জারি
বাংলা লোকসঙ্গীতের একটি দলগত পরিবেশনার বিশেষ ধারা।
ফারসি 'জারি' শব্দের অর্থ হলো ক্রন্দন, বিলাপ, প্রচার। কিন্তু জারি গান একটি ভিন্ন অর্থ বহন করে। এর সূচনা হয়েছিল আশুরার সূত্রে।

ইসলামী ইতিহাস অনুসারে,  হিজরী ৬১ সনের ১০ই মহরম (‌১০ অক্টোবর, ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ) তারিখে,
হজরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন কারবালা প্রান্তরে শহিদ হন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ভিতর শিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। উল্লেখ্য হজরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর মৃত্যুর পর যে চারজন খলিফা পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন, এঁদের ভিতর চতুর্থ খলিফা ছিলেন, নবীর জামাতা হযরত আলীকে (রা.)। কিন্তু শিয়া মতাবলম্বীরা মনে করেন,  হযরত আলী(রা.)-ই প্রকৃতপক্ষে প্রথম খলিফা মানে। কিন্তু নবীর মৃত্যুর পর হযরত আলী (রা.) খলিফা নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হন। পরপর তিনজন খলিফার শাসনকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পর, ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এ পদে নির্বাচিত হন। সে সময় তৃতীয় খলিফা উসমানের (রা.) আত্মীয় মুয়াবিয়া (রা.) এর তীব্র বিরোধিতা করেন। হযরত আলী (রা.) ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দে শাহাদত বরণ করলে, তাঁর পুত্র হযরত হাসান (রা.) খলিফা হন। কিন্তু তিনি মুয়াবিয়ার (রা.) কাছে খেলাফত ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এর কিছুপরে পরেই বিষ প্রয়োগে তাঁকে হত্যা করা হয়। মুয়াবিয়ার (রা.) মৃত্যুর পর হযরত হাসানের (রা.) ভাই হযরত হুসেইনকে (রা.) খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হবেন বলে অনেকে আশা করেছিলেন। কিন্তু মুয়াবিয়ার (রা.) পুত্র ইয়াজিদ খলিফা হন। এই সূত্রে হযরত হোসেন (রা.) এবং ইয়াজিদের ভিতরে সংঘাতের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত হিজরী ৬১ সনের ১০ই মহরম (‌১০ অক্টোবর, ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ) ইয়াজিদের বাহিনীর কাছে কারবালা প্রান্তরে হযরত হোসেন (রা.) পরাজিত ও নিহত হন। হযরত আলী (রা.) ও তাঁর পুত্রদের সমর্থকরা একে এজিদের একটি ধর্মবিরোধী কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই ভাবনা ধীরে ধীরে শিয়া মতবাদের জন্ম দেয়।

খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতকে পারশ্যে সাফাভি বংশ ক্ষমতায় আসে। এই সময় শিয়া মতবাদ পারশ্যে প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনায় প্রচারিত হতে থাকে। সাফাভি শাসকরা শিয়া মতবাদকে পারস্যের রাষ্ট্রধর্ম করেন এই সময় থেকে পারশ্যে মর্সিয়া ও মাতমের মাধ্যমে দিন হিসেবে ১০ই মহরমকে মান্য করে থাকেন। তাঁর এর নাম দেন আশুরা

১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৬১৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর-এর বঙ্গদেশে সামরিক অভিযান চালান। এই সময় তাঁর সেনাবাহিনীর সাথে বহু শিয়া মুসলমান বঙ্গদেশে আসে। এঁদের অনেক উচ্চ রাজপদে আসীন ব্যক্তিবর্গসহ সাধারণ সৈন্যরা বাংলাতে থেকে যান এবং বাঙালি হয়ে উঠেন। এঁদের উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতি হিজরি সনের প্রথম মাস মোহররমের প্রথম দশ দিন কারাবালার করুণ ঘটনাকে স্মরণ করে আনুষ্ঠানিক পর্ব পালনের সূচনা হয়। কালক্রমে এই অনুষ্ঠান ছড়িয়ে পড়ে সুন্নি-মুসলমানদের ভিতরে। ফলে  আশুরা বঙ্গদেশে শুধু শিয়াদের অনুষ্ঠান না হয়ে, মুসলমানদের সকল গোষ্ঠীর কাছে একটি বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।

সপ্তদশ শতকে বঙ্গদেশের মধ্যযুগের মুসলমান কবিরা ইসলাম ধর্মের সাথে সম্পর্কিত নানা ধরনের কাব্য রচনা করেন। যতদূর জানা যায়,
কবি মুহম্মদ খান ১৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে মকতুল হোসেন শীর্ষক কারবালা-কেন্দ্রিক একখানি শোকগাথা রচনা করেন। এই গ্রন্থটি আখ্যায়িকা কাব্য হিসেবে পরিচিত। এক সময় এই গ্রন্থটি আশুরা উপলক্ষে সুর করে পাঠ করা হতো। সেই কারণে এই গ্রন্থটিকে জারি গানের আদি নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

কালক্রমে দীর্ঘ কাব্যগাঁথার পরিবর্তে স্থানীয় কবিয়ালদের অনেকে ছোটো ছোটো করে গান বাঁধা শুরু করেন। এঁদের দ্বারা সাধারণ কৃষিজীবী মুসলমানদের ভিতরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাংলা লোকগানের অংশ হয়ে যায়। পরে আশুরার কাহিনির মতো,  আরব-পারস্য অঞ্চলের বহু আখ্যান কাব্য বাংলাকাব্যজগতে ঢুকে পরে। ধীরে ধীরে এই ধারায় যুক্ত হয় জহরনামা, সাদ্দাদের জারি, শাহজালালের জারি, সোহরাব-রোস্তমের জারি ইত্যাদি আখ্যানকাব্য। আরও পরে এর সাথে যুক্ত হয়েছে- সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ব্যঙ্গরসাত্মক বিষয়, পরিবার-পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ক জারি গান।

কবিয়ালরা যখন এই জাতীয় গান ছোট ছোট আকারে শোকের গান হিসেবে প্রকাশ করে করুণা প্রকাশ করেন, তখন তাকে বলা হয় মর্সিয়া। আর কবিয়ালরা যখন বিস্তৃতভাবে নানাসুর বৈচিত্রের মাধ্যমে পরিবেশন করেন, তখন তাকে বলে জারি গান। অনেক সময় মূল কবিয়ালের সাথে কিছু সহযোগী শিল্পী ধুয়া ধরেন। তখন তা হয়ে যায় ধুয়া গান। মূলত মুহররম উপলক্ষে এ তিনটি ধারায়ই গীত পরিবেশিত হয়।

গোড়ার দিকে জারিগান ছোটো সময় পরিসরে ছোটো করে গাওয়া হতো। কালক্রমে তা জারিগান ভিত্তিক কবিগানে পরিণত হয়। এই জাতীয় কবিগানে দুই জন কবিয়ালরা দুটি দলে ভাগ হয়ে জারিগান পরিবেশন করা শুরু করেন। এই পরিবেশনা হয় কবির লড়াইয়ের মতো। এই জাতীয় জারি গানে দুটি দল থাকে। প্রত্যেক দলে একজন করে মূল গায়ক বা বয়াতি থাকে। তাঁর সঙ্গে দোহার থাকে দুই থেকে চারজন এবং বাদক থাকে কমপক্ষে চারজন। অবশ্য অধিকাংশ বয়াতি নিজে দোতরা জাতীয় বাদ্যযন্ত্র বাজান। এই জাতীয় জারিগানে ব্যবহৃত হয়
ঢোলক, একতারা, দোতারা, সারিন্দা, বেহালা, বাঁশি, জুড়ি বা ঘুঙুর, খঞ্জনি, হারমোনিয়াম, কাঁসা ইত্যাদি। মূল গায়ক বা বয়াতি প্রথমে দর্শক-শ্রোতাদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ধুয়া গান ধরেন এবং দোহাররা তা সমবেত কণ্ঠে গান। দুই দলের কবিয়াল প্রশ্নোত্তরমূলক গান দিয়ে আসর এগিয়ে চলে। দীর্ঘ সময় ধরে পরিবেশন উপযোগী এই গানগুলো তিনটি পর্বে বিভক্ত। পর্বগুলো হলো- বন্দনা, গোষ্ঠগান ও মূল জারি গান।

মূল গায়কই সবকিছু শুরু করেন এবং দোহাররা তাঁর চতুর্দিকে বসে তাকে সাহায্য করেন। সঙ্গীত পরিবেশনের সময় কবিয়াল দোহারদের ঘিরে সঙ্গীতের ছন্দে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে গান পরিবেশন করেন। এই জাতীয় জারি গানে নারী-পুরুষের সম্পর্ক, জীবাত্মা-পরমাত্মা, গুরু-শিষ্য, শরিয়ত-মারিফত, আদম-শয়তান, গণতন্ত্র-রাজতন্ত্র, সুফি-মোল্লা ইত্যাদি নানা বিষয় থাকে। আসরের শেষের দিকে দুদল মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্নোত্তর কাটাকাটি করেন। একে বলা 'জোটক'।

জনপ্রিয়তার সূত্রে এই গানের চর্চা অন্দরমহলেও ছিল। ঘরের মেয়েরা আশুরা উপলক্ষে নিজেদের মতো করে জারিগান করতেন। কালক্রমে কোনো কোনো অঞ্চলে মেয়েরা প্রকাশ্যেই জারি গান করা শুরু করেন। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রামে আশুরার দিনে একাদশ ও দ্বাদশ দিবসে মেয়েরা জারি গান পরিবেশন করেন। আদি ময়মনসিংহ জেলার পূর্বাঞ্চলে জারিগানের পাশাপাশি জারি নৃত্যেরও প্রচলন আছে।

জারি গান পরিবেশনায় ঝিনাইদহের পাগলা কানাই ছিলেন প্রবাদতুল্য। পরবর্তীকালে আবদুল মালেক দেওয়ান, আবদুল খালেক দেওয়ান, আবদুল গণি বয়াতি, দারোগ আলী বয়াতি, সাই আলী বয়াতি, আববাস আলী ভাসান, মোহাম্মদ আলী আকবর মিয়া প্রমুখ বয়াতি জারি গানের ধারাকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যান।