারপত্র]

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের আগে ম্যাডান থিয়েটার অনেকগুলো নির্বাক ছবি তৈরি করেন। তাই এ সকল ছায়াছবিগুলোকে প্রকৃত অর্থে বাংলা ছবি বলা যায় না। জামশেদজি উন্নতমানের চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ভারতের বাইরে থেকে অভিজ্ঞ বেশকিছু পরিচালকের উপর দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। এঁরা ছিলেন- ইউজেনিও দে লিগুরো, ক্যামিল লে গ্রাঁদ আর জর্জিও ম্যানিনি। লিগুরো পরিচালনা করেছিলেন নল দময়ন্তী (১৯২০) ও  ধ্রুব চরিত্র (১৯২১), লে গ্রাঁদ পরিচালনা করেছিলেন রত্নাবলী (১৯২২), আর ম্যানিনি পরিচালনা করেছিলেন সাবিত্রী সত্যবান (১৯২৩)।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে জামশেদজি ফ্রেমজি ম্যাডান মৃত্যুর পর তাঁর তৃতীয় পুত্র জেজে ম্যাডান, ম্যাডান  থিয়েটারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন। জেজে ম্যাডান কোম্পানির চলচ্চিত্র ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করেন। এই সূত্রে ম্যাডান থিয়েটারের প্রযোজনায় তৈরি হয় আরও কিছু নির্বাক ছায়াছবি তৈরি হয়। ইতিমধ্যে সবাক চলচ্চিত্র তৈরির কৌশল আবিষ্কার হলে, ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জেজে ম্যাডান সবাক ছায়াছবি তৈরির দিকে নজর দেন। এই সূত্রে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল (শনিবার ২৮ চৈত্র ১৩৩৭) মুক্তি পেয়েছিল  জামাই ষষ্ঠী'র নামক সবাক চলচ্চিত্র। মূলত এই ছবির দ্বারাই বাংলা চলচ্চিত্র প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই ছবির পরিচালক ছিলেন অমর চৌধুরী আর সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন ক্ষিরোদগোপাল মুখার্জি।
এই বছরের ৩০ মে (শুক্রবার ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৭) মুক্তি পেয়েছিল জ্যোতিষ বন্দ্যপাধ্যায়ের পরিচালিত জোর বরাত এবং
নিউ থিয়েটার্সের প্রযোজিত, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী পরিচালিত চলচ্চিত্র 'দেনা পাওনা' মুক্তি পেয়েছিল।

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা সবাক চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হলেও, ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কোনো গান ব্যবহৃত হয় নি। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে নীতিন বসুর পরিচালিত ভাগ্যচক্র ছবিতে প্রথম গানের ব্যবহার হয়। এই ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজ মল্লিক। ভাগ্যচক্রের প্রচার পুস্তিকা থেকে জানা যায় এই ছবিতে মোট ৯টি গান ব্যবহৃত হয়েছিল। গানগুলো হলো-

  1. মনরে আমার খুলে দে।
  2. ওরে পথিক তাকা পিছনে
  3. মোরা পুলকে যাচি
  4. আমার ভুবন ভ'রে বেজেছে আজ
  5. লাখ লাখ হিয়ে হিয়ে রাখনু
  6. কেন পরাণ হলো না
  7. সুন্দর মম শুনালে যে কোন
  8. বাণীহৃদয় আমার, আনন্দ তোর
  9. বুকের মাঝে নিলেম যারে
     


 


সূত্র :